বৈদেশিক বাণিজ্যে লেনদেন ভারসাম্যে প্রতিকূল পরিস্থিতি, ক্রমহ্রাসমান প্রবাসী আয়সহ সবকিছু মিলিয়ে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপের মুখে আছে। এ রিজার্ভকে একটি নিরাপদ অবস্থানে রাখার জন্য সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে নানামুখী। এর একটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ধার। এটি একটি স্বীকৃত ব্যবস্থাপনা। আমাদের চেয়ে সবল অর্থনীতির দেশকেও মাঝেমধ্যে এ ধরনের ধার নিতে হয়। আমরাও অতীতে বহুবার নিয়েছি। আর সংস্থাটি সদস্যরাষ্ট্রগুলোর আর্থিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে থাকে। সুতরাং তাদের থেকে ঋণ পেলে অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় ঋণের উৎসগুলো প্রসারিত হয়।
আমাদের অনুরোধে আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছে। নীতি হিসেবেই আইএমএফ তার সদস্যদেশগুলোর সামষ্টিক অর্থনীতির দুর্বল দিকগুলো তুলে ধরে সংস্কারের পরামর্শ দেয়। অতীতেও বিভিন্ন সময়ে আমাদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছে। এবারও দিয়েছে একগুচ্ছ। সেভাবে বলা না হলেও এসব পরামর্শ শর্তের নামান্তর। এসব শর্ত সর্বাংশে প্রতিপালন আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে জুতসই না হলে সরকারের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়। আবার তাদের থেকে ধার পাওয়ার গরজে ক্ষেত্রবিশেষে জনগণের জন্য কষ্টকর শর্তও মেনে নিতে হয়েছে।
অতীতে তাদেরই পরামর্শে আমরা কৃষি থেকে ঢালাওভাবে ভর্তুকি প্রত্যাহার করে আসছিলাম। এতে রাষ্ট্রের বাজেটে কিছুটা সহায়ক পরিবেশ এলেও সার, বীজ, কীটনাশক, সেচ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভর্তুকি হ্রাস কৃষিজীবীদের জন্য পীড়াদায়ক হয়ে পড়ে। ১৯৯৬ সালে পরিবর্তনের পর তখনকার সরকার কৃষি থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহারের বিপরীতে জোরালো অবস্থান নেয়। জনসমর্থিত সে সরকারের অবস্থানকে মেনেও নেয় আইএমএফ। আর সে ভর্তুকির সুফল হিসেবে আমরা অতি দ্রুত চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করি। সাফল্য আসতে থাকে কৃষির অন্যান্য ক্ষেত্রেও।
অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রনির্ভর লোকজনের বিষয়ে যতটুকু সংবেদনশীল হওয়া প্রত্যাশিত, তেমনটা আমরা দেখছি না তাদের কার্যক্রমে। মূলত সঞ্চয়পত্রনির্ভর লোকজন কোনো সংগঠিত জনসমষ্টি নয়। সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের কোনো ক্ষমতাই তঁাদের নেই। নির্বাচনের সময়ে ব্যালটের ব্যবহারে সুযোগও সংকুচিত হয়েছে। সুতরাং আশঙ্কা থাকছে উপেক্ষিত হবে তাঁদের স্বার্থ। কেননা এসব কিছুর মধ্যেও সরকারকে আইএমএফের শর্ত কিছু কিছু পূরণ করতে হবে।
এবার এমনিতর পরিপ্রেক্ষিতে সাড়ে চার বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ প্রস্তাবের বিপরীতে আইএমএফ পর্যালোচনা করে বিভিন্ন চাহিদার বিষয়ে জানান দেয়। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত আছে। সংস্থাটি সদস্যরাষ্ট্রগুলোর আর্থিক ভিতকে জোরালো করতে চায় এ বিষয়ে ভিন্ন মত নেই। তাই তারা মূলত ব্যাংক খাত সংস্কার, খেলাপি ঋণ আদায়সহ যেসব শর্ত সামনে এনেছে, সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে। আরও কিছু শর্তের সঙ্গে তাঁরা সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হারও ব্যাংক সুদের কাছাকাছি নামিয়ে নিতে পরামর্শ দিয়েছেন। বিষয়টি হাজার হাজার আমানতকারীর কাছে শঙ্কার কারণ হিসেবে সামনে এসেছে। সঞ্চয়পত্রনির্ভর জনগোষ্ঠী বিষয়টি নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন। তাঁরা মূলত অবসরজীবী কিংবা কোনো না কোনোভাবে সঞ্চয়পত্রনির্ভর। এমনিতেই গত কয়েক বছরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। মুনাফার ওপর আরোপ করা হচ্ছে ক্রমবর্ধমান হারে আয়কর। কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগের সীমা। এ কারণে কমে গেছে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ। আর তা বিস্ময়করভাবে কম।
গত অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ৩২ হাজার কোটি টাকা ধার নেওয়ার কথা ছিল। প্রথম ৩ মাসে নিয়েছিল ৮ হাজার ৫৫ কোটি টাকা। আর বর্তমান অর্থবছরে প্রস্তাবিত ধার ৩৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু প্রথম ৩ মাসে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭০ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। ফলে এ খাত থেকে সরকারের ঋণ কমে যাওয়ায় সরকারের সুদ ব্যয় কমবে। কিন্তু দেখার থাকে, এসব টাকা যাচ্ছে কোথায়? ব্যাংক খাতে বাধ্য হয়ে কেউ কেউ রাখেন। তবে সে ক্ষেত্রে মুনাফার হার মূল্যস্ফীতির প্রায় অর্ধেক। শেয়ারবাজারে গিয়ে আবার সর্বস্বান্ত হয়ে পড়তে পারেন কেউ কেউ। কিন্তু যাঁরা সঞ্চয়পত্র আঁকড়ে ধরে থাকতে বাধ্য, তাঁদের আয় কমার ধকল কীভাবে পোষাবে, সেটা দুর্বোধ্য। কেউ মূলধন ভাঙাবেন। কেউবা করতে থাকবেন ধারদেনা। আর তাঁদের জীবনযাত্রার মান কমবে, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির সঞ্চয়পত্রনির্ভর হাজার হাজার পরিবার আজ সরকারের করুণার অপেক্ষায়।
গত দুই দশকে ধনিক শ্রেণির সুবিধার্থে বহু ধরনের আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। করোনার জন্যও নানাবিধ প্রণোদনা পেয়েছে তারা। ব্যাংক ব্যবস্থাকেই তাদের একতরফা সুবিধা ভোগের ক্ষেত্র করা হয়েছে। খেলাপির সংজ্ঞা পরিবর্তন হয়েছে বারবার। ঋণ পুনঃ তফসিলের প্রচলিত ব্যবস্থা তাদের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিবর্তিত হয়েছে। অধিকতর সুবিধা দিতে পুনর্গঠন নামক আরেকটি ব্যবস্থা জোরালোভাবে চালু হয়েছে। এমন ব্যবস্থায় ঋণ ফেরতে অতি দীর্ঘমেয়াদি সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এসবের ফলে খেলাপি ঋণ কমবে আশা করা হলেও কার্যত নিষ্ফল প্রমাণিত হয়েছে।
আর বহু বছরব্যাপী পরিশোধের সুবিধাসহ পুনর্গঠিত ঋণের কিস্তিও ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে ঋণগ্রহীতারা অনুদার। সম্ভবত এ ধরনের সুযোগ আরও পাওয়া যাবে এ আশায় গুটিয়ে রেখেছে হাত। ব্যাংক ব্যবস্থার এ বিশৃঙ্খলা বিপন্ন করেছে দেশের আর্থিক খাতকে। আলোচ্য ক্ষেত্রে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান আইএমএফের নজর এ বিষয়ে এড়ায়নি। কিন্তু সরকার কি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারবে এ খাতে? ধনিক শ্রেণি দেশের অপরিহার্য একটি অংশ। সুতরাং তাদের প্রণোদনা দিয়ে টিকিয়ে রাখাকে অযৌক্তিক বলা যাবে না। তবে ঋণখেলাপিদের প্রতি সরকারের নমনীয় আচরণ অর্থনীতির জন্য একটি বড় হুমকি। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমলে ক্ষতি করবে হাজার হাজার কম আয়ের বিনিয়োগকারী পরিবারের।
আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য দুর্নীতির বিরুদ্ধেও নজরে আনার জন্যও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অচিরেই হবে—এমনটাও দৃশ্যমান নয়। এমনকি যারা বিদেশে টাকা পাচার করেছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রেও তেমন জোরালো কোনো পদক্ষেপ নেই সরকারের। রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য আইএমএফের আরেকটি শর্ত অতি যৌক্তিক হলেও এ ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে সরকার ব্যর্থতার ছাপ রাখছেন। করের আওতামুক্ত থেকে যাচ্ছে সমাজের একটি প্রভাবশালী মহল। বরং মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির লোকেরা চাপে রয়েছে।
বর্তমান অবস্থায় দেশের আমদানি সক্ষমতাসহ অন্যান্য বৈদেশিক দায় মেটানোর জন্য একটি স্বস্তিমূলক রিজার্ভের জন্য আইএমএফের ঋণ আমাদের জন্য আবশ্যক। আবশ্যক রয়েছে বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দেশ ও বহুজাতিক সংস্থার ঋণ সহায়তাও। এগুলো পাওয়ার রাস্তা সুগম করতে আইএমএফের চাহিদা বা শর্ত যতটা সম্ভব আমাদের পালন করতে হবে। কিন্তু সরকারের এখন ধনিক শ্রেণির একতরফা প্রভাব লক্ষণীয় হচ্ছে। খেলাপি ঋণ আদায়, কর রাজস্ব বৃদ্ধি এসবে তারা শ্রেণিস্বার্থের বিপরীতে যেতে পারবে—এমনটা মনে হয় না। তেমনি যে সহায়ক কর্মকর্তারা রয়েছেন সংশ্লিষ্ট, তঁারা চাকরিরত। চাকরির বহুবিধ সুবিধা তাঁরা ভোগ করছেন। আর তা করছেন আগের চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায়। এমনকি তাঁদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের ওপর সুদ ধরে রেখেছেন সঞ্চয়পত্রের সুদের হারের বেশ ওপরে।
অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রনির্ভর লোকজনের বিষয়ে যতটুকু সংবেদনশীল হওয়া প্রত্যাশিত, তেমনটা আমরা দেখছি না তাদের কার্যক্রমে। মূলত সঞ্চয়পত্রনির্ভর লোকজন কোনো সংগঠিত জনসমষ্টি নয়। সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের কোনো ক্ষমতাই তঁাদের নেই। নির্বাচনের সময়ে ব্যালটের ব্যবহারে সুযোগও সংকুচিত হয়েছে। সুতরাং আশঙ্কা থাকছে উপেক্ষিত হবে তাঁদের স্বার্থ। কেননা এসব কিছুর মধ্যেও সরকারকে আইএমএফের শর্ত কিছু কিছু পূরণ করতে হবে। এর মধ্যে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমিয়ে দিলে দৃশ্যমান প্রতিবাদ প্রতিরোধ কিছুই হবে না। বিচারের বাণী কাঁদবে নীরবে নিভৃতে। আসবে না কোনো প্রভাবশালী মহলের চাপ। চাই আশঙ্কাটি ভুল প্রমাণিত হোক। তা–ও আশঙ্কা করছি, হাজার হাজার বিনিয়োগকারীর জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলা পথেই সরকার চলবে।
● আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব