মেয়েদের শিক্ষা বন্ধে তালেবানের কতটা লাভ কতটা ক্ষতি

মেয়েদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার এ সিদ্ধান্তের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অভিঘাতও রয়েছে
ছবি : এএফপি

সম্প্রতি আফগানিস্তানে মেয়েদের উচ্চশিক্ষা নিষিদ্ধের যে সিদ্ধান্ত তালেবান সরকার নিয়েছে, তাতে সেখানকার মেয়েদের ওপরই সরাসরি প্রভাব পড়ল না, দেশটির অগ্রসরতার ক্ষেত্রে সামান্য যে আশার প্রদীপ মিট মিট করে জ্বলছিল, তা–ও নিভে যাবে। এই আদেশ আবার এমন একসময়ে এল, যখন সরকারের পরিচালনাধীন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মেয়েদের পড়া নিষিদ্ধ করে জারি করা একটি আদেশ তুলে নেওয়া হবে বলে আশা করছিল দেশটির জনগণ।

অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার মতো একটি অপরিহার্য ও মৌলিক অধিকার থেকে দূরে সরিয়ে রাখার এ ঘটনা থেকে এটা পরিষ্কার, তালেবান উপদলগুলোর মধ্যে কতটা ‘দড়ি–টানাটানি’ চলছে। সেটা আফগানিস্তানের ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে। তালেবানের একটি পক্ষ রয়েছে, যারা জানে, দেশে দুর্দশার মূলে কোনো বাস্তবতা জড়িত। আর অন্য পক্ষটি বাস্তবতাকে খারিজ করে দিয়ে মতাদর্শ বাস্তবায়নকে একমাত্র বিষয় করে তুলেছে।

সাম্প্রতিক ঘটনা প্রমাণ দিচ্ছে, দ্বিতীয় পক্ষ বিজয়ী হয়েছে। কিন্তু এই পথে এগোলে আফগানিস্তান আর সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী দেশ হতে পারবে না। অন্তঃকলহ যেমন বাড়বে, আন্তর্জাতিক পরিসরে একঘরে দশা অব্যাহত থাকবে। পরিণামে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে আফগানিস্তান।

আফগানিস্তানের উচ্চশিক্ষাবিষয়ক মন্ত্রী নিদা মোহাম্মদ নাদিম মেয়েদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা বন্ধ করে দেওয়ার পেছনে কয়েকটি যুক্তি দিয়েছেন। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মেয়েদের আলাদা রাখার মতো প্রয়োজনীয় উপকরণের ঘাটতি রয়েছে বলে যুক্তি দেন তিনি। তাঁর দাবি, মেয়েরা যখন শ্রেণিকক্ষে যাচ্ছে, তখন তালেবান যে ড্রেস কোড নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, তা তাঁরা মানছেন না। এর আগে গত মার্চ মাসে যখন মেয়েদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়তে আসা বন্ধ করেছিল, সে সময়েও একই যুক্তি দেখিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এবারে তিনি রীতিমতো আফগান নারী ও পরিবারগুলোর দিকে অপমানের তির ছুড়ে দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য হলো, শিক্ষা ও কাজের সন্ধানে ঘরের বাইরে আসা নারীদের জন্য অনুচিত।

মেয়েদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার এ সিদ্ধান্তের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অভিঘাতও রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি আদায় তালেবানদের জন্য আরও কঠিন হয়ে পড়ল। আবার যেসব রাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে আফগানিস্তানের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের কাজ চলছে, সেটিও বাধাগ্রস্ত হবে। এই শিক্ষাবিরোধী আদেশ আফগানিস্তানের জনগণ এবং এমনকি তালেবান নেতাদের পূর্ণ সমর্থন পায়নি।

গত বছরের মার্চে তালেবান কর্তৃপক্ষ বলেছিল, ইসলামিক আইন অনুসারে আফগান সংস্কৃতির একটি রূপরেখা তৈরির আগপর্যন্ত সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মেয়েদের শিক্ষা বন্ধ থাকবে। প্রায় এক বছর পার হতে চলেছে, কিন্তু এ বিষয়ে কোনো নীতি তৈরি করা হয়েছে কি না, সে ধরনের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। মেয়েদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা বন্ধের সিদ্ধান্তে মানুষের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, তালেবান কর্তৃপক্ষ মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে আদৌ কি আন্তরিক?

তালেবানের এই নীতির কারণে যাঁরা সরাসরি আক্রান্ত হলেন, তাঁরাই শুধু সরকারের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন না, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে কর্মরত অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মধ্যেও অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। কেননা, জনগণ যেসব প্রশ্নের উত্তর ও সমাধান খুঁজছে, তা তাঁরা দিতে পারছেন না। এসব অজুহাত, কালবিলম্ব ও অসন্তোষ অব্যাহত থাকছে, আর এর মধ্যেই একটি পুরো প্রজন্মের সব শিশু এক বছরের শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এই ক্ষতি অপূরণীয়। তালেবান নেতৃত্ব যদি সমস্যাগুলো সমাধানে সক্রিয়ভাবে কাজ করত, তাহলে অজুহাতগুলো কিছুটা হলেও গ্রহণযোগ্য হতে পারত। কিন্তু বাস্তব কিংবা কাল্পনিক, কোনো প্রচেষ্টা যখন দৃশ্যমান নেই, সেখানে নারীশিক্ষায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ অগ্রহণীয়।

আরও পড়ুন

কান্দাহার ও কাবুলের তালেবান নেতৃত্বকে তিনটি বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে, যাতে করে তাঁরা নারীশিক্ষার গুরুত্ব যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে পারেন এবং আফগানিস্তানকে নিরাপদ, স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্র গঠনে মেয়েদের ভূমিকাকে চিহ্নিত করতে পারেন।

প্রথমত, পবিত্র কোরআন নাজিলে ফেরশতা জিবরাইল এসে হজরত মোহাম্মদকে (সা.) যে শব্দটি প্রথম বলেছেন, সেটি হলো ‘পড়ো’। পুরো সুরাটি থেকে একটি যৌক্তিক পথ পাওয়া যায়। তা হলো, অন্ধকার থেকে আলোয় এবং অজ্ঞতা থেকে জ্ঞানে আসা। কিন্তু একটি প্রকৃত ইসলামি দেশ গঠন করতে গিয়ে তালেবান সরকার বরং আপাতবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছে। তারা আফগানিস্তানকে ধারাবাহিকভাবে অজ্ঞতা ও অশিক্ষার শিকলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বন্দী করে ফেলছে।

দ্বিতীয়ত, নারীশিক্ষা ও অর্থনীতিতে তাদের অংশগ্রহণ সফল সমাজ বিকাশের পূর্বশর্ত। তালেবান নেতৃত্ব একটি কার্যকর ও সত্যিকারের ইসলামিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণভাবে নারী-পুরুষকে আলাদা করার নীতি নিয়েছে। কিন্তু মেয়েদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে এ ধরনের একটি সমাজ কি তারা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে? তালেবান নেতৃত্ব চায়, মেয়েরা অসুস্থ হলে নারী চিকিৎসকই তাঁদের চিকিৎসা করবে। কিন্তু মেয়েদের বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে নারী চিকিৎসক কীভাবে তৈরি করবে তারা?

শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের উপযুক্ত করে মেয়েদের যদি শিক্ষিত করে না তোলা যায়, তাহলে চার কোটি আফগানকে তাদের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য শুধু পুরুষদের ওপর নির্ভর করতে হবে। এমন পুরুষের সংখ্যা দেশটির মোট জনসংখ্যার ৮-৯ ভাগের বেশি নয়। বছরের পর বছর ধরে চলা যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের টেকসই উন্নয়ন কি ক্ষুদ্র এই জনগোষ্ঠী দিয়ে সম্ভব হবে?

আরও পড়ুন

তৃতীয়ত, মেয়েদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার এ সিদ্ধান্তের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অভিঘাতও রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি আদায় তালেবানদের জন্য আরও কঠিন হয়ে পড়ল। আবার যেসব রাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে আফগানিস্তানের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের কাজ চলছে, সেটিও বাধাগ্রস্ত হবে। এই শিক্ষাবিরোধী আদেশ আফগানিস্তানের জনগণ এবং এমনকি তালেবান নেতাদের পূর্ণ সমর্থন পায়নি। এ ছাড়া এক বছর ক্ষমতায় থেকে তালেবান সরকার যেসব অর্জন করেছিল, তা–ও প্রশ্নের মুখে পড়ল। বিশ্বের কাছে তালেবান সরকার দ্বিধাগ্রস্ত ও বিভক্ত কর্তৃপক্ষ হিসেবে হাজির হলো।

তালেবান কর্তৃপক্ষের আশু কর্তব্য হলো, তাদের সিদ্ধান্তটি নিয়ে আরেকবার ভাবা। এ সিদ্ধান্ত আফগান নারী ও জাতির জন্য ক্ষতিকর। নারীরা শুধু আফগান শ্রমশক্তির অপরিহার্য অংশ নন, আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের একটি হাতও তাঁরা।

  • সুলতান বারকাত অধ্যাপক কনফ্লিক্ট অ্যান্ড হিউম্যানটারিয়ান স্টাডিজ, কাতার ফাউন্ডেশন হামিদ বিন খলিফা ইউনিভার্সিটি
    আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনূদিত