জর্ডানে মার্কিন সেনার মৃত্যু কি মধ্যপ্রাচ্য সংকটকে বাড়িয়ে তুলবে?

রোববারের ড্রোন হামলায় তিন মার্কিন সেনা নিহতের পর মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক সংকটে যুক্তরাষ্ট্র আরও গভীরভাবে জড়িয়ে পড়তে পারে। আবার এদিকে ইসরায়েল ও হামাস যুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদী বিরতি এবং দ্রুত জিম্মি উদ্ধারের প্রয়োজনীয়তাও এখন তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে।

কাকতালীয়ভাবে মধ্যপ্রাচ্যে একই সময়ে বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। ফ্রান্সে জিম্মি মুক্তির ব্যাপারে উচ্চপর্যায়ের আলোচনা যখন চলছে, তখন জর্ডানে মার্কিন সেনাদের নিহত হওয়ার ঘটনায় মার্কিন কর্মকর্তারা হতবিহ্বল। বলা যায়, গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর যে সহিংসতার সূত্রপাত, তা এখন সবচেয়ে উত্তেজনাকর মুহূর্ত পার করছে।  

মধ্যপ্রাচ্যের লাখ লাখ বাসিন্দা ও এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ মাথায় রেখে ওয়াশিংটন ও মধ্যপ্রাচ্যের নেতারা পরিস্থিতির পরিবর্তনে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তা নিয়ে গভীর আলোচনায় রত।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইতিমধ্যে পছন্দসই সময়ে ড্রোন হামলার পাল্টা জবাব দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্য ও নিজ দেশের ভেতরে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তা বিবেচনায় নিয়ে  প্রতিশোধের মাত্রা ঠিক করতে হবে তাঁকে। কারণ, সামনেই নির্বাচন।  

আরও পড়ুন

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইতিমধ্যে পছন্দসই সময়ে ড্রোন হামলার পাল্টা জবাব দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্য ও নিজ দেশের ভেতরে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তা বিবেচনায় নিয়ে  প্রতিশোধের মাত্রা ঠিক করতে হবে তাঁকে। কারণ, সামনেই নির্বাচন।  

ইসরায়েলে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুও শতাধিক ইসরায়েলির জিম্মিদশা নিয়ে দেশের ভেতরে প্রচণ্ড চাপে আছেন। বলা হচ্ছে, জিম্মি মুক্তির জন্য ইসরায়েলকে এখন হামাসের বিরুদ্ধে চলা যুদ্ধে দীর্ঘ বিরতি দিতে হবে।

এদিকে তেহরানের সামনে প্রশ্ন হলো, তারা কি প্রক্সি গ্রুপকে লেলিয়ে দিয়ে এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা জারি রাখতে চায়? কারণ, এতে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। মার্কিন কর্মকর্তারা বলতে চান, ইরান এই যুদ্ধ চায় না; বরং দীর্ঘ সময় তারা এ ধরনের যুদ্ধ এড়িয়ে চলতে চেয়েছে।  

প্রতিটি পক্ষ কীভাবে এগোয়, তার ওপর নির্ভর করবে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের ভবিষ্যৎ এবং এই ইস্যু নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, তার গতিপথ। সিচুয়েশন রুমে এবং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে এই নিয়ে এখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা চলবে।

আরও পড়ুন

ওয়াশিংটন স্টেটের প্রতিনিধি ও হাউস আর্মড সার্ভিস কমিটির শীর্ষস্থানীয় নেতা অ্যাডাম স্মিথ বলেছেন, ‘চলমান সংকট বিপজ্জনক দিকে মোড় নিয়েছে। আমরা চেষ্টা করেছি সংঘাত যেন আর না বাড়ে। কিন্তু হতাহতের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের জবাব দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে, যেন এ ধরনের হামলা আর না হয়। আমি জানি, প্রেসিডেন্ট বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন।’

স্মিথ বলেন, যুদ্ধের এই বিস্তারকে গাজা পরিস্থিতি থেকে পৃথক করার সুযোগ নেই। উল্লেখ্য, ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেবে ২৫ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন এবং পুরো অঞ্চলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে।

স্মিথ বলেন, গাজায় যা হচ্ছে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাজার যুদ্ধ ইরানকে আরও ক্ষমতায়িত করেছে। এই পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, অন্যান্য আরব দেশ, গোটা বিশ্বেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোও এখন চ্যালেঞ্জের অংশ।

ড্রোন হামলার ঘণ্টা কয়েক পর সাউথ ক্যারোলাইনার ব্যাপটিস্ট মিশন চার্চের ভোজসভায় বাইডেন তাঁর প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট করেন। নিহত মার্কিন সেনাদের শ্রদ্ধা জানিয়ে নীরবতা পালনের পর তিনি বলেন, ‘আমরা জবাব দেব।’

বাইডেন কীভাবে সাড়া দেবেন,তা এখনো নিশ্চিত নয়। সংঘাত যেন আরও বিস্তৃত না হয়,তা নিয়ে হোয়াইট হাউসের এক রকম নির্দেশনা ছিল, ইরানের সঙ্গে আঞ্চলিক যুদ্ধ জড়ানোর বিপক্ষেও তাদের অবস্থান ছিল জোরালো। হামলা আরও জোরদার করতে এখন বাইডেন প্রশাসনের ওপর চাপ বাড়ছে। রোববার রিপাবলিকানরা ইরানের ভেতর ঢুকে হামলা চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন বাইডেনকে।

বাইডেন কীভাবে সাড়া দেবেন,তা এখনো নিশ্চিত নয়। সংঘাত যেন আরও বিস্তৃত না হয়,তা নিয়ে হোয়াইট হাউসের এক রকম নির্দেশনা ছিল, ইরানের সঙ্গে আঞ্চলিক যুদ্ধ জড়ানোর বিপক্ষেও তাদের অবস্থান ছিল জোরালো।

হামলা আরও জোরদার করতে এখন বাইডেন প্রশাসনের ওপর চাপ বাড়ছে। রোববার রিপাবলিকানরা ইরানের ভেতর ঢুকে  হামলা চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন বাইডেনকে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে, ইরানের প্রক্সি দলগুলো ইরাক ও সিরিয়ায় মার্কিন বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।  

সাউথ ক্যারোলাইনার সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম বাইডেন প্রশাসনকে অনুরোধ করেছেন, ইরানের ভেতর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা চালাতে। তিনি বলেছেন, এই হামলা মার্কিন সেনাদের হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে নয়; বরং ভবিষ্যতে ইরানের আগ্রাসী আচরণের বিরুদ্ধে কাজ করবে। ইরান সরকার জোরজবরদস্তি ছাড়া কিছুই বোঝে না।  
টেক্সাসের সিনেটর জন করনিন তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে সোজাসাপটা বলেছেন, ‘তেহরানকে নিশানা করুন।’

গাজা সংকট বাইডেন যেভাবে মোকাবিলা করেছেন, তাতে বামপন্থীরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। এর মধ্যেই তাঁকে পুনর্নির্বাচনের পথে হাঁটতে হচ্ছে। তিন মার্কিন সেনা নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে তিনি কী সিদ্ধান্ত নেন, রাজনৈতিকভাবে তা এখন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

আরও পড়ুন

মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, তাঁরা একটি মাধ্যমে ইরান এবং তাদের সমর্থনপুষ্ট বাহিনীগুলো জানিয়ে দিয়েছে, মার্কিন বাহিনীর ওপর হামলা তাদের বন্ধ করতে হবে। তবে এরপরও ড্রোন হামলা ঠেকানো যায়নি। হোয়াইট হাউস অবশ্য আগেই এ ধরনের কিছু ঘটবে, এই আশঙ্কা করেছিল।

আশঙ্কা সত্যি হওয়ার পর কর্মকর্তারা বলছেন, প্রেসিডেন্ট জোরালো অভিযান চালানোর পক্ষপাতি। রোববার প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন, জাতীয় নিরাপত্তা পরামর্শক জেক সুলিভানসহ জাতীয় নিরাপত্তা দলের কর্মকর্তারা দফায় দফায় আলোচনায় বসেন। ওই সব বৈঠকে হামলার ধরন ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য জবাব কী হতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা হয়।

একই সঙ্গে মার্কিন কর্মকর্তারা জিম্মি চুক্তির ব্যাপারেও অগ্রসর হচ্ছেন। এর অংশ হিসেবে গাজায় একটি দীর্ঘ যুদ্ধবিরতির উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। আশা করা হচ্ছে, এই বিরতি এ অঞ্চলের উত্তেজনা প্রশমনে সহায়ক হবে।

মার্কিন কর্মকর্তাদের বিশ্বাস, যুদ্ধবিরতির দৈর্ঘ্য বাড়লে গাজায় ত্রাণসহায়তা আরও বেশি পরিমাণে পৌঁছানোর সুযোগ পাবে। তা ছাড়া ইসরায়েল কীভাবে ভবিষ্যতে হামাসকে মোকাবিলা করবে, তা নিয়েও আলাপ-আলোচনার সুযোগ পাবে।

বাইডেন সিআইএ পরিচালক বিল বার্নসকে রোববারই প্যারিসে পাঠিয়েছেন। বিল সেখানে দুই মাসব্যাপী যুদ্ধবিরতি এবং এই বিরতিতে জিম্মিদের পর্যায়ক্রমিক মুক্তির ব্যাপারে কথা বলবেন। প্রস্তাব সব পক্ষ মেনে নিলে চলমান সংঘাতে পরিবর্তন দেখা যাবে।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এই বৈঠককে গঠনমূলক বলে মন্তব্য করেছে। তবে প্রস্তাবে কিছু ঘাটতির কথাও তারা বলছে। তারা জানিয়েছে, এই সংঘাতের পক্ষভুক্ত দেশগুলো তাদের আলোচনা চালিয়ে যাবে।

কাতারের প্রধানমন্ত্রীর চলতি সপ্তাহেই ওয়াশিংটন সফরের কথা আছে। হামাসের সঙ্গে আলোচনায় কাতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।  

বার্নস এবং ইসরায়েল ও মিসরের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে বৈঠকে কাতারের প্রধানমন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন। এই বৈঠককে গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হচ্ছে এই কারণে যে পক্ষগুলো এবার একটি মীমাংসায় পৌঁছাতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মার্কিন কর্মকর্তারাও বলছেন, আলোচনা সঠিক পথে এগোচ্ছে এবং দ্রুতই একই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাবে।  

মার্কিন সেনাসদস্যদের মৃত্যু যখন আঞ্চলিক যুদ্ধের আরও বিস্তৃতির ইঙ্গিত দিচ্ছে, মার্কিন কর্মকর্তারা তখন এ অঞ্চলের উত্তেজনা প্রশমনের জন্যও একটি চুক্তিতে পৌঁছানো অনেক বেশি জরুরি বলে মনে করছেন।

মিশিগানে ডেমোক্র্যাট প্রতিনিধি ও সিআইএর বিশ্লেষক এলিসা স্লটকিন বলেছেন, এই প্রাণহানি ও মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতাই বলে দিচ্ছে, গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা কতটা জরুরি।  

  • কেভিন লিপট্যাক সিএনএনের জ্যেষ্ঠ হোয়াইট হাউস রিপোর্টার। তিনি বাইডেন প্রশাসন, মার্কিন পররাষ্ট্র ও অভ্যন্তরীণ নীতি নিয়ে লেখেন।
    সিএনএনে প্রকাশিত, ইংরেজি থেকে অনূদিত