থার্টি ফার্স্ট নাইট: একটি শিশু বা একটি পাখিরও ক্ষতি না হোক

নাগরিকেরা নিজেরা সচেতন না হলে কোনোভাবেই উৎসবের নামে এই ‘অরাজকতা’ বন্ধ করা সম্ভব হবে না।

আর কয়েক ঘণ্টা পরেই শেষ হতে যাচ্ছে ২০২২ সাল। এরপর নতুন বছর ২০২৩ সাল। নতুন বছরের আগমনকে ঘিরে আমাদের উৎসাহ-উদ্দীপনার শেষ নেই, থাকেও না। তা বাংলা নববর্ষের পয়লা বৈশাখ হোক বা ইংরেজি ক্যালেন্ডারের হ্যাপি নিউ ইয়ার হোক। নতুন বছর যেটিই আসুক, তা নিয়ে মানুষের উত্তেজনা দেখে বরাবরই শিবরাম চক্রবর্তীর চুটকিটা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। সেটি নিশ্চয়ই অনেকেরই জানা: ‘বহু বছরের কঠিন পরীক্ষার পর আমি এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে “নতুন বছর”, “নতুন বছর” বলে খুব হইচই করার কিস্যু নেই। যখনই “নতুন বছর” এসেছে, এক বছরের বেশি টেকেনি।’

সত্যি কথা, এই নতুন বছর আসলে একটি বছরের বেশি টিকে না। কিন্তু মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, অর্জন ও সাফল্যের ইচ্ছা কিংবা স্বপ্নের শেষ নেই। ফলে নতুন বছরকে ঘিরে সেগুলো আরও তীব্র হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ফেলে আসা বছরের যাবতীয় হতাশা, অপ্রাপ্তি, ব্যর্থতা ভুলে থাকতে চায়। ফলে নতুন বছরকে ঘিরে বিপুল প্রত্যাশাও তৈরি হয়। ফলে সেটিকে বরণ করে নিতে বিপুল আয়োজনের প্রস্তুতিও নেয়। ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটার ঘরে যেতে যেতেই তার নমুনা শুরু হয়ে যায়। এরপর তো হতবিহ্বল হয়ে যাওয়া!

পাঠক, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কীসের কথা বলছি। হ্যাঁ, ঢাকা শহরজুড়ে ভয়াবহ আতশবাজি ও পটকা ফোটানো এবং ফানুশ উড়ানোর বিষয়ে বলতেই এ লেখার অবতারণা। বিষয়টি এখন আর ঢাকা শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, দেশের সব বড় শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। এ বছর মানে ২০২২ সালকে বরণ করে নিতে গিয়ে কী ঘটনা ঘটেছিল অনেকের নিশ্চয়ই মনে আছে। আতশবাজি ও ফানুশের কারণে কত জায়গায় আগুন ধরে গেল। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গুদাম পুড়ে নিঃস্বও হলো কয়েকজন। আগুনে পুড়ে কত ব্যক্তি হাসপাতালে ভর্তি হলো। কত গাছ পুড়ে গেল আর কত পাখি বেঘোরে প্রাণ হারাল, তা আমাদের কাছে বলতে গেলে গুরুত্বহীনই! সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে বিপুল সমালোচনা তৈরি হয়।

গত ৩১ ডিসেম্বর ইউসুফ রায়হান নামের এক বাবার ফেসবুক পোস্টের কথা নিশ্চয়ই অনেকের স্মরণে আছে: ‘কী ভীষণ শব্দে আতশবাজি! আমার ছোট্ট বাচ্চাটি এমনিতেই হার্টের রোগী। আতশবাজির প্রচণ্ড শব্দে শিশু বাচ্চাটি আমার ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে ওঠে। খুব ভয় পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। খুবই আতঙ্কের মধ্যে সময়টা পার করছি।’ পরে তাঁর আরেক পোস্টে জানতে পারি, শিশুটিকে ঢাকার হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে নিতে হয় এবং নতুন বছরের প্রথম দিনই মারা যায় সে। অন্যদের আনন্দ উদ্‌যাপন নতুন বছরের শুরুতেই একটি পরিবারে শোক ডেকে আনল।  

শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক আহমেদুর রহমান ফেসবুকে লিখেছিলেন: ‘একটা বাচ্চা এসেছে ফানুস ওড়াতে গিয়ে মোম পড়েছে চোখে-মুখে, একজন তরুণের সরাসরি চোখেই আগুনের হালকা লেগেছে; কর্নিয়া ইনজুরি আছে, একজন পথচারী এসেছেন, তাঁরও মুখ ফানুসের আগুনে পুড়েছে, এক মাদ্রাসাছাত্র ফানুসের আগুনে বৈদ্যুতিক তার পুড়ছে দেখে সেটা নেভাতে গিয়ে নিজের হাত ইলেকট্রিক বার্ন নিয়ে এসেছে (সেই হাতে একটা বড় অপারেশন লাগবে), একজন “বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু” আতশবাজি কাছ থেকে দেখতে গিয়ে চোখ-মুখ পুড়িয়েছে; বেচারা তার সমস্যার কথা বলতেও পারছে না, বেশ কয়েকজন এসেছে পটকায় এক বা একাধিক আঙুল উড়ে গেছে, এমন আরও অনেকে এসেছে।’

এ চিত্র এক বছর আগের। এখন আরেকটি থার্টি ফার্স্ট নাইট সন্নিকটে। আমরা কি আগেরবারের থেকে শিক্ষা নেব? নাকি পুরোনো বছরের দুঃখ ও হতাশা ভুলতে গিয়ে সেটিও ভুলে যাব? আগামীকালও কি শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটের একই করুণ পরিস্থিতি দেখতে হবে? অবশ্যই সেটি আমরা কেউ চাই না। কিন্তু আমাদের চাওয়া আর বাস্তবতার মধ্যে কত কত ফারাক থেকে যায়, ফলে আশঙ্কা করতেই হয়।

সেই আশঙ্কা থেকেই এবার নতুন বছর আসার কয়েক দিন আগ থেকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। যেমন, কয়েক দিন আগে রাজধানীর কাঁটাবন এলাকায় বসবাসকারী আজহার উদ্দিন অনিক নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক শিক্ষার্থী এক থার্টি ফার্স্ট নাইটের অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন: ‘ওই রাতে আতশবাজি ফুটাচ্ছে দেখে বাসার ছাদে উঠেছিলাম অন্য অনেকের মতোই। ক্যামেরাও সাথে নিয়ে উঠেছিলাম থার্টি-ফার্স্ট নাইটের আতশবাজি ফোটানোর কিছু ছবি তোলার ইচ্ছা নিয়ে। হঠাৎ দেখি বড় কী যেন ছটফট করতে করতে ছাদে এসে পড়ল, খেয়াল করে দেখে বুঝতে পারলাম একটা চিল, একেকবার একেক দিকে আতশবাজি ফোটানোর শব্দ আর আলোর ঝলকানিতে দিগ্‌বিদিক জ্ঞান হারিয়ে পালাচ্ছে।’

তিনি আরও লিখলেন, ‘এরপরে আতশবাজির দিকে না তাকিয়ে রাতের আকাশের দিকেই তাকিয়েছিলাম পুরোটা সময়। নিজের চোখে দেখলাম আলোর ঝলকানি আর শব্দ শুনে সবার উল্লাসের মাঝেই অসংখ্য পাখি এদিক সেদিক উড়ে পালাচ্ছে, যেইদিকেই তারা উড়ে যায় সেইদিকেই আতশবাজি ফোটে, সাথে সাথে তারা উল্টো দিকে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু আতশবাজি ফোটানো হচ্ছে সবদিকেই, তারা পালাবে কোথায়! এত পাখি দেখে মনে হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর রমনা উদ্যানের যত পাখির বাসা সব পাখিই নিজেদের বাসা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে শব্দ/আলোর কারণে। রাতের অন্ধকারে দূর দিয়ে উড়লে বোঝা যাচ্ছে না, কাছাকাছি যেসব পাখি উড়ছে সেগুলোকে চেনা যাচ্ছে। কবুতর, প্যাঁচা, কাক, চিল, শালিক কোনো পাখিই বাদ নাই। ঢাকায় গাছগাছালি কম হওয়াতে অনেক পাখিই থাকে ঢাকার এই দিকটায়, রমনা আর ঢাবির দিকে। আতশবাজির শব্দের চোটে একটা পাখিও সম্ভবত বাসায় থাকতে পারে না ওই রাতে।...সেই দিনের পর থেকেই আমি থার্টিফার্স্ট নাইটের পরের দিন রাস্তায় বের হলে খেয়াল করি, কতগুলো পাখি মরে পড়ে আছে। সকাল বেলায় ঝাড়ুদাররা বেশির ভাগ মরা পাখিই সরিয়ে নিয়ে যান রাস্তা থেকে, কিন্তু এরপরেও খেয়াল করলে দেখবেন, একেক জায়গায় কতগুলো পাখি মরে পড়ে আছে।’

প্রতিবারের মতো খ্রিষ্টীয় নতুন বছর উদ্‌যাপনে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে এবারও বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেছেন, ‘কোনো ধরনের ডিজে পার্টি আয়োজন করা যাবে না। কোথাও আতশবাজি, পটকা কিংবা ফানুস ওড়ানো যাবে না। ঢাকা শহর অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। আগেও আমরা দেখেছি, ফানুস ওড়ানোয় দুর্ঘটনা ঘটে। তাই ফানুস ওড়ানো যাবে না। যদি কেউ ফানুস ওড়ায়, তাহলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উচ্চ স্বরে হর্ন বাজানো, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাতে দেওয়া হবে না।’

এখন প্রশ্ন, হাজার হাজার মানুষ যদি আতশবাজি ফোটায় আর ফানুশ ওড়ায়, তাদের বিরুদ্ধে কীভাবে ব্যবস্থা নেবে পুলিশ। এরপরেও আমরা বিশ্বাস করি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাইলে সেটি পারে। তবে সেটি আরও বেশি কার্যকরী হবে, ডিসেম্বর মাস ধরে এ নিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালালে। রাজধানীর বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণের রেকর্ড নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। এ রাতের বেপরোয়া উদ্‌যাপনকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এ শহর আরও বিপর্যস্ত হবে, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। নাগরিকেরা নিজেরা সচেতন না হলে কোনোভাবেই উৎসবের নামে এই ‘অরাজকতা’ বন্ধ করা সম্ভব হবে না। দিন শেষে আমরা কেউ চাই না, আনন্দ উদ্‌যাপন করতে গিয়ে একটি শিশুর বা একটি পাখিরও ক্ষতি না হোক। আমরা চাই না, দুষ্ট ছেলের আনন্দের খেয়ালে করুণ পরিনতি হোক একটি ব্যাঙেরও।

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সহসম্পাদক