আফ্রিকাতেই কেন একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থান?

নাইজারের রাজধানী নিয়ামিতে ফ্রান্স সেনা ঘাঁটিতে অভ্যুত্থানের পক্ষে জনতা
ছবি : রয়টার্স

আফ্রিকায় অভ্যুত্থান-বলয়ের পরিধি বাড়ছেই। অভ্যুত্থান ছড়িয়ে পড়েছে পুরো সাহেল অঞ্চলে। এ অঞ্চলটি উত্তর ও সাব-সাহারা আফ্রিকা এই দুই অঞ্চলে বিভক্ত। সর্বশেষ গত ১০ আগস্ট নাইজারে গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।  ২০২০ সালে থেকে এ পর্যন্ত পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকায় নয়টি সামরিক অভ্যুত্থান ও অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা হয়েছে। প্রাথমিক বিচারে অভ্যুত্থানের এ প্রবণতাকে আফ্রিকার দেশগুলোর পশ্চাৎযাত্রা বলে মনে হতে পারে। মনে হতে পারে দেশগুলো সামরিক শাসনে ফিরে যেতে আগ্রাসী পথ নিচ্ছে। মনে হতে পারে রাশিয়ার উপস্থিতির কারণে ওই অঞ্চলে যে নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তার সুযোগ নিচ্ছে শক্তিমান ব্যক্তিরা। কিন্তু আফ্রিকার বাস্তব পরিস্থিতি আরও বেশি জটিল।

আরও পড়ুন

প্রথমেই আসা যাক কোন বিষয়টি আসলে পুরোপুরি সত্য নয়। ভাড়াটে সেনাদল ভাগনার গ্রুপের তৎপরতার কারণে অনেকে আফ্রিকায় এ সব অভ্যুত্থানের পেছনে রাশিয়ানদের হস্তক্ষেপের কথা বলছেন। আফ্রিকায় ভাগনার গ্রুপের সেনাদের উপস্থিতি আছে সেটা সত্য। কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ড মূলত সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, মালি ও লিবিয়াতে কেন্দ্রীভূত। অন্য দেশগুলোতে তাদের কর্মকাণ্ড স্থায়ী নয়। তারা ভাড়াটে হিসাবে আফ্রিকার সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহীদের অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সহায়তা দিয়ে থাকে। ভাগনার গ্রুপের আফ্রিকায় অবস্থানের মূল কারণ হলো অর্থনৈতিক দস্যুবৃত্তি। স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী ও সরকারের সঙ্গে জালিয়াতির সম্পর্ক গড়ে তুলে তারা সেখানকার  প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন করছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, সুদানের স্বর্ণ, লিবিয়ার তেল এবং সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের হিরা ও ইউরেনিয়াম প্রকল্পে ভাগনার গ্রুপের সংশ্লিষ্টতার কথা বলা যায়।

অভ্যুত্থানের পেছনে আরও বিচিত্র কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, দুর্বল রাষ্ট্র কাঠামো, শক্তিশালী সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনী, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জীবনযাত্রার সংকট, বিশালাকার তরুণ জনগোষ্ঠী ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। এ সব কিছু সম্মিলিতভাবে তরুণদের মাঝে হতাশার বীজ বুনে দিচ্ছে ও প্রাতিষ্ঠানিকতার প্রতি তারা আস্থা হারাচ্ছেন। এর ফলে ক্যারিশমাটিক চরিত্রের শক্তিমানেরা তাদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে।

এ সব সম্পদ হস্তগত করতে ভাগনার গ্রুপ শুধুমাত্র অস্ত্র ও সেনা শক্তি নিয়োগ করেনি গোপনে রাশিয়ার সফট পাওয়ার বা আদর্শগত ক্ষমতাকেও ব্যবহার করছে। বিশ্বব্যাপী ভাগনার গ্রুপের কর্মকাণ্ড ও তৎপরতা নিয়ে কাজ করে অল আইস অন ভাগনার। সংস্থাটি জানাচ্ছে, ভাগনার গ্রুপকে সহায়তা করছে রাশিয়ার অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ফাউন্ডেশন ফর ন্যাশনাল ভ্যালুজ প্রটেকশন। এই সংস্থাটি আফ্রিকার দেশগুলোর নাগরিকদের মধ্যে সরকার সম্পর্কে নাগরিকদের ধারণা কি সেই বিষয়গুলো অনুসন্ধান করে।  

এর ফলাফল হলো, ভাগনার গ্রুপ প্রোপাগান্ডায় ব্যাপক দক্ষ হয়ে উঠেছে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে ভাগনাররা এই প্রপাগাণ্ডা চালায় যে, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপীয় সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর বিপরীতে তারা দয়ালু বিদেশি শক্তি। ‘ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের পাঠানো উপহার’- লেখা প্যাকেটে করে গরিব মানুষের জন্য চাল, চিনি ও ডাল বিতরণ করা হয়। দুই সপ্তাহ আগে, পুতিন আফ্রিকার দেশগুলোকে নয়া-উপনিবেশবাদ থেকে মুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।  নাইজারে অভ্যুত্থানের পক্ষে যে মিছিল বের হয় সেখানে রাশিয়ার পতাকা উড়ানো হয়। তারা স্লোগান দেন ‘ফ্রান্স নিপাত যাক’।

২০২০ সাল থেকে আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলে একের পর যে অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটছে। এটিকে ওই অঞ্চলে ভাগনার ও রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধি হিসাবে দেখা ঠিক হবে না। এ সব অভ্যুত্থানকে কারণ না বলে ফলাফল বলাটাই শ্রেয়। রাশিয়া ও ভাগনার গ্রুপের উপস্থিতির কারণে ওই অঞ্চল বরং যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ ও কূটনৈতিক তৎপরতা বেড়েছে। এ প্রেক্ষাপটে একটা ধারণা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যে, বিদেশি শক্তিগুলোর মধ্যকার প্রক্সি সংঘাতের ফল হচ্ছে আফ্রিকার অভ্যুত্থান। কিন্তু এমন ধারণা আসলে বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতে সমস্যা তৈরি করে।  

এই অভ্যুত্থানকে আরেকটি পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিবেচনা করা প্রয়োজন। সাহেল অঞ্চলের জিহাদি গোষ্ঠীর উত্থানকে পশ্চিমা শক্তি তাদের চিরাচরিত সংকীর্ণ সামরিক পন্থায় সমাধানের চেষ্টা করেছে। এর অংশ হিসাবে পশ্চিমারা নাইজার ও বৃহত্তর পশ্চিম আফ্রিকায় সেনা মোতায়েন করে। কিন্তু এটি কোনো সমাধান আনেনি। বাস্তবতা হলো, ওই অঞ্চলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড উল্টো বেড়েছে। এর ধারাবাহিকতায় অভ্যুত্থানগুলোকে ওই অঞ্চলের জনমিতিতে তরুণদের আধিক্য ও অর্থনীতিতে যে সংকট তারই বহিঃপ্রকাশ হিসাবে দেখা প্রয়োজন। প্রথমেই এটিকে গণতান্ত্রিক অস্থিতিশীলতা বলে দেখা ভুল হবে।

আরও পড়ুন

অভ্যুত্থানের পেছনে আরও বিচিত্র কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, দুর্বল রাষ্ট্র কাঠামো, শক্তিশালী সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনী, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জীবনযাত্রার সংকট, বিশালাকার তরুণ জনগোষ্ঠী ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। এ সব কিছু সম্মিলিতভাবে তরুণদের মাঝে হতাশার বীজ বুনে দিচ্ছে ও প্রাতিষ্ঠানিকতার প্রতি তারা আস্থা হারাচ্ছেন। এর ফলে ক্যারিশমাটিক চরিত্রের শক্তিমানেরা তাদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে।

এই অভ্যুত্থান অবশ্য আশাবাদের একটা প্রেক্ষাপটও তৈরি করছে। আফ্রিকায় এ ধারণাও তৈরি হচ্ছে অভ্যুত্থান বেশি দিন চলতে পারে না। গত সপ্তাহে নাইজারের অভ্যুত্থানকারীদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের পক্ষে মত দেন পশ্চিম আফ্রিকার নেতারা। নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বোলা তিনুবু সতর্ক করে বলেন যে, এটা ছাড়া এখন আর কোনো বিকল্প নেই। আমরা নিজেরাই যদি এটা না করি তাহলে আমাদের হয়ে এটা কেউই করে দেবে না। বোলা তিনুবুর এই বক্তব্য মস্কো, ওয়াশিংটন, প্যারিস ও লন্ডনের প্রতি স্পষ্ট ঘোষণা। তারা যতই গণতন্ত্রের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করুক না কেন, আফ্রিকায় তাদের স্বার্থটা খুবই সংকীর্ণ।

  • নেসরিন মালিক গার্ডিয়ানের কলামিস্ট
    দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত