ফারদিন: খুন নাকি আত্মহত্যা—কোন তত্ত্ব বিশ্বাস করব?

ফারদিন নূর
ফাইল ছবি

বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশের মৃত্যু নিয়ে একের পর এক নানা ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে পুলিশ ও র‌্যাবের কাছ থেকে।

বলাবাহুল্য, ক্রমাগত নতুন নতুন ভাষ্য আসায় জনমনে অনাস্থা ও অবিশ্বাস তৈরি হয়। ফারদিনের পরিবারও বিশ্বাস করেনি ‘আত্মহত্যার’ কাহিনি। শুরু থেকেই পুলিশ ও র‌্যাবের তদন্তে নানা অসংগতি লক্ষ করা গেছে। এর ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গোয়েন্দা কার্যক্রমের ওপর জনসাধারণের বিশ্বাস টলে যাচ্ছে।

ফারদিনের নিখোঁজ হওয়া থেকে আত্মহত্যা চিহ্নিত করা—পুরো  ঘটনাপ্রবাহের বিশ্লেষণ করলে নানা অসংগতি দেখা যাবে। ফারদিন নিখোঁজ হন গত ৪ নভেম্বর। নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ৭ নভেম্বর তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ গণমাধ্যমকর্মীদের জানিয়েছেন, হতাশা ও আর্থিক চাপের কারণে ফারদিন আত্মহনন করেছেন। র‌্যাবও একই কারণ জানিয়েছে। হারুন অর রশীদ বলেছেন, ফারদিনের পরীক্ষার ফল খারাপ হচ্ছিল ক্রমাগত। এ নিয়ে তাঁর মধ্যে হতাশা ভর করে। এর পাশাপাশি তাঁর স্পেনে একটি বিতর্ক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার খরচ সংস্থান হয়নি। তাঁর ৬০ হাজার টাকার প্রয়োজন ছিল। বন্ধুরা ৪০ হাজার দিলেও ২০ হাজার টাকার ঘাটতি থেকে যায়। এর পাশাপাশি দুই ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন ফারদিন। তিনি হলে থাকতে চাইতেন। কিন্তু পরিবার তাঁকে সেখানে থাকতে দিতে চায়নি, এ নিয়েও চাপ ছিল। সব মিলিয়ে প্রচণ্ড রকম মানসিক চাপ নিয়ে তিনি উদ্‌ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ান এবং অবশেষে আত্মহত্যা করেন।

ডিবিপ্রধানের বক্তব্য পড়ে মনে হবে, তিনি ফারদিন সম্পর্কে যথেষ্ট খোঁজ নিয়েই এসব বলেছেন। ফারদিনের ‘পকেটের’ তথ্যই না শুধু, তিনি পরিবারের হাঁড়ির খবরও দিয়েছেন। ফারদিন কী ধরনের গান শুনতেন, কোন কোন দার্শনিকের লেখা পড়তেন—সেসবও বলে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি একটি তথ্য এড়িয়ে গিয়েছেন বা জানতে পারেননি; তা হচ্ছে ফারদিন বুয়েট ক্যাম্পাসের এক প্রতিবাদী চরিত্র ছিলেন। আবরার হত্যার প্রতিবাদে সব সময়ই সরব ছিলেন। এ বিষয়ে একটি ফেসবুক পেজ পরিচালনা করতেন তিনি। এ ছাড়া ক্যাম্পাসে পুনরায় ছাত্ররাজনীতি শুরু করার বিরুদ্ধে সরব ছিলেন তিনি। ডিবিপ্রধান এসব বিষয়ে খোঁজ নিয়ে কথা বললে তাঁর বক্তব্য আরও বিশ্বাসযোগ্য হতো।

ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের আর্থিক সংকট থাকে। কিন্তু বুয়েট ও ঢাকা মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে ডিবিপ্রধানের মনে হয় সম্যক ধারণা নেই। ঢাকা শহরের প্রাইভেট টিউশন, কোচিং সেন্টারগুলোতে একচেটিয়াভাবে কাজ করেন বুয়েট ও ঢাকা মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা। বুয়েটের শিক্ষার্থী হিসেবে ফারদিনের আর্থিক সংকট খুব বেশি থাকার কথা নয়। ডিবিপ্রধান নিজেই বলেছেন, ফারদিন চারটি টিউশনি করতেন।

