জাপানে ইশিবা শিগেরুর প্রধানমন্ত্রিত্ব যে কারণে সংক্ষিপ্ত হতে পারে

জাপানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী ইশিবা শিগেরু

জাপানের শাসক দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) ইশিবা শিগেরুকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করেছে। যেহেতু এলডিপি পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে, তাই ইশিবা জাপানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন।

৬৭ বছর বয়সী ইশিবা বহু বছর ধরে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। এ কারণে প্রধানমন্ত্রীর পদে উত্তরণকে তাঁর একটি দীর্ঘদিনের স্বপ্নের বাস্তবায়ন হিসেবে দেখা হচ্ছে।

তবে ইশিবার এই রাজনৈতিক উত্থানের উজ্জ্বলতা দ্রুতই ম্লান হয়ে যাবে; সম্ভবত খুব শিগগির।

ইশিবার উজ্জ্বলতা শিগগিরই ফিকে হওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে।

প্রথমত, ইশিবা উত্তর আটলান্টিক অঞ্চলের দেশগুলোর সামরিক সংগঠন ন্যাটোর আদলে এশিয়ায় একই ধরনের একটি জোট (যেটিকে ‘এশিয়ান ন্যাটো’ বলা হচ্ছে) গঠনের যে ধারণা দিয়েছেন, তা সম্পূর্ণরূপে অবাস্তব এবং এটি দিয়েতের (জাপানের পার্লামেন্টের নাম ‘দিয়েত’) বিতর্কে টিকবে না।

ইশিবা নিজেকে নিরাপত্তাবিশেষজ্ঞ হিসেবে উপস্থাপন করলেও কিছু মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে তাঁর খামতি আছে বলে মনে হয়। যখন তাঁর এই খামতি ও ত্রুটিগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠবে, তখন তাঁর জনসমর্থন পড়ে যাবে।

ন্যাটোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো তার পারস্পরিক প্রতিরক্ষা–নিশ্চয়তা। ওই নিশ্চয়তার শর্তে ন্যাটোর যেকোনো একটি সদস্যরাষ্ট্রের ওপর আক্রমণ এলে ন্যাটোর প্রতিটি দেশ সেটিকে নিজের ওপর আক্রমণ হিসেবে গণ্য করে থাকে।

আত্মরক্ষার অধিকারকে সমষ্টিগত করে তুললে প্রতিরোধক্ষমতা সর্বোচ্চ হয়ে থাকে।

শিনজো আবের নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে জাপান ২০১৫ সালের দিকে আংশিকভাবে আত্মরক্ষার সমষ্টিকরণ অর্জন করেছিল। কিন্তু সামরিক দিকে ঝুঁকে পড়ার বিষয়ে দেশের ভেতর থেকে সে সময় বিরোধী দলগুলোর দিক থেকে আবে প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত শুধু জাপানের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়লে আত্মরক্ষার সমষ্টিকরণের দিকে যাওয়া যেতে পারে—এ প্রস্তাবে সবার মত পাওয়া গিয়েছিল।

এশিয়ান ন্যাটোর প্রস্তাবে বলা আছে, যদি ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ আক্রান্ত হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক সহায়তা দিতে জাপানকে প্রস্তুত ও সক্ষম হতে হবে। একইভাবে যদি চীনের নৌবাহিনীর সঙ্গে সম্ভাব্য সদস্যরাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়া সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে জাপানকে সমষ্টিগত আত্মরক্ষার কাজে এগিয়ে আসতে হবে।

সম্ভবত ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততাকে আরও দৃঢ়ভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়াই ইশিবার প্রধান উদ্দেশ্য।

সে ক্ষেত্রে ইশিবাকে প্রমাণ করতে হবে, কীভাবে একটি এশিয়ান ন্যাটো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য লাভজনক হবে। এখন পর্যন্ত এটিকে অত্যন্ত অসম্ভাব্য বলে মনে হচ্ছে।

এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সম্মুখ বাহিনীর বৃহত্তম অংশে (বিশেষ করে ওকিনাওয়াতে) জাপান সহায়তা দিচ্ছে। এই বাহিনী নিয়মিত অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের সঙ্গে যৌথ মহড়া দিয়ে থাকে, যাতে চীনকে সামরিক অভিযানের চড়া মূল্যের বিষয়ে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যায়।

তবে ইশিবার প্রস্তাবিত এশিয়ান ন্যাটো বর্তমানের এই ব্যবস্থার তুলনায় খুব একটা পরিবর্তন আনতে পারবে না, উল্টো ইশিবার প্রস্তাব আরেকটি গুরুতর সমস্যা ডেকে আনবে। সেটি হলো তাইওয়ান।

এখন তাইওয়ান যদি চীনের কমিউনিস্ট শাসনের অধীন চলে যায়, তাহলে জাপানের কৌশলগত পরিসর মানসিক, সামরিক ও বাণিজ্যিকভাবে সংকুচিত হয়ে পড়বে।

তখন সবার কাছে মনে হবে, যে ‘আত্মরক্ষার সমষ্টিকরণ’ তাইওয়ানের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারে না, তার আদতে কোনো দাম নেই।

তাইওয়ানের নিরাপত্তায় সরাসরি আগ্রহী দেশগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ফিলিপাইন। অন্য দেশগুলো কি এমন একটি এশিয়ান ন্যাটোতে যোগ দিতে চাইবে, যার প্রধান প্রতিরক্ষাবিন্দু তাইওয়ান? সে সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

তারপর আছে ভারতের প্রশ্ন। শিনজো আবে যখন ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে কোয়াডে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, তখন তিনি জানতেন, চীনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে থাকা ভারত তার দীর্ঘদিনের মিত্র রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায়।

কোয়াডে যোগ দেওয়া সত্ত্বেও ভারত সম্ভবত একটি এশিয়ান ন্যাটোতে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানাবে। কারণ, মস্কোর সঙ্গে দিল্লি তার সম্পর্ককে ঝুঁকিতে ফেলতে চায় না। এ বিষয়ে ভারতকে পরীক্ষার মধ্যে ফেলা জাপানের উচিতও হবে না।

ইশিবার রাজনৈতিক সম্ভাবনা তাঁর কর বাড়ানোর আহ্বানের কারণে আরও ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। তিনি মনে করেন, ব্যক্তিগত ও করপোরেট উভয় ক্ষেত্রেই আয়কর বাড়ানোর সুযোগ আছে। তিনি মূলধন লাভের ওপর করারোপের ব্যাপারেও আগ্রহী।

এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠতে পারে, ইশিবা কি সত্যিই বিশ্বাস করেন, কর বাড়ানোকে সমর্থন করা একটি প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে তিনি নির্বাচনে জিততে পারবেন?

এলডিপির আসন্ন নির্বাচনে জয়ের প্রয়োজনই ইশিবাকে বেছে নেওয়ার প্রধান কারণ। হাউস অব কাউন্সিলরস (পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ) প্রতি তিন বছরে এর অর্ধেক আসন নবায়ন করে। এই উচ্চকক্ষের পরবর্তী নির্বাচন ২০২৫ সালের জুলাইয়ে নির্ধারিত রযেছে।

হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের (নিম্নকক্ষ) বর্তমান মেয়াদ ২০২৫ সালের অক্টোবরে শেষ হবে।

সাধারণ জ্ঞান খাটিয়ে বোঝা যায়, একটি প্রশাসন সবচেয়ে রাজনৈতিক সুবিধা ভোগ করে শাসনের শুরুর দিকে। অর্থাৎ শুরুতে যেকোনো সরকার সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা খাটানোর সুযোগ পেয়ে থাকে। ইশিবা সম্ভবত এ সুযোগ ব্যবহার করে নিম্নকক্ষটি ভেঙে দিয়ে সাধারণ নির্বাচনের ডাক দেবেন, যাতে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে তাঁর সরকারকে শক্তিশালী করতে পারেন। যদি তিনি সামনের মাসগুলোয় নিম্নকক্ষ ভেঙে দিতে ব্যর্থ হন, তাহলে তিনি সম্ভবত উভয় কক্ষের জন্য আগামী জুলাইয়ে নির্বাচন দিতে পারেন।

অবশ্য ইশিবার কপাল ভালো, জাপানের অর্থনীতি খারাপ অবস্থায় নেই। জিডিপি সর্বকালের সর্বোচ্চ অবস্থায় আছে। কর রাজস্বও রেকর্ড পরিমাণ এসেছে। তবে বেসরকারি খাতের চাহিদা সম্পূর্ণরূপে পূরণ সম্ভব হয়নি। তাই এখন কর বাড়ানোর উপযুক্ত সময় নয়; বরং কর কমানো উচিত। এর কারণ, খুব কম দলই কর বাড়িয়ে নির্বাচনে জিততে পেরেছে।

ইশিবার রাজনৈতিক দীর্ঘায়ু নিয়ে সন্দেহ দেখা দেওয়ার তৃতীয় প্রধান কারণ হলো তাঁর প্রতি সরকার গঠনের সঙ্গে সম্পর্কিত নেতাদের আনুগত্যের ঘাটতি।

ইতিহাস থেকে দেখা গেছে, যখন জাপানের কোনো সরকার স্বল্পস্থায়ী হয় বা সরকারের পতন ঘটে, তখন তার পেছনে সাধারণত মন্ত্রিসভার সদস্যদের দুর্নীতি বা কেলেঙ্কারির কিংবা কান্তেই (প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন) সংশ্লিষ্টদের বিশ্বাসঘাতকতা কাজ করে। সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ব্যর্থ হলে সরকার পড়ে যায়।

ইশিবা এর আগে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছিলেন। আমি সে মন্ত্রণালয়ের অনেক বেসামরিক কর্মকর্তাকে চিনি এবং আমি ‘আত্মরক্ষা বাহিনী’র শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গেও পরিচিত।

ইশিবা প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে কেমন ছিলেন—এমন প্রশ্ন করার পর তাঁরা যখন প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, তখন দেখেছি, তাঁরা স্পষ্ট কোনো উত্তর দেন না; প্রতিবারই তাঁরা কপালে ভাঁজ ফেলেন।

প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব প্রতিরক্ষামন্ত্রীর চেয়ে অনেক বেশি কঠিন। তাঁর কাজের প্রায় ৯৯ শতাংশই বিপর্যয় মোকাবিলা করা–সংশ্লিষ্ট কাজ। আর যেকোনো নতুন উদ্যোগ তখনই বাস্তবায়িত হয়, যখন সেগুলো বাজেট বরাদ্দ ও আইনগত দিক থেকে সমর্থন পায়। ইশিবার নতুন উদ্যোগগুলো এই সমর্থন পাবেন বলে মনে হয় না।

জাপান আর স্বল্পস্থায়ী প্রধানমন্ত্রীর যুগে ফিরে যেতে পারে না, যা শিনজো আবের সময়ের আগে দেখা যেত।

দুর্ভাগ্যবশত, ইশিবার নীতিগত অবস্থান ও প্রশ্নবিদ্ধ ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতা কোনো ভালো লক্ষণ দেখাচ্ছে না।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  • তানিগুচি তোমোহিকো সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা, প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের মন্ত্রিসভা।