বিপদ এড়াতে উটপাখি নাকি বালুতে মুখ গুঁজে থাকে। সময়–অসময় বুঝে আমরা ঝুঁকে পড়ি মুঠোফোনের পর্দায়। তবে এমন না যে মুঠোফোন, ল্যাপটপ বা কম্পিউটারে দেশ–বিদেশের বিপদ–আপদের খবর পাওয়া যায় না। যায়। অপতথ্যের ছড়াছড়ির মধ্যেও নিখাদ তথ্য পাওয়া যায় মেলা—মনে দাগ কাটার মতো, হৃদয়ে রক্ত ঝরানোর মতো, চোখ ঝাপসা করে তোলার মতো।
কিন্তু পাশের বাড়িতে লাগা আগুনের আঁচ নিজেদের আঙিনায় অনুভূত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের যেন হুঁশ হয় না। কেউ কেউ আবার সেই আগুনে ‘আলু পুড়িয়ে খাওয়ায়’ ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন।
ভূরাজনীতি, কূটনীতি, ‘অস্ত্রের অর্থনীতি’, পক্ষ–বিপক্ষের সিলসিলা, লাভ-ক্ষতির পাটিগণিত—এ রকম নানা হিসাব–নিকাশে প্রাণহানি তাই স্রেফ ‘পরিসংখ্যানে’ পরিণত হয়। গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার নৃশংসতা, গাজাবাসীর অনিঃশেষ রক্তক্ষয় তার জাজ্বল্য উদাহরণ।
শুধু মালসামান, দরদালান বা রাস্তাঘাটের ধ্বংস নয়, আমজনতার বেঘোর মৃত্যু নয়, যুদ্ধে তো শেষতক পরাজিত হয় আসলে মানবতাই। মাথা হেঁট হয় সভ্যতার। ন্যায়ের পক্ষে, অন্যায্যের প্রতিবাদে কখনো কখনো যুদ্ধে নামা অনিবার্য হয়ে ওঠে বৈকি। কিন্তু যুদ্ধের মূল্য সব দেশ–কালেই পরিশোধ করতে হয় ‘রক্তে’। কার রক্তে? মূলত উলুখাগড়ার। মানে প্রজাসাধারণের, নিরীহ মানুষের। কিন্তু যে শিশুটি রাজা চেনে না, রাজ্যও বোঝে না, এমনকি মায়ের শরীরের ঘ্রাণও ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেনি, তার কেন প্রাণ যাবে যুদ্ধে?
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর বাছবিচারহীন হামলার ১৫ মাসে গাজায় নিহত হয়েছে ১৭ হাজার ৪৯২টি শিশু।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এ হিসাব অনুযায়ী প্রতি ৩০ মিনিটে প্রাণ হারাচ্ছে একটি শিশু। এর বাইরে বিধ্বস্ত বাসাবাড়ি ও স্থাপনার ধ্বংসস্তূপের নিচে কয়েক হাজার শিশু আটকা পড়ে মারা পড়ে থাকতে পারে বলে আশঙ্কা। নিহত শিশুদের মধ্যে ১ হাজার ৯১টির বয়স এক বছরের কম (৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত)। তাদের মধ্যে ২৩৮ জনের জন্মই হয়েছিল যুদ্ধের সময়। অর্থাৎ গুলি–বোমার ভয়াবহতা, অসহায় মানুষের আর্তনাদ–আহাজারির মধ্যে পৃথিবীতে এসেছিল তারা, একইভাবে ‘জল্লাদের উল্লাসের’ মধ্যে তারা বিদায় নিয়েছে।
‘নবজাতকের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবীর’ কথা কবির মুখে উচ্চারিত হয়েছে বটে, কিন্তু এ অঙ্গীকার তো আসলে সভ্যতারই প্রথম সোপান। তাহলে ইসরায়েলের বিরামহীন হামলায় প্রতিদিন গড়ে শত ফিলিস্তিনির মৃত্যুর পরও কোথাও কোনো ‘কলরব’ নেই কেন!