একটি টিউশনে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা কী পরিমাণ আয় করেন, এ বিষয়ে ডিবিপ্রধানের সম্ভবত বাস্তব ধারণা নেই। বুয়েটের অনেক শিক্ষার্থীর মাসিক আয় অনেক সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশ কর্মকর্তার মাসিক বেতনের কাছাকাছি। মনে হচ্ছে, পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না নিয়েই ডিবিপ্রধান আত্মহত্যার কারণ সামনে এনেছেন। এ জন্য তিনি ফারদিনের মানসিক চাপ ও আর্থিক দুরবস্থাকে উল্লেখ করেছেন। বস্তুত ফারদিনের নিখোঁজ হওয়া ও মৃতদেহ উদ্ধার করা নিয়ে র‌্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দারা কখনোই গোছানো তথ্য দিতে পারেনি।

ফারদিনের মৃত্যু নিয়ে রহস্য রয়েই গেছে। প্রেমিকা, মাদক ব্যবসায়ী, আত্মহত্যা—সম্ভাব্য সব বিষয়ই পুলিশ ও র‌্যাব সামনে এনেছে। র‌্যাব ও পুলিশের কোনো দাবিকেই আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি না। এর মধ্যে সত্য থাকতে পারে, আবার না-ও থাকতে পারে। কিন্তু  র‍্যাব ও পুলিশ ঘন ঘন ভাষ্য পরিবর্তন করায় জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কি কিছু লুকাতে চাইছে?

লাশ পাওয়ার পর ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক প্রাথমিকভাবে জানান, ফারদিনের মাথা ও বুকে আঘাতের চিহ্ন আছে। দৃশ্যপটে ফারদিনের বন্ধু আয়াতুল্লাহ বুশরার নামও আসে। পুলিশ জানায় ৪ নভেম্বর ফারদিনকে বন্ধু বুশরার সঙ্গে রিকশায় করে রামপুরায় ঘুরতে দেখা গেছে। এর ফলে সন্দেহের তির বুশরার দিকে ঘুরে যায়। এর মধ্যে আবার নারায়ণগঞ্জের চনপাড়া বস্তিতে র‌্যাবের গুলিতে নিহত হন ২৩ মামলার ফেরারি আসামি শাহীন মিয়া ওরফে সিটি শাহীন।

শাহীন র‌্যাবের গুলিতে নিহত হওয়ার পর এবার মাদকের বিষয়টি সামনে আসে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষ্যে কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ৪ নভেম্বর রাতে ফারদিনকে চনপাড়া বস্তিতে হত্যা করা হয়। ফারদিন সেখানে মাদক কিনতে গিয়ে বিক্রেতাদের সঙ্গে বচসায় লিপ্ত হলে তাঁকে পিটিয়ে মারা হয়। এর আগে ফারদিন মাদকের সন্ধানে হন্যে হয়ে বাবুবাজার ব্রিজ থেকে শুরু করে পুরান ঢাকার জনসন রোড হয়ে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে চনপাড়া বস্তিতে যান। মাদক-সম্পৃক্ততার পাশাপাশি বুশরাকে রিমান্ডে নেওয়া হয়। তবে মাদকের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসার পর ১২ নভেম্বর পুলিশ জানায়, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বুশরার কোনো সংযোগ নেই। অন্যদিকে ফারদিনের মরদেহ উদ্ধারের পর আরও একটি মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ জানায় এর সঙ্গে ফারদিন হত্যার যোগসূত্র থাকতে পারে।

আরও পড়ুন

এসব ঘটনার মধ্যেই দৃশ্যপটে চলে আসে র‌্যাব। র‌্যাব চনপাড়া থেকে ১৩ নভেম্বর রায়হান মাহমুদ, উজ্জ্বল, রনি ও নুরুজ্জামান নামের চারজনকে আটক করেছে বলে পরিবারের লোকজন অভিযোগ করেন। আটকের কথা র‌্যাব বা পুলিশ স্বীকার না করলেও ১৪ নভেম্বর র‌্যাব জানায়, রায়হান মাহমুদ গং ফারদিন হত্যায় জড়িত বলে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে। ১৫ নভেম্বর র‌্যাব একই দাবিতে অটল ছিল। এই চারজন মিলেই ফারদিনকে হত্যা করে সিটি শাহীনের সাদা গাড়িতে করে শীতলক্ষ্যা নদীতে নিয়ে ফেলে দেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়।

এ পর্যন্ত ফারদিন খুন হয়েছেন, এমন তথ্যই ছিল। তবে ফারদিনের মৃত্যু খুন থেকে আত্মহত্যায় রূপান্তরিত হওয়ার ক্ষেত্রে আমরা তিনটি ধাপ লক্ষ্য করি। প্রথম ধাপে ২৭ নভেম্বর পুলিশ জানায়, ফারদিনের মৃত্যুরহস্য উন্মোচনে নতুন তত্ত্ব বিবেচনা করা হচ্ছে। পুলিশ ৩ ডিসেম্বর আরেকটু অগ্রসর হয়। এদিন পুলিশ বলে, ফারদিন হত্যার কোনো প্রমাণ তারা পায়নি। পুলিশ জানায়, ফারদিন দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন নাকি আত্মহত্যা করেছেন, সে বিষয়ে অধিকতর তদন্ত করা হচ্ছে। সর্বশেষ ১৪ ডিসেম্বর পুলিশ জানায়, ফারদিন আত্মহত্যা করেছেন। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে খুন থেকে আত্মহত্যায় আসতে দেড় সপ্তাহের মতো সময় লেগেছে।

সময় নিয়ে পুরো ১৮০ ডিগ্রি মোড় নিয়ে খুন থেকে আত্মহননে এসে উপস্থিত হয়েছে পুলিশ ও র‌্যাব। কিন্তু এর মধ্যে নিহত হয়েছেন একজন, জেলে আছেন নারীসহ পাঁচজন। পুরো ঘটনা থেকে আমরা কয়েকটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি। প্রথমত, পুলিশ বা র‌্যাব কোনো তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রকাশ্যে এভাবে বলতে পারে না। এতে বিচার প্রভাবিত হতে পারে। এ বিষয়ে আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। দ্বিতীয়ত, যদি র‌্যাব-পুলিশের সর্বশেষ বক্তব্য সঠিক বলে ধরে নিই, তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পেশাগত দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। একটি আত্মহত্যার রহস্য উন্মোচন করতে তাদের গলদঘর্ম অবস্থা। বিনা অপরাধে পাঁচজনকে আটক করেছে।

একজনকে আবার রিমান্ডেও নিয়েছিল। একে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এই ব্যর্থতার জন্য কারা দায়ী তাদেরকে খুঁজে  বের করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। একই সঙ্গে আটক ব্যক্তিদের মুক্তি ও যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ফারদিন যদি আত্মহত্যাই করে থাকে তবে আটক ব্যক্তিদের এখনো ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে না কেন?

ফারদিনের মৃত্যু নিয়ে রহস্য রয়েই গেছে। প্রেমিকা, মাদক ব্যবসায়ী, আত্মহত্যা—সম্ভাব্য সব বিষয়ই পুলিশ ও র‌্যাব সামনে এনেছে। র‌্যাব ও পুলিশের কোনো দাবিকেই আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি না। এর মধ্যে সত্য থাকতে পারে, আবার না-ও থাকতে পারে। কিন্তু  র‍্যাব ও পুলিশ ঘন ঘন ভাষ্য পরিবর্তন করায় জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কি কিছু লুকাতে চাইছে? তাদের সুবিধা মতো ভাষ্য তৈরি করছে? এসব প্রশ্ন ও সংশয় দূর করার দায়িত্ব তাদেরই।  

  • ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক