প্রাণ ফিরে পাক চট্টগ্রামের সব জলপথ

মহেশ খালের মাঝখানে চর জেগে, নানা আবর্জনা জমে সংকুচিত হয়েছে। কাট্টলীর অংশ থেকে তোলা।ছবি: ওমর কায়সার

মহেশ খাল পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে। প্রাণ ফিরে পেতে যাচ্ছে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই জলাধার। চট্টগ্রাম শহরের একটি বিশাল অংশের জলাবদ্ধতার জন্য প্রধানত দায়ী এটি। কয়েক দিন আগে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী কাট্টলী এলাকায় সরেজমিনে খালটি পুনঃখননের কাজ দেখে মনে আশা জেগেছে।

আবর্জনা আর মনুষ্যনির্মিত স্থাপনার চাপে কোথাও কোথাও অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, কোথাও কোথাও ভাগাড়ে পরিণত হওয়া এই খাল যেন মাটির গর্ভ থেকে উঠে এসে আবার নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে।

মহেশ খালের গঠন অন্যান্য খাল থেকে একটু ভিন্ন প্রকৃতির। এর একটি মুখ সল্টগোলা কাস্টমস পদচারী–সেতুর কাছ দিয়ে গিয়ে কর্ণফুলীর নদীর সঙ্গে মিশেছে। অন্য একটি মুখ সেনাবাহিনীর হালিশহর আর্টিলারি সেন্টারের পাশ দিয়ে পশ্চিমমুখী হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে, আরেকটি শাখা কাট্টলী খাল নাম নিয়ে সাগরিকা স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে।

ত্রিমুখী এই খালের উৎপত্তি ঠিক কোথা থেকে শুরু হয়েছে, তা বের করতে অনেকেই তাই ধন্দে পড়েন। দুটি মুখ বঙ্গোপসাগরে, একটি মুখ নদীতে বলে একটা সময় নগরের যোগাযোগ ও পানিনিষ্কাশনের অন্যতম মাধ্যম ছিল এটি। চট্টগ্রাম নগরের পাহাড়গুলো থেকে জন্ম নেওয়া নাসির খাল, রামপুর খাল, গহনের ছড়া ও কয়েকটি টারশিয়ারি খালের ধারা যথাক্রমে পাকিজা খাল, লাল মিয়া ছড়া, আজব বাহার খাল মহেশ খালের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এর প্রবাহের গতি বাড়িয়েছে।

চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদ, হালিশহর, ফইল্যাতলী, দক্ষিণ ও উত্তর কাট্টলী, সল্টগোলা, ঈশান মিস্ত্রির হাটসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মহেশ খাল সংস্কার করা হলে এখানে জলাবদ্ধতার জ্বালা অনেকটা কমবে বলে মনে করছেন অধিবাসীরা।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের জলাবদ্ধতা–বিষয়ক উপদেষ্টা শাহরিয়ার খালেদ বলেন, মহেশ খাল পুনঃখনন হলে আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, মুহুরিপাড়া, রামপুর, সরাইপাড়া, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড এলাকা, ছোট পুল, বড় পুল, সরাইপাড়া, হালিশহর আবাসিক এলাকা, আগ্রাবাদ পুলিশ লাইনস এলাকা, সেনাবাহিনীর হালিশহর আর্টিলারি এলাকা, ঈদগাহ এলাকা, সাগরিকা শিল্প এলাকাসহ সংলগ্ন এলাকার জলাবদ্ধতা কমে যাবে।

যেখানে সংস্কার হয়েছে, সেখানে প্রশস্ত হয়েছে মহেশ খাল। দুই পাশে তৈরি হয়েছে সড়ক।
ছবি: ওমর কায়সার

চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা ও পানিনিষ্কাশন মেগা প্রকল্প নামে একটি প্রকল্পের অধীন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আওতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর এটি বাস্তবায়ন করছে। আগামী ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে মহেশ খাল খননের কাজ সম্পন্ন হবে বলে আশা করছেন তাঁরা।

মহেশ খাল ছাড়াও চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য একই প্রকল্পের অধীন সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগ্রেড ২৬টি খাল সংস্কার করছে; পাশাপাশি সিটি করপোরেশন বারইপাড়া খাল, শেখ মুজিব রোড কালভার্ট, উত্তর কাট্টলী নাজির খাল, কালির ছরা, ছুন্নিয়া খালসহ প্রায় ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার ছোট–বড় ড্রেন থেকে মাটি ও আবর্জনা অপসারণের কাজ করছে। বৃষ্টির মৌসুম এসে গেল। এসব কাজ খুব দ্রুত সেরে ফেলা দরকার।

চট্টগ্রাম শহরের আনাচকানাচে একসময় প্রাণবন্ত স্রোতোধারা নিয়ে বহু খাল ও ছড়ার অস্তিত্ব ছিল। এসবে নৌযানের চলাচল ছিল। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কাছে নগরের ৫৭টি খালের তালিকা রয়েছে। এগুলোর অধিকাংশই এখন নালায় পরিণত হয়েছে। তবে নগরের প্রবীণ বাসিন্দারা বলছেন, সিটি করপোরেশনের তালিকাভুক্ত ৫৭টি খালের বাইরে আরও অনেক খাল ছিল। সিটি করপোরেশনের জলাবদ্ধতা–বিষয়ক উপদেষ্টা শাহরিয়ার খালেদ বলেন, আরাকান সড়কসহ চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় কিছু ছোট ছড়া দখল ও ভরাটের কারণে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এসব ছড়া প্রাইমারি খালগুলোর সঙ্গে মিশে ছিল।

অন্যদিকে বাণিজ্যকেন্দ্র খাতুনগঞ্জ এলাকায় প্রবাহিত মধ্যম বদরখালী খালটি দখলদারদের কবলে পড়ে দু–তিন ফুটের নালায় পরিণত হয়েছে। এটি বক্সিরহাট এলাকা হয়ে ওসমানিয়া গলির পাশ দিয়ে চাক্তাই খালে মিশেছে, সেখানে খালটি বর্তমানে ৩০ ফুট প্রস্থ। ১৯ নম্বর দক্ষিণ বাকলিয়া মিয়া খাননগর ম্যাচ ফ্যাক্টরি পাশ দিয়ে একসময় ৫০ থেকে ৮০ ফুট প্রস্থ চাক্তাই-বির্জা সংযোগ খালটি বর্তমানে ২ থেকে ৩ ফুটের নালায় পরিণত হয়েছে। অথচ এই করুণ অবস্থা একসময় ছিল না।

দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল বোয়ালখালী, পটিয়া, কক্সবাজারের কুতুবদিয়া, মহেশখালী, নোয়াখালীর হাতিয়া, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ থেকে যাত্রী ও পণ্যবোঝাই সাম্পান ভিড়ত চাক্তাই ও রাজাখালী খালে। আশির দশকের শেষ পর্যন্ত দুটি খালে বড় বড় পাল তোলা পণ্যবাহী নৌকা, লঞ্চ, স্পিডবোট চলতে দেখেছি আমরা। সত্তর থেকে আশির দশকে চাক্তাই খালে শুশুকের ঝাঁপাঝাঁপি দেখে আনন্দে মেতে থাকত খালপারের শিশু-কিশোরেরা। এই জলাবদ্ধ নগরে ময়লা–আবর্জনায় ভর্তি নালার পাশে দাঁড়িয়ে সেসব স্মৃতি আমাদের অতীতাকুল করে।

একটা সময় ছিল, যখন চট্টগ্রামের প্রধান ভরসা ছিল জলপথ। এখানে রাস্তাঘাট বানানো শুরু হয় ১৮৬০ সাল থেকে। তার ৩০ বছর আগে, অর্থাৎ ১৮৩০ সালে নৌপথে কলকাতা থেকে ক্যাপ্টেন পগসন নামের এক সরকারি কর্মকর্তা একটি তদন্তকাজে চট্টগ্রামে এসেছিলেন। তাঁর লেখা ‘ট্যুর টু চাটিগাঁও’-এ জলপথনির্ভর চট্টগ্রামের যোগাযোগব্যবস্থার কথা উল্লেখ রয়েছে।

সংস্কারের কাজ চলছে।
ছবি: ওমর কায়সার

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ইতিহাস থেকে জানা যায়, চট্টগ্রাম পৌরসভা গঠনের (১৮৬৩ সাল) সাত বছর আগে ১৮৫৬ সালের ১৪ মে তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে একটি প্রস্তুতি সভা হয়। সেই সভায় চট্টগ্রাম নগরের পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা ও জঙ্গল পরিষ্কার, নিম্ন এলাকায় ভূমির উচ্চতা নির্ধারণ এবং স্যানিটারি ল্যাট্রিন নির্মাণ—এ তিন বিষয়কে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চিহ্নিত করা হয়। সেই প্রাক্‌–পৌরসভার প্রস্তুতি সভার পর ১৬৯ বছর পেরিয়ে গেছে। এখনো এলাকাভিত্তিক ভূমির উচ্চতা নির্ধারিত হয়নি, হয়নি পানিনিষ্কাশনের যথাযথ ব্যবস্থা।

আগে হয়নি, তাই বলে ভবিষ্যতে হবে না, এটা নয়। হারিয়েছি, তা নিয়ে হাহাকার করেও লাভ হবে না। অতীতের জলপথনির্ভর যোগাযোগব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করে, পরিবেশের কথাটাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। পরিবেশ ও চট্টগ্রাম শহরকে জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষার জন্য খালগুলোর সংস্কার তাই জরুরি হয়ে পড়েছিল।

মহেশ খালের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চট্টগ্রামের চাক্তাই খাল। এই খালের অপর নাম চট্টগ্রামের দুঃখ। চাক্তাই খালের তলদেশে জমে থাকা আবর্জনা ও মাটি খননের কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। এই খালের দুই পাশে প্রতিরক্ষাদেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। শাহরিয়ার খালেদ বলেন, ২০০৪–০৫ সালে চাক্তাই খালের দুই পাশে তৎকালীন সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ কিছু অংশে অগভীর প্রতিরক্ষাদেয়াল করেছিল। এর ফলে খালকে প্রয়োজনীয় গভীর করা যাচ্ছে না।

অন্যদিকে অপরিকল্পিতভাবে এই খালের তলা পাকা করা হয়েছিল। এটির দরকার ছিল না। তলা পাকা করার কাজ নিম্নমানের হওয়ায় অনেক জায়গায় পাকার অস্তিত্বই নেই।
শাহরিয়ার খালেদ বলেন, চাক্তাই খালকে পূর্বাবস্থা ও পানিনিষ্কাশনের উপযোগী করতে হলো ২০০৪–০৫ সালে নির্মাণ করা নিম্নমানের অপরিকল্পিত, অগভীর প্রতিরক্ষাদেয়াল ভেঙে পুনরায় নির্মাণ করে প্রয়োজনীয় গভীর করতে হবে। একটু কষ্টসাধ্য হলেও বর্তমানে চাক্তাই খালকে কিছুটা গভীর করা যাবে ভাসমান এক্সকাভেটর দিয়ে। এতে বর্ষায় সন্নিহিত এলাকায় জলাবদ্ধতা কমবে।

চট্টগ্রাম শহরকে সঠিকভাবে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে শুধু চলমান কাজগুলো শেষ করলে হবে না। আরও ২১টি খাল–উপখালসহ পাহাড়ি ছড়া খননের প্রয়োজন হবে। এর জন্য মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নেওয়া দরকার। পাশাপাশি যেসব কাজ চলছে, সেগুলো যেন ত্রুটিমুক্ত হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। কারণ, এই বিনির্মাণ বা সংস্কারে যদি কোনো ভুল হয়, ভবিষ্যতে তার মাশুল দিতে হবে যুগের পর যুগ।

এদিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য একটি নতুন খাল খনন করছে। নতুন খালটির নাম বারইপাড়া খাল। ২ দশমিক ৯৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ খাল বহদ্দারহাট এলাকা থেকে শুরু হয়ে কর্ণফুলী নদীতে মিশেছে। খালটির ওপর কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু সড়কের এক কিলোমিটার এলাকায় একটি ব্রিজ নির্মাণাধীন। কিন্তু ব্রিজটি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক নিচু হচ্ছে বলে স্থানীয় অধিবাসী ও বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন।

খালটি উন্মুক্ত হলে এই নিচু ব্রিজটির জন্য চাক্তাই খাল হয়ে মির্জা খালের বড় অংশের পানি ও বহদ্দারহাট এলাকার ৬ ফুট প্রস্থের দুটি বড় নালার পানি একসঙ্গে নিষ্কাশিত হতে পারবে না। এ ছাড়া বাকলিয়া খালসহ অসংখ্য ড্রেনের পানি এই খাল দিয়েই নিষ্কাশিত হবে। বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে ব্রিজটির উচ্চতা নির্ধারণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে তাঁরা মনে করেন। চট্টগ্রামের খাল, পাহাড়ি ছড়াগুলোর মধ্যে কিছু কিছু চিরতরে নেই হয়ে গেছে। কিছু কিছু নালায় পরিণত হয়েছে।

সব কটি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চিন্তা হয়তো অবাস্তব কল্পনা। কিন্তু অনেকগুলোর পানিপ্রবাহ সচল করা সম্ভব। সব কটি খালে আগের মতো যাত্রী বা পণ্যবোঝাই যান চলবে না। কিন্তু সেগুলো সচল থেকে মানুষকে জলাবদ্ধতা থেকে রেহাই দেবে এবং চট্টগ্রামের পরিবেশ রক্ষা করবে। চট্টগ্রামের মানুষের এখনকার স্বপ্ন—প্রাণ ফিরে পাক চট্টগ্রামের সব জলপথ।

  • ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক