ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের ওপর প্রতিবেশীরা যে কারণে বিরক্ত

২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করার পর পোল্যান্ডে এসেছেন আরও ১৫ লাখ শরণার্থী।

পোল্যান্ড এখন ইউক্রেনের প্রায় ২৭ লাখ শরণার্থীর আবাসস্থল। এর মধ্যে ১২ লাখ ইউক্রেনীয় এসেছিলেন ২০১৪ সালের পর। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করার পর এসেছেন আরও ১৫ লাখ শরণার্থী। 

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) জানায়, জার্মানি ১০ লাখ ইউক্রেনীয় শরণার্থীকে ঠাঁই দিয়েছে। চেক প্রজাতন্ত্র নিয়েছে ৪ লাখ ৬৪ হাজার। অন্যান্য কয়েকটি দেশ নিয়েছে দুই লাখ। অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ৪৭ লাখ ইউক্রেনীয় তাঁদের দেশের বাইরে অস্থায়ী আশ্রয়ের জন্য নিবন্ধিত হয়েছেন।

পোল্যান্ডে আশ্রয় নেওয়া বা নিজ দেশের মধ্যে থাকা ইউক্রেনীয়রা তাঁদের পক্ষ থেকে পোল্যান্ডের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আসছেন। কারণ, প্রথম থেকেই পোল্যান্ড ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের স্বাগত জানিয়েছে এবং ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে। তবে পোল্যান্ড ও ইউক্রেনের মানুষের মধ্যে তুলনা করলে ইউক্রেনীয়রাই বেশি ধন্যবাদ পাবেন। কারণ, শুধু নিজেদের স্বাধীনতার জন্য নয়, বরং পোল্যান্ডের জন্যও তাঁরা লড়াই করছেন এবং প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছেন। তারপরও প্রজেমিস্লো সাদুরা (পোলিশ লেখক ও বুদ্ধিজীবী) এবং আমি শরণার্থীদের যেসব সাক্ষাৎকার নিয়েছি, সেগুলো এই উদ্বাস্তুদের প্রতি পোলিশদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের আভাস দেয়।

পোলিশদের মধ্যে ইউক্রেনীয়দের নিয়ে বিদ্যমান বিরক্তির ক্ষেত্রে এমন কিছু কূটাভাষে মোড়ানো বৈশিষ্ট্য আছে, যার ব্যাপারে ইউক্রেনীয়দের তেমন কিছুই করার নেই। ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের কারণে অনেক পোলিশ নাগরিক স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার মতো নাগরিক সুবিধা ও পরিষেবা বরাদ্দে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন এবং সেই আশঙ্কা থেকে তাঁদের অনেকেই চান না ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের জাতীয় শনাক্তকরণ নম্বর, বিনা মূল্যের গণপরিবহন এবং অন্যান্য সুবিধা দেওয়া হোক। তাঁদের মনে এ ধারণা জন্ম নিচ্ছে যে শরণার্থীদের প্রতি পোল্যান্ড সরকারের এ ধরনের ‘উদারতা’ ইউক্রেনীয় উদ্বাস্তুদের দেশে ফিরে যেতে নিরুৎসাহিত করবে এবং তারা পোল্যান্ডে থেকে গিয়ে পোলিশদের চাকরি–বাকরিতে ভাগ বসাবে। 

২০২২ সালে পোল্যান্ডে আসা চার লাখের বেশি শরণার্থী ইতিমধ্যে সেখানে কাজ পেয়েছেন। যদিও অর্থনীতিবিদেরা বলেছেন, পোল্যান্ডের শ্রমবাজার এই সংখ্যার কমপক্ষে দ্বিগুণ শ্রমিক নিতে পারে; কিন্তু যাঁরা ইউক্রেনীয়দের হুমকি মনে করেন, তাঁদের কাছে অর্থনীতিবিদদের এ তথ্যগুলোর গুরুত্ব খুবই সামান্য। 

