চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান আমাদের জাতীয় জীবনে একটা মৌলিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে, যেখানে বৈধ রাজনৈতিক দলগুলো ছয় মাস ধরে ক্ষমতাসীন সরকারকে সমালোচনা করলেও তাদের গদি ছাড়ার দাবি নিয়ে রাজপথে আওয়াজ তোলা শুরু করেনি। তার চেয়ে বড় কথা, স্বৈরাচারী রাজনীতি যে আর এই দেশে চলবে না, সেই উপলব্ধি সব রাজনৈতিক দলের মধ্যেই জেগে উঠেছে বলে তাদের কথায় প্রকাশ পাচ্ছে। জাতীয় স্বার্থকে দলীয় স্বার্থের ওপরে স্থান দেওয়ার যে পরিবেশ চলমান, তাতে জাতীয় ঐক্যে পৌঁছানোর সম্ভাবনা এখন বেশ উজ্জ্বল।
সংবিধান সংস্কারের প্রক্রিয়া নিয়ে এখন দুই ধরনের আলাপ চলমান। একধরনের আলাপ কী কী সংস্কার করা যায়, সেটা নিয়ে আর দ্বিতীয় ধরনের আলাপ কোন প্রক্রিয়ায় সংবিধান সংস্কারকে বৈধতা দেওয়া যায়, সেটা নিয়ে।
সংবিধান সংস্কার কমিশন ইতিমধ্যেই একটা সুপারিশমালা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে দিয়েছে, যার ভালো আর খারাপ দিক নিয়ে সমাজে আলাপ চলমান। আজকের এ লেখা দ্বিতীয় আলাপটা নিয়ে, অর্থাৎ কোন প্রক্রিয়ায় সংবিধান সংস্কারকে বৈধতা দেওয়া যাবে, সেটা নিয়ে।
সংবিধান সংস্কারকে বৈধতা দেওয়ার পদ্ধতি হিসেবে নিচের চারটা ভিন্ন ভিন্ন প্রস্তাব পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এসেছে। সেগুলো হচ্ছে—
ক) সংসদ নির্বাচন করে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে সংস্কার প্রস্তাব যাচাই–বাছাই করে বৈধতা দেওয়া।
খ) গণপরিষদের নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সংস্কার প্রস্তাব যাচাই–বাছাই করে বৈধতা দেওয়া।
গ) রাজনৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছিয়ে সংবিধান সংস্কার সভার নির্বাচনের মাধ্যমে ঐকমত্যের সংস্কার প্রস্তাব বৈধতা দেওয়া এবং সংবিধান সংস্কার সভার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করা।
ঘ) রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্যে এনে সেই ঐকমত্যের প্রস্তাব গণভোটের মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া।
প্রতিটা প্রস্তাব নিয়ে আলাপের আগে নাগরিক ও সংসদের সম্পর্ক কেমন, সেটা পরিষ্কার করা প্রয়োজন।
রাষ্ট্রের নাগরিক হচ্ছে কর্তা আর সংসদ হচ্ছে তার তৈরি করা প্রতিষ্ঠান। তার মানে নাগরিক সংসদের মালিক এবং এই নাগরিকদের বেঁধে দেওয়া সংবিধান অনুসারেই এই সংসদ চলে। নাগরিকের অবস্থান সংসদের অনেক ওপরে। এই নাগরিকেরা যেহেতু সংখ্যায় অনেক, তারা সবাই মিলে রাষ্ট্র পরিচালনা বা আইন প্রণয়নের কাজটা করতে পারে না বলে নাগরিকেরা তাদের প্রতিনিধি পাঠায় তাদের পক্ষে কাজটা করার জন্য। এই প্রতিনিধি তার বেঁধে দেওয়া সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন করতে চুক্তিবদ্ধ। নাগরিকেরা এই প্রতিনিধি পরিবর্তন করার অধিকার রাখলেও এই প্রতিনিধিরা তার মালিকের সম্মতি ছাড়া তাদের ভেতরের চুক্তি পরিবর্তন করার অধিকার রাখে না।
এখন আসি প্রথম প্রস্তাবে। সংসদ নির্বাচন দিয়ে সংস্কারের প্রস্তাব এসেছে মূলধারার দল থেকে, যেখানে তারা বলছে, একমাত্র নির্বাচিত সরকারই বৈধতা রাখে একটা সংবিধানে পরিবর্তন আনতে।
এটা ঠিক যে জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া বৈধভাবে কোনো সংবিধান পরিবর্তন করা যায় না; কিন্তু এটাও ঠিক যে একটা নির্বাচিত সংসদের সদস্যরা সংবিধান সমুন্নত রাখার প্রতিজ্ঞা করেই যেহেতু শপথ নেয়, সেই সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন করার অধিকার তার থাকে কী না, তা নিয়েও প্রশ্ন থাকতে পারে। সে জন্য আমরা দেখি, কিছু দেশে সংসদের সংবিধান পরিবর্তনের ক্ষমতা সীমিত করার জন্য সাংবিধানিক আদালত তৈরি করা হয়।
পাশের দেশ ভারতের উচ্চ আদালত ১৯৭৩ সাল থেকে সংসদের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো সংশোধনী বৈধতা দেওয়ার অধিকার ফিরিয়ে নিয়েছে। অভ্যুত্থান–পরবর্তী বাংলাদেশ যে মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে, সেখানে স্বাধীনতা–পরবর্তী সংবিধান সংশোধনের নামে একের পর এক ক্ষমতালোভী সরকার যে প্রবঞ্চনা করে এসেছে, সেটা পরিষ্কার করাই এখন গণদাবি।
এ সময়ের গণ–আকাঙ্ক্ষা সংবিধানের যে প্রকারের বলিষ্ঠ সংশোধন দাবি করে, সেই প্রকারের সংশোধন রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য গড়া সংসদের এখতিয়ারের অতীত। সে জন্য সংসদ নির্বাচন দিয়ে এবারের সংবিধান সংস্কার করা বাস্তবসম্মত নয়। এ ছাড়া ১৯৯১ সালের তিন জোটের রূপরেখা আমাদের শেখায় যে নির্বাচিত হওয়ার পর ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনী ওয়াদা ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি।
সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন করতে নাগরিকেরা একটা বিশেষ সংসদ নির্বাচন করে, যার একমাত্র দায়িত্ব থাকে নতুন সংবিধান তৈরি করা অথবা সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন আনা। এই কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি বা গণপরিষদ সম্পূর্ণ স্বাধীন হতে পারে বা পূর্বনির্ধারিত বাধ্যবাধকতার ভেতর তারা কাজ করতে পারে। ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল একটা বাধ্যবাধকতার গণপরিষদের নির্বাচন। ইয়াহিয়ার লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের অর্গলে সেই সংসদের একটা নতুন সংবিধান দেওয়ার কথা ছিল। তার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সরকার গঠন করার ক্ষমতাও দেওয়া ছিল।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রস্তাবের নাম যা–ই হোক না কেন, ওই দুটো গণপরিষদের মাধ্যমে সংস্কারের প্রস্তাব। একটাতে শুধু সংবিধান সংস্কারের জন্য গণপরিষদ নির্বাচন, আর অন্যটায় সংবিধান সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে সরকার গঠনের ক্ষমতাও তাদের দেওয়া থাকবে এ রকম নির্বাচন। প্রস্তাবগুলোতে অতিরিক্তভাবে একটা রাজনৈতিক ঐকমত্যের পূর্বশর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
এই দুই অপশনের সমস্যা হলো দেশের প্রথাগত দলীয় রাজনীতিবিদেরই গণপরিষদ নির্বাচনে দাঁড়াবার সম্ভাবনা বেশি। তাঁরা সংবিধান সংস্কারের জন্য যে আকাঙ্ক্ষা, তার প্রতি যথাযোগ্য সম্মান দেখাবেন সেই সম্ভাবনা অল্প। তাদের দলীয় পক্ষপাতিত্ব সংবিধান সংস্কারের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালনের অন্তরায় হয়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল।
অপশনগুলোতে রাজনৈতিক ঐকমত্যের পূর্বশর্ত দেওয়া আছে, কিন্তু একবার নির্বাচিত হলে সেই শর্ত মেনে নিতে তারা কতটা বাধ্য হবেন, সেটা আগে থেকে বলা মুশকিল। আর আগে থেকে বলতে না পারার অর্থ হচ্ছে ঝুঁকি। তার ওপর এই নির্বাচিত সদস্যরাই সরকার গঠন করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান করবেন। সেই চূড়ায় বসে সমতলে থাকা অবস্থায় দেওয়া ঐকমত্য অনেক কম গুরুত্ব বহন করবে বলেই আশঙ্কা করা যায়। এসব বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে পড়া গণতান্ত্রিক অবকাঠামোতে গণপরিষদের নির্বাচন কতটা কার্যকর হবে, সেটা আমাদের সবার ভেবে দেখার দাবি রাখে।
সংবিধান সংস্কারের জন্য শেষ যে বিকল্পের কথা বলা হয়েছে, সেটা গণভোট। গণভোটের আগে রাজনৈতিক ঐকমত্যের কথাও এসেছে। প্রস্তাবগুলো নিয়ে আলাপের শুরুতেই বলা হয়েছে, নাগরিকেরা যেহেতু সংসদ তৈরি করে, তাদের অবস্থান সংসদের অনেক ওপরে। সরাসরি এই নাগরিকদের মতামত জানবার উপায় হচ্ছে গণভোট। এ প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, রাজনৈতিক ঐকমত্যের কথা। তার মানে গণভোটে যাওয়ার আগে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের মাধ্যমে গণভোটের জন্য একটা সংবিধান সংশোধনী খসড়া ভোটারদের সামনে পেশ করা হবে এবং ভোটের দিন সম্পূর্ণ প্রস্তাবের সমর্থনে ‘হ্যাঁ’/‘না’ ভোট চাওয়া হবে।
গণভোটের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য ন্যূনতম অংশগ্রহণের বাধ্যবাধকতা দেওয়া যেতে পারে। গণভোট সামনে থাকলে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর ঐকমত্যে আসার বিষয়ে যে চাপ সৃষ্টি হবে, তাতে জনকল্যাণকর সংস্কার প্রস্তাব আসার সম্ভাবনা বাড়বে। ঐকমত্যের আলাপে অংশগ্রহণকারীরা দ্রুতই বুঝতে পারবেন যে তারা যে কাজে নেমেছেন, সেটার সফলতা নির্ভর করছে গণভোটের ওপর।
তখন গণভোট নাগরিকদের স্বার্থের রক্ষাকবচ হিসেবেও কাজ করবে। সংস্কার প্রস্তাব যদি সাধারণ নাগরিকের গণভোটের মাধ্যমে গৃহীত হয়, সে ক্ষেত্রে সেই সংবিধানের পেছনে সর্বস্তরের নাগরিকদের ঐক্যের সম্ভাবনা তৈরি হয়। দেশ তাতে স্থিতিশীল হয় এবং সবাই নিশ্চিন্তে তার কাজে ফিরতে পারে।
সংবিধান সংস্কারের বৈধতা দিতে যে পথই বেছে নেওয়া হউক না কেন, এ সময়ের মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজনৈতিক ঐকমত্যে আসা। সেই ঐকমত্য আসতে প্রথমেই সব পক্ষকে এক টেবিলে বসার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা অর্ধশতাব্দী ধরে যে বিভেদের রাজনীতি দেখে এসেছি, একসঙ্গে টেবিলে বসতে পারলে রাজনীতির স্রোত জনকল্যাণের দিকে বইতে শুরু করবে। দেশ বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করবে। আমরা অধীর আগ্রহে সেই প্রক্রিয়া শুরুর অপেক্ষায় আছি।
সৈয়দ হাসিবউদ্দীন হোসেন রাজনৈতিক কর্মী। ই–মেইল: [email protected]