কলরব দূরের কথা, নিদেনপক্ষে প্রতিকারের ন্যূনতম আন্তরিক প্রচেষ্টাও যে দৃশ্যমান নয়, বরং বিষয়টি নিয়ে বিশ্বের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা যে স্পষ্ট, তা আরেক দফায় প্রমাণিত হলো ৩ জানুয়ারি, জাতিসংঘে।
প্রতিটি মৃত্যুর পেছনে থাকে স্বজনের শোক, সম্পর্কের সুতা ছিঁড়ে যাওয়ার বেদনা—যা তাঁদের আমৃত্যু বয়ে বেড়াতে হয়। আর যিনি চলে গেলেন, তাঁর শেষের কথা কতটা মর্মভেদী হতে পারে, গাজার চিকিৎসক মাহমুদ আবু নুজাইলা আমাদের তাই মনে করিয়ে দিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘যে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে, গল্পটা সে-ই বলবেন। আমরা যতটুকু পেরেছি, করেছি। আমাদের কথা মনে রাখবেন।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোটি প্রাণহানি ও বিপুল ধ্বংসের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে বিজয়ী মিত্রশক্তি আগামী দিনগুলোতে যাতে যুদ্ধ-সংঘাত প্রতিরোধ করা যায়—সেই উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়। ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত ও পরে বিলুপ্ত লিগ অব নেশনসের স্থলাভিষিক্ত হয় বৈশ্বিক এই প্রতিষ্ঠান।
‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ বাধেনি বটে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের নানা প্রান্তে প্রাণ হারানো ‘উলুখাগড়া’র সংখ্যাও কিন্তু লাখ লাখ। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমাদের এক ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের’ বলি অন্তত ৪৫ লাখ মানুষ।
প্রতিটি মৃত্যুর পেছনে থাকে স্বজনের শোক, সম্পর্কের সুতা ছিঁড়ে যাওয়ার বেদনা—যা তাঁদের আমৃত্যু বয়ে বেড়াতে হয়। আর যিনি চলে গেলেন, তাঁর শেষের কথা কতটা মর্মভেদী হতে পারে, গাজার চিকিৎসক মাহমুদ আবু নুজাইলা আমাদের তাই মনে করিয়ে দিলেন।
তিনি লিখেছিলেন, ‘যে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে, গল্পটা সে-ই বলবেন। আমরা যতটুকু পেরেছি, করেছি। আমাদের কথা মনে রাখবেন।’
গাজার আল আওদা হাসপাতালের যে বোর্ডে তিনি কথাগুলো লিখেছিলেন, সেখানে সাধারণত রোগীর অস্ত্রোপচার কীভাবে করা হয়, তার বিবরণ থাকত। ইসরায়েলের বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন আবু নুজাইলা।
তাঁর কথাকটি ৩ জানুয়ারি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পড়ে শোনান জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের প্রতিনিধি রিয়াদ মনসুর। তিনি অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি; কাঁদতে কাঁদতে গাজায় ইসরায়েলের জাতিগত নিধন (জেনোসাইড) বন্ধে পদক্ষেপ নিতে সবার প্রতি আহ্বান জানান। তাঁর জবানিতে, ‘(গাজায়) এই নরকের অবসান ঘটানোর দায়িত্ব সম্মিলিতভাবে আমাদের। যে জাতিগত নিধন চলছে, তা বন্ধ করার সম্মিলিত দায়িত্ব আমাদের।’
ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইহুদিদের দখলদারত্বের সূচনার মাধ্যমে সাড়ে সাত দশক আগে ফিলিস্তিনিদের ওপর যে বিপর্যয় নেমে আসে, তার শেষ কোথায়? ফি বছর কি শিশু-নারীসহ নিরপরাধ মানুষের বেঘোর মৃত্যুর খতিয়ান, বসতি ধ্বংসের বিবরণ, ভূমি হারানোর হিসাব লিখে যেতে হবে? স্পষ্ট দৃষ্টির কিছু তরুণ-যুবা, বিবেকি মানুষ বা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান তাদের জায়গা থেকে প্রতিবাদ-ধিক্কার জানাচ্ছে বটে।
গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর চলমান নৃশংসতার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধনের অভিযোগ আনা হয়েছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুসহ শীর্ষ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করেছেন আদালত। কিন্তু তাতে কী! মানুষের ‘বিবেকের আদালত’ জাগ্রত না হলে কি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়?
হাসান ইমাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
[email protected]