শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত যেকোনো দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ দুটি বিষয় বেহাত হয়ে গেলে কিংবা বিপন্ন হলে দেশের আর কোনো ক্ষেত্রেই কাঙ্ক্ষিত বিকাশ সম্ভব নয়। দুটি বিষয়ের মধ্যেও শিক্ষার প্রভাব ও ব্যাপকতা অত্যন্ত বিস্তৃত। শিক্ষা এমন একটি বিষয়, যা অন্য সব খাতকে স্পর্শ করে এবং সব অসুবিধা বা সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে একটি দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে পারে।
এসব কারণে উন্নত দেশগুলোও ইউনিসেফের পরামর্শ অনুযায়ী দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপির ৬ শতাংশের বেশি শিক্ষা খাতে ব্যয় বা বিনিয়োগ করছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোও তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে ওপরের দিকে রয়েছে মার্শাল আইল্যান্ডস (১৫ দশমিক ৮ শতাংশ) ও কিউবা (১২ দশমিক ৯ শতাংশ)।
শিক্ষা খাতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভুটানের বিনিয়োগ ৬ দশমিক ৬ শতাংশ, আফগানিস্তানের ৪ দশমিক ১ এবং ভারত ও পাকিস্তান বরাদ্দ দেয় ২ দশমিক ৯ শতাংশ। শিক্ষা খাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এদের সবার চেয়ে নিচে।
গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) ছিল ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। বিদায়ী অর্থবছরে (২০২৩-২৪) তা ১ দশমিক ৭৬ শতাংশে নেমে এসেছে।
শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের চেয়ে কম বরাদ্দ দেয়, এ রকম দেশও রয়েছে। যেমন দক্ষিণ সুদান (১ দশমিক ৫ শতাংশ) ও জাম্বিয়া (১ দশমিক ৩ শতাংশ)। আমাদের অবস্থান এই দুই দেশের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো—এটা কি আত্মতুষ্টির কোনো বিষয় হতে পারে?
বাংলাদেশের ঘোষিত লক্ষ্য হলো ‘রূপকল্প ২০৪১’, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া এবং চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলা করা। এর ফলে বিভিন্ন মহল থেকে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এমনকি সরকারি পরিকল্পনাতেও শিক্ষা খাতে কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলা হয়েছিল। এরপরও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমানো কি শিক্ষা খাতের প্রতি উদাসীনতার পরিচায়ক নয়?
শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কম দেওয়া হয়েছে, শুধু তা-ই নয়। যেটুকু বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, সেটাও যথাযথভাবে ব্যয় করা হয়নি। এর পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে অপব্যয় করা হয়েছে—এমনটা প্রতীয়মান হয়েছে।
প্রায় একই রকম উদাহরণ রয়েছে স্বাস্থ্য খাতেও। করোনা মহামারির বাস্তবতায় ২০২১ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে ১০০ কোটি টাকা গবেষণার জন্য অতিরিক্ত বরাদ্দ রাখা হয়েছিল।
দুর্ভাগ্যবশত সেখান থেকে একটি টাকাও খরচ করা সম্ভব হয়নি। বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ না হওয়া আসলে কী প্রমাণ করে? আমরা কি এমন উচ্চতায় পৌঁছে গেছি যে স্বাস্থ্য খাতে গবেষণার কোনো প্রয়োজন নেই! পরে অবশ্য জানা গেছে, যোগ্য গবেষকের এভাবে নয়, বরং আমলাতান্ত্রিক জটিলতাই ছিল অর্থ ব্যয় না হওয়ার কারণ।
শিক্ষার মতো স্বাস্থ্য খাতেও গত বাজেটে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষা বা স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত কোনো সংগঠনের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে তেমন কোনো দাবি বা অভিযোগও শোনা যায়নি। তার মানে, সত্যিই কি আমাদের এর বেশি প্রয়োজন নেই?
শিক্ষা খাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ না হলে যেমন সমাজে বেকারত্ব ও অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পায়, তেমনি স্বাস্থ্য খাতে অপ্রতুল বিনিয়োগের ফলাফল যে কী হতে পারে, তা আমরা করোনা মহামারি ও ডেঙ্গুর প্রকোপের সময় চরমভাবে উপলব্ধি করেছি।
শিক্ষার বিনিয়োগের অভাবের ফলাফল বা পরিণতি সর্বত্র প্রতিফলিত হয়। দেশের যত সমস্যা, তার মূল কারণ গুণগত ও প্রয়োজনীয় শিক্ষার অভাব। বহুধাবিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থা ও অপরিকল্পিত শিক্ষা কারিকুলাম এসব সমস্যাকে আরও ঘনীভূত করে।
দেশে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বিদ্যমান রুগ্ণ দশা শিগগির কাটবে, সেই আশা বাস্তবসম্মত নয়। এর জন্য দরকার শিক্ষায় যথাযথ বিনিয়োগ, অন্তত জিডিপির ৬ শতাংশ। এর পাশাপাশি যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, বাজেটের সদ্ব্যবহার, প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন ও সংস্কার। বাজেট প্রণয়নে সর্বাগ্রে বিবেচনায় রাখতে হবে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ছাড়া অর্থনীতি ও সমাজের সুস্থ থাকা সম্ভব নয়।
সরকারের ধারাবাহিকতা থাকলেও এ বছর নতুন মন্ত্রিসভা দায়িত্ব নিয়েছে। আলোচিত দুই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও আছেন নতুন দুজন মন্ত্রী। তাঁদের কাছে আমাদের প্রত্যাশাও অনেক। আশা করি আসন্ন বাজেটে সেটার প্রতিফলন ঘটবে।
ড. আলাউদ্দিন অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।