চাঁদে গিয়েছে ভারত, তাতে আমাদের কী?

চন্দ্রযান–৩–এর মহাকাশ যাত্রার ক্ষণ
ছবি: এএফপি

চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণের মধ্য দিয়ে নতুন ইতিহাস রচনা করেছে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো) চন্দ্রযান-৩-এর অবতরণের দৃশ্য সরাসরি দেখেছে সেই দেশের কোটি কোটি মানুষ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে উৎসাহের বার্তা দিতে খোলা ছিল স্কুল।

ভারতের এই সাফল্যে সেই দেশের নাগরিকদের পাশাপাশি আনন্দের উচ্ছ্বাসে ভেসেছে বাংলাদেশের মানুষ। অনেকে ভাবতে শুরু করেছে, এই অর্জন আমাদেরও। তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে সব মাধ্যমে অভিনন্দনের স্রোত বয়ে যাচ্ছে।

অনেকেই আবার ভারতের এই অর্জনে নিজের দেশ কেন এগিয়ে যাচ্ছে না তা বোঝর জন্য বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান (স্পারসো) ওয়েবসাইট ঘুরে বেড়িয়েছে। ক্ষোভ ঝাড়ছে, কেন আমাদের প্রতিষ্ঠান এই ধরনের রকেট উড্ডয়ন করতে পারে না। ভারত পারলে কেন আমরা পারি না? তাদের জিডিপির চেয়ে আমাদের জিডিপি তো কম নয়? তাদের বিভিন্ন প্রদেশে নাগরিকেরা ভাতের অভাবে থাকলেও আমাদের তো মঙ্গা অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে, তাহলে আমরা কেন পারছি না?

যৌক্তিক কারণে এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে সরকারের দায়িত্বশীল কেউ যদি আর দশটা ঘটনার মতো বলেই ফেলে, চাঁদে ভারত গিয়েছে, তাতে আমাদের কী? তাহলে সেখানে মন খারাপের কিছু নেই। কারণ, এই দেশের সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের অনেকেই মনে করেন, বিজ্ঞান গবেষণায় কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালার চেয়ে ছোট যমুনা নদীতে একটি সেতু তৈরি করা শ্রেয় কিংবা শহর-গ্রামের রাস্তাঘাট তৈরি করলেই দেশ এগিয়ে যাবে।

ঠিক এই সব ভ্রান্ত ধারণার কারণে আজকে আমাদের প্রতিবেশী দেশের চন্দ্রাভিযানে পুলকিত হতে হয়। বিজ্ঞান গবেষণায় কিছু পাওয়া যায় না ধরে নিয়ে এই দেশের বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘প্যারালাইজড’ করার জন্য আইনপ্রণেতা কিংবা সরকারের অদূরদর্শী ভাবনাই যথেষ্ট।

বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটটি যদি আপনার ঘুরে আসা সম্ভব হয়, তাহলে দেখবেন এই ওয়েবসাইটজুড়ে মহাকাশবিষয়ক কোনো চিত্র, গ্রাফিকস, মহাকাশবিষয়ক কোনো গল্প-প্রতিবেদন খুঁজে পাবেন না। এমনকি মহাকাশ নিয়ে তাঁদের যে কর্মপরিকল্পনা, সেখানেও আপনি মহাকাশের বিশদ তথ্য পাবেন না। বরং কোনো কর্মকর্তা বা তাঁদের সন্তানাদিদের পাসপোর্ট করতে অনাপত্তি (এনওসি) লাগবে, তা নোটিশ বোর্ডে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান বা স্পারসো তাদের পরিচিতিতে স্পষ্ট উল্লেখ করেছে কৃষি, বন, মৎস্য, ভূতত্ত্ব, মানচিত্র অঙ্কন, পানি সম্পদ, ভূমি ব্যবহার, আবহাওয়া, পরিবেশ, ভূগোল, সমুদ্র বিজ্ঞান, শিক্ষা এবং জ্ঞান ও বিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রে মহাকাশ ও দূর অনুধাবন প্রযুক্তিকে শান্তিপূর্ণভাবে ব্যবহার করা এবং ওই প্রযুক্তির উন্নয়ন ও ব্যবহারিক প্রয়োগের জন্য গবেষণাকাজ পরিচালনা করা। যে প্রতিষ্ঠান আর দশটি মন্ত্রণালয়ের কাজও করে যাচ্ছে, সেখানে মূল কাজ থেকে বিয়োজিত হবে এটাই স্বাভাবিক।

আরও পড়ুন

ব্রিটিশ সিনেমা পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান বছর দশেক আগে ইন্টারস্টেলার নামে একটি সিনেমায় ১৬৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে নাসা কিংবা মহাকাশের গল্প দর্শকদের সামনে এনেছিলেন। অথচ তাঁর অর্ধেক, প্রায় ৭৫ মিলিয়ন খরচ করে সত্যিকারের চাঁদে পৌঁছানোর ইতিহাস রচনা করেন। কয়েক বছর আগে এই ধরনের একটি মিশন ব্যর্থ হওয়ার পরও সেই দেশের সরকার লগ্নি করেছে। কারণ, তারা জানে বিজ্ঞানে নিজেদের অস্তিত্ব টিকে রাখতে হলে গবেষণার কোনো বিকল্প পথ নেই।

এখন যদি আপনি আমাদের স্পারসোর গত তিন অর্থবছরের প্রকল্প বাজেট দেখেন, তাহলে তিন কোটি অর্থ খুঁজে পাবেন না। অথচ কয়েক দিন আগে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় খবর বের হয়েছে যে এক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এক বিলিয়ন ডলার দেশ থেকে বিদেশে পাঠিয়েছে।

আবার কেউ কেউ ২২ হাজার কোটি টাকা সরকারি ব্যাংক থেকে জোর করেই নিয়ে ফেলছে। এই ২২ হাজার কোটি টাকা দিয়ে ভারতের মতো প্রায় ৩০টি  চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডার ‘বিক্রম’ তৈরি করা সম্ভব হতো। সুতরাং টাকা নেই ছুতোতে গবেষণা বাজেট হয় না, তা সঠিক নয়।

অন্যদিকে আপনি যদি বিবেচনায় নেন যে সরকার মহাকাশ গবেষণায় টাকা ঢালবে, তাহলে এখন প্রশ্ন উঠবে এই টাকা দিয়ে ঠিক কারা গবেষণাকর্ম করবে? প্রায় ত্রিশের অধিক জনবল নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটি যে ‘বিস্ময়কর’ গবেষণা করে যাচ্ছে, তাদের প্রোফাইল খুঁজে দেখুন, তারা আদৌ কয়েক কোটি টাকা মহাকাশ বা রকেট তৈরির জ্ঞান রাখে কি না, সন্দেহ আছে।

সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, প্রতিষ্ঠানটির প্রধানেরা যাঁরা হয়েছেন বা আছেন, তাঁরা আদৌ মহাকাশ, গতি, রকেট সায়েন্সবিষয়ক জ্ঞান রাখেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধানের যোগ্যতায় যখন ফিট হয় না, তখন তাঁর দ্বারা রকেট সায়েন্স বোঝা দুষ্কর হবে, এটাই স্বাভাবিক।

আপনি যদি আমাদের স্পারসো আর ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো) শুধু দায়িত্বশীল প্রধানদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও মহাকাশবিষয়ক গবেষণার অভিজ্ঞতা আমলে নেন, তাহলেই দেখতে পাবেন আসলে কেন আমরা চাঁদ কিংবা মঙ্গল গ্রহের গবেষণায় এখনো আঁতুড়ঘরে রয়েছি।

যে প্রতিষ্ঠানের বসই নড়বড়ে, সেই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা যে শক্তিশালী হয়ে যাবেন, তাতে ভাবার কোনো কারণ নেই। আগে বিজ্ঞান গবেষণার মাহাত্ম্য বুঝতে হবে, কেন আমরা গবেষণায় লগ্নি করব, তার রোডম্যাপ সরকারকে বুঝতে হবে। নতুবা আমলাদের কাঁধে বিজ্ঞানের কলকাঠি সুখকর হয়ে উঠতে পারে না।

এই যে দুটি তালিকা দেখে আপনাকে বুঝে নিতে হবে, আপনার সক্ষমতার পরিধি। কার কাঁধে কতটুকু ওজন বহনের সক্ষমতা রয়েছে, তা যেমন শারীরিক গঠন ও সুস্থতা দেখে অনুধাবন করা যায়, তেমনি এই ধরনের তালিকা দেখলে বুঝে নিতে হবে, আপনার দৌড় কতটুকু।

১৯৬৩ সাল থেকে গত ৬০ বছরে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার চেয়ারম্যান এসেছেন মাত্র ১০ জন আর আমাদের দেশে হয়েছেন ২৬ জন। তাদের ১০ চেয়ারম্যানের প্রোফাইলের নামের আগে ‘ড.’ লেখার যোগ্যতা হয়েছে। এই সব চেয়ারম্যান কিসের জোরে ক্ষমতায় গেছেন, তা একেকজনের প্রোফাইল দেখলেই টের পেয়ে যাবেন।

সম্ভবত ভারতকে অনুসরণ করেই ১৯৮০ সাল থেকে ২০০৩ পর্যন্ত বাংলাদেশেও ‘ডক্টরেট’ উপাধিদের স্থান দিয়েছিল, কিন্তু এর পর থেকে সেই শৃঙ্খল ভেঙে ‘জনাব’রা দায়িত্ব নিয়েছেন। আর ওয়েবসাইটে আমাদের এই জনাবদের প্রোফাইল জানার সুযোগ দেয়নি। এই জনাবদের দৌরাত্ম্যে মহাকাশ গবেষণা আজ চাঁদের মতোই অধরা।

খোঁজ নিয়ে দেখেন, চলতি অর্থবছর ৮৭ লাখ ৯৫ হাজার টাকার যে বার্ষিক গবেষণা হচ্ছে, সেখানে কারা কীভাবে কোন বিষয়ে গবেষণা করছে। স্থল নিয়ে গবেষণা করতে কূল পাচ্ছে না, সেখানে মহাকাশ গবেষণা নিয়ে তারা কী করবে শুনি? ‘সায়েন্টিফিক কর্মকর্তা’ আর সায়েন্টিস্টের মধ্যে যে যোজন-যোজন তফাত রয়েছে, তা যারা চার দশকে অনুধাবন করেনি, তখন চাঁদের, মঙ্গলের পানি, মাটি নিয়ে গবেষণার সুযোগ পাবে কোথায়? তারা তো এখনো স্থল গবেষণায় কুলিয়ে উঠতে পারেনি, তখন চাঁদ নিয়ে ভাবনা বড়ই বেমানান।

চন্দ্রাভিযানে যা হয় হোক, তবে আমাদের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে বের না হলে অন্যের মধুচন্দ্রিমায় পুলকিত হতে হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

যে প্রতিষ্ঠানের বসই নড়বড়ে, সেই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা যে শক্তিশালী হয়ে যাবেন, তাতে ভাবার কোনো কারণ নেই। আগে বিজ্ঞান গবেষণার মাহাত্ম্য বুঝতে হবে, কেন আমরা গবেষণায় লগ্নি করব, তার রোডম্যাপ সরকারকে বুঝতে হবে। নতুবা আমলাদের কাঁধে বিজ্ঞানের কলকাঠি সুখকর হয়ে উঠতে পারে না। বিজ্ঞানে কারা কোথায় দায়িত্বে থাকবেন, তা কেবল ওই ফিল্ডের বিশেষজ্ঞরাই যোগ্যতার বলয়ে আসীন থাকবেন। সেটি না হলে এই রকম হ-য-ব-র-ল আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক বিজ্ঞান কাঠামো ভেঙে পড়বে।

সময় থাকতে সচেতন হওয়া জরুরি। আজ ভারত যে সাফল্যে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়ে দিয়েছে, সেই জায়গায় নিজেদের দেখতে হলে আরও ৫০ কিংবা তার বেশি বছরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আর এভাবে চলতে থাকলে স্পারসোকে সত্যিকার অর্থে মহাকাশেই হারিয়ে ফেলতে হবে।

  • ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই-মেইল: [email protected]