সেই ধরনের ঘটনা আগামী বছরে অনুষ্ঠেয় পোল্যান্ডের সাধারণ নির্বাচনেও ঘটতে পারে। সেখানে বিরোধী দলগুলো আবাসনের মূল্যবৃদ্ধি, শিশুদের স্কুলে ভর্তির সুযোগ কমে যাওয়া কিংবা চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া দুষ্কর হয়ে ওঠার মতো পরিস্থিতিতে এ প্রচার করতে পারে যে পোলিশদের নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার অধিকার আছে।

আসলে বলির পাঁঠা হওয়া ইউক্রেনীয়রা পোল্যান্ডের অবনতিশীল অর্থনৈতিক অবস্থার শিকারে পরিণত হচ্ছেন। পোল্যান্ডে মুদ্রাস্ফীতি এখন প্রায় ১৮ শতাংশ; বিদ্যুতের দাম আকাশচুম্বী এবং জন পরিষেবাব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ছে। এ সমস্যার জন্য পোলিশ সরকার যুদ্ধকে দায়ী করছে বলে পোল্যান্ডের সাধারণ জনগণের রাগ এখন অসহায় ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের ওপর গিয়ে পড়ছে। কিছু পোলিশ নাগরিক ইউক্রেনের সঙ্গে তাঁদের দেশের তিক্ত ইতিহাস ঘেঁটে নতুন করে অভিযোগ তুলছেন। যেমন ১৯৪৫ সালে জার্মানি অধিকৃত পোল্যান্ডে ইউক্রেনীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী যে গণহত্যা চালিয়েছিল (ভোলহিনিয়া গণহত্যা) তা সামনে এনে অনেকেই ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের প্রতি নেতিবাচক আচরণ করছেন। তবে উদ্বাস্তুদের প্রতি বৈরী ভাব এখনো মূলত ফিসফাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। 

পরিস্থিতি কিছুটা হলেও ২০১৫ সালে জার্মানি যে অভিজ্ঞতার মুখে পড়েছিল, তা মনে করিয়ে দেয়। যেহেতু শরণার্থীর ব্যাপক ঢল সম্পর্কে জনসাধারণের উদ্বেগ মিডিয়া বা মূলধারার দলগুলো ওই সময় প্রচার করেনি, তাই ডানপন্থী অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি পার্টি সেই শূন্যতা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছিল। তারা অভিবাসনবিরোধী প্রচারণায় নেমেছিলে এবং সেই সুবাদে ২০১৭ সালে তারা প্রথমবারের মতো পার্লামেন্টে আসন লাভ করে। 

আরও পড়ুন

সেই ধরনের ঘটনা আগামী বছরে অনুষ্ঠেয় পোল্যান্ডের সাধারণ নির্বাচনেও ঘটতে পারে। সেখানে বিরোধী দলগুলো আবাসনের মূল্যবৃদ্ধি, শিশুদের স্কুলে ভর্তির সুযোগ কমে যাওয়া কিংবা চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া দুষ্কর হয়ে ওঠার মতো পরিস্থিতিতে এ প্রচার করতে পারে যে পোলিশদের নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার অধিকার আছে। ইউক্রেনীয়দের সাহায্য করতে করতে ক্লান্ত হওয়ারও অধিকার তাদের আছে। এ কারণে এ সমস্যাগুলো স্বীকার করে নিয়ে পোলিশ নেতাদের ধৈর্যসহকারে ব্যাখ্যা করা উচিত যে শরণার্থীরা আসল হুমকি নয়। রাজনীতিবিদেরা যত বেশি সময় চুপ থাকবেন এ আশায় যে সমস্যাটি চলে যাবে, শেষ পর্যন্ত গণনা তত বেশি হতে পারে। 

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

স্লাভমির সিয়েরাকভস্কি পোল্যান্ডের বাম ঘরানার বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন ক্রিতিকা পলিতিৎস্নার প্রতিষ্ঠাতা