তরুণদের হাতেই আগামীর বাংলাদেশ

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে এ দেশের মানুষ যে বিজয় অর্জন করেছিল, তার লক্ষ্য ছিল সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করা।

মুক্তিযুদ্ধের একটি জনপ্রিয় গান ছিল, ‘আমার এ দেশ সব মানুষের, সব মানুষের/ চাষাদের, মুটেদের, মজুরের/ গরিবের নিঃস্বের ফকিরের।’ কিন্তু আমরা দেশটা সব মানুষের জন্য করতে পেরেছি কি না, সেই প্রশ্ন উঠবে। এর অর্থ এই নয় যে আমাদের স্বাধীনতা বা বিজয় ব্যর্থ হয়েছে। এই যে এক কোটির বেশি মানুষ বিদেশে কাজ করছেন, যাঁদের ৯ শতাংশ গায়ে খাটা শ্রমিক, এই যে তৈরি পোশাক কারখানায় ৪০ লাখ নারী শ্রমিক কাজ করেন, দেশ স্বাধীন না হলে সেটি সম্ভব হতো না। বাংলাদেশের সবুজ পাসপোর্ট বহনকারী বাংলাদেশি এখন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছেন, তঁারা বাংলাদেশের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি নিয়ে গেছেন। এ রকম দেশে মনপ্রাণ রেখে যাওয়া প্রবাসী আর কোনো দেশে আছে বলে জানা নেই। 

গত ৫২ বছরে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে আমরা অনেক উন্নতি করেছি। কিন্তু সেই উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছে দেওয়াই আমাদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। সম্প্রতি বিআইডিএসের সম্মেলনে দেশে–বিদেশে থাকা অর্থনীতিবিদেরা অর্থনৈতিক বৈষম্য, সুশাসনের ঘাটতি, দুর্নীতি–অপচয় ও অর্থ পাচার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, সেটা যদি আমাদের নীতিনির্ধারকেরা আমলে নেন, তাহলে একাত্তরের ওই গানের ভাষায় দেশটি সব মানুষের হবে। এ কথা ঠিক, অর্থনৈতিকভাবে আমরা যতটা উন্নয়ন করতে পেরেছি, রাজনৈতিকভাবে সেটা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। 

১৯৭২ সালে আমরা যে সংসদীয় গণতন্ত্র দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম, সেটা যদি ধরে রাখা যেত, যদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও অগ্রগতি ধরে রাখা যেত, বাংলাদেশ সত্যি সত্যি রোল মডেল হতো। বাংলাদেশের মোট জনশক্তির বেশির ভাগ তরুণ, যঁাদের বয়স ১৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে, তঁাদের অপরিসীম উদ্যম, অজেয় প্রাণশক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। যোগ্যতা অনুযায়ী তাঁদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তার আগে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা ও ঘাটতিগুলো কাটাতে হবে। পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ পাওয়া যাবে না, যারা উন্নত শিক্ষা ছাড়া কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছে।

আমাদের ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতাসংগ্রাম ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিয়েছেন যে তরুণসমাজ, তঁাদের আমরা অগ্রাহ্য–অবহেলা করতে পারি না। তাঁদের ওপরই ভরসা রাখতে চাই। যখন দেখি এই তরুণদের একাংশ দুর্গত মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়, তখন আশান্বিত হই। আনন্দে চিৎকার দিয়ে বলি, এই তরুণেরাই পারবেন। আমাদের রাজনীতি, আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনার কেন্দ্রে রাখতে হবে এই তরুণদের

আমাদের তরুণেরা যদি বিদেশে গিয়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে যোগ্যতা, মেধা ও প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারেন, দেশের ভেতরে সুযোগ পেলেও তঁারা সেটি হাতছাড়া করবেন না। আমাদের রাজনীতি, আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনার কেন্দ্রে রাখতে হবে এই তরুণদের। 

আমাদের ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতাসংগ্রাম ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিয়েছেন যে তরুণসমাজ, তঁাদের আমরা অগ্রাহ্য–অবহেলা করতে পারি না। তাঁদের ওপরই ভরসা রাখতে চাই। যখন দেখি এই তরুণদের একাংশ দুর্গত মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান, তখন আশান্বিত হই। আনন্দে চিৎকার দিয়ে বলি, এই তরুণেরাই পারবেন। কিন্তু আবার যখন এই তরুণদের একাংশ বিজয় দিবসের প্রাক্কালে প্রতিপক্ষ ছাত্রসংগঠনের কর্মীদের ওপর হামলা করেন কিংবা রাতের আঁধারে যানবাহনে বোমা–ককটেল মারেন, তখন বিচলিত হই। তবে এ জন্য তরুণদের দায়ী করা যাবে না। দায়ী হলো সেই রাজনীতি, যা তাঁদের বিপথগামী করে। 

আরও পড়ুন

নব্বইয়ের গণ–অভ্যুত্থানের মধ্যে এরশাদের পতনের পর গণতন্ত্রের নবযাত্রা শুরু হয়। আমরা স্মরণ করতে পারি, স্বাধীনতার পর একবারই রাজনৈতিক নেতৃত্ব ঐক্যের সোপান তৈরি করেছিল—নব্বইয়ে তিন জোটের রূপরেখায়। এতে বলা হয়েছিল, ‘ভোটাররা যাতে নিজ নিজ ইচ্ছা ও বিবেক অনুযায়ী প্রভাবমুক্ত ও স্বাধীনভাবে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, সেই আস্থা পুনঃস্থাপন এবং তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।... নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী সব রাজনৈতিক দলের প্রচার-প্রচারণার অবাধ সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।’ 

সরকারি দলের মন্ত্রী-এমপিরা উন্নয়নের কথা জোরেশোরে প্রচার করেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ কায়েম করার পর এখন স্মার্ট বাংলদেশ গড়ার কথা বলছেন। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের প্রধান যে কারিগর, তাঁদের জীবনমানের উন্নয়ন কতটা হয়েছে, সেটি খোলাসা করে বলেন না। আমরা যদি সত্যি সত্যি উন্নয়নকে টেকসই করতে চাই, তাহলে এর সুফল বৃহত্তর জনগণের কাছে পৌঁছাতে হবে। স্বাধীনতার স্বাদ ও বিজয়ের আনন্দ থেকে তাঁদের বঞ্চিত করা যাবে না। 

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৭১ সালে। আর ভিয়েতনাম বিদেশি দখলমুক্ত হয় পঁচাত্তর সালে। কিন্তু বর্তমানে ভিয়েতনামের মানুষের গড় বার্ষিক আয় ৪ হাজার ৩১৬ মার্কিন ডলার, আমাদের ২ হাজার ৬২১ ডলার। প্রায় ১০ কোটি মানুষ নিয়ে ভিয়েতনামের অর্থনীতির আকার ৩৭তম, ১৭ কোটি মানুষ নিয়ে বাংলাদেশ ৪১তম। অর্থনীতিবিদদের মতে, ২০৩৫ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি যখন ২৫তম স্থানে চলে আসবে, তখন ভিয়েতনামের অর্থনীতি হবে ১৯তম। ভিয়েতনামে শিক্ষার হার ৯৬.১ শতাংশ, বাংলাদেশে ৭৪ শতাংশ, ভিয়েতনামে দারিদ্র্যের হার ২.৯৩ শতাংশ, বাংলাদেশে ১৮.২ শতাংশ, ভিয়েতনামে মূল্যস্ফীতি ৩.৫৯ শতাংশ, বাংলাদেশে ৯.৪৯ শতাংশ। ভিয়েতনামে বেকারত্ব ২.৩০ শতাংশ, বাংলাদেশে ৫ শতাংশ। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকার কারণেই ভিয়েতনাম এটি করতে পেরেছে। 

ভিয়েতনাম পারলে আমরা কেন পারব না? স্বাধীনতাসংগ্রামের মতো ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও সে দেশের তরুণেরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলাদেশের অমিত সম্ভাবনাময় লাখ লাখ তরুণের মেধা ও যোগ্যতা কাজে লাগাতে পারলে আমরাও ভিয়েতনাম হতে পারব। 

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]