বরেন্দ্র অঞ্চলে ‘পানি নিপীড়ন’ ও নয়া উপনিবেশবাদের শিকার কৃষক

‘বাধ্যতামূলক উন্নয়ন আর প্রকল্পশাসিত রাষ্ট্রে জন, জল আর জমি ওপর নেমেছে খড়্গ। অসম আর বিভক্তিমূলক উন্নয়নের খপ্পরে পড়ে জন, জল ও জমি হচ্ছে খুনের শিকার।’

বরেন্দ্র অঞ্চলের পানি ব্যবস্থাপনা ঘিরে দুটি শ্রেণির বিকাশ ঘটেছে। একটি হলো ‘ওয়াটার-এলিট’, অন্যটি ‘ওয়াটার-টাউট’। আর এমন সমীকরণ গড়ে ওঠার পটভূমি তৈরি করেছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) ও উপজেলা সেচ কমিটি। এ দুই শ্রেণি, বিএমডিএ ও উপজেলা সেচ কমিটি মিলে বরেন্দ্র অঞ্চলের পানি ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে।

পানির ওপর সর্বজনীন অধিকার সংকুচিত হচ্ছে। প্রতি ফোঁটা পানির অর্থমূল্য তৈরি করা হয়েছে। পানি আজ স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতির বিশেষ কারকও বটে। আর ভূ-উপরিস্থ পানির মালিকানা চলে গেছে নতুনভাবে গজিয়ে ওঠা নগদজীবী বা ক্যাশবেজ শ্রেণির হাতে। যাদের তেমন জমিজিরাত নেই কিন্তু রয়েছে টাকা, ওই শ্রেণি পানির ব্যবসা করে, পুকুর ইজারা নেয়, মাছ চাষ করে, আলু-পেয়ারা বা আমের প্রজেক্ট করে। তারা ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে সখ্য মিলিয়ে চলে।

রুপালি হীরা যাঁর, সামাজিক মর্যাদা তাঁর

ভূগর্ভস্থ পানি রুপালি হীরা। এ রুপালি হীরা দিয়ে তৈরি হচ্ছে কৃষি উন্নয়নের সৌধ। কৃষক হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। কারণ, জনসংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে ক্ষুধা। কিন্তু মাটি তো অনন্ত যৌবনা নয়। তারও প্রয়োজন রয়েছে অবসর আর বিনোদনের। ভূ-উপরিস্থ পানি আর মাটি হলো দুহিতা।

একটি রাষ্ট্র কতটুকু স্মার্ট, তা বোঝা যায় জনগণের সম্পদের ব্যবস্থাপনায় সে কতটুকু দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে তার ওপর। তাৎক্ষণিক উন্নয়ন যদি ভবিষ্যতের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে কী তাকে উন্নয়ন বলা যাবে? বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ ও ভূ-উপরিস্থ পানির নির্বিচার ব্যবহার ভয়াবহতার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

বাধ্যতামূলক উন্নয়ন আর প্রকল্পশাসিত রাষ্ট্রে জন, জল আর জমি ওপর নেমেছে খড়্গ। অসম আর বিভক্তিমূলক উন্নয়নের খপ্পরে পড়ে জন, জল ও জমি হচ্ছে খুনের শিকার। পানি উন্নয়ন বোর্ড এ অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর মাপা শুরু করে গত শতাব্দীর আশির দশকে। ১৯৮৪ সালে ১৬ জুন প্রথম যখন রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামের পানির স্তর মাপা হয়, তখন ছিল ৮-৯ ফুট, যা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৭০ ফুটের ওপরে। গভীর নলকূপগুলো অকেজো হতে শুরু করেছে।

দিন দিন পানিশূন্য হয়ে পড়ছে বরেন্দ্র অঞ্চল। পানিসংকটই সেখানে তৈরি করেছে নতুন রাজনীতি।

পানির প্রতি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে। পুকুর, দিঘি, খাল-বিল-নদী-নালা থেকে পানি আবদ্ধ হয়েছে রড-সিমেন্ট আর বালু দিয়ে গড়া একটি সাদা ঘর ও একটি মেশিনে। পুকুর বা দিঘির টলটলে পানির জায়গায় পানি বলতে এখন দেখি গভীর নলকূপের মোটা পাইপ দিয়ে গলগল করে বেরিয়ে আসা রুপালি পানি।

ভূ-উপরিস্থ পানির পরিবর্তে মানুষ শতভাগ অভ্যস্ত হয়ে উঠছে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারে। রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ীর উপজেলার একটি ছোট্ট গ্রাম চকতাঁতীহাটি, সেখানে রয়েছে ২৬টি খানা। এর মধ্যে ২১টি খানামালিকের উদ্যোগে মর্টারচালিত পানির ব্যবস্থা চালু হয়েছে। একটি মর্টার বসাতে গুনতে হয় ২৮-৩০ হাজার টাকা। একজন ব্যক্তি প্রতিদিন ৩০-৩৫ লিটার ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করছে। ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার শূন্য।

ভূগর্ভস্থ পানির ওপর একক মালিকানা সামাজিক মর্যাদার সূচক হয়ে উঠেছে। টিউবওয়েল পানির দুষ্প্রাপ্যতা এবং পুকুরে মাছ চাষজনিত খাবার দেওয়ায় পানির মান ও ব্যবহারের উপযোগিতা পড়ে গেছে। এ গ্রামে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করলেও জনগণ তার ওপর নির্ভরশীল হতে চায় না। নিজের আওতায় পানি রাখতে চায়। জনপরিসর থেকে পানি এখন ব্যক্তির অধীনে চলে গেল।

অন্যদিকে গভীর নলকূপ কেবল পানির উৎস নয়, গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামো ও রাজনীতির পরিহার্য অনুষঙ্গও বটে। কারণ, যাঁরা উৎপাদনের উপায় নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁরা মানসিক শক্তি উৎপাদনও নিয়ন্ত্রণ করেন। গভীর নলকূপ রাজনৈতিক ক্ষমতার উপায় হয়ে উঠছে। পানির রাজনীতি এখানে ভিন্ন স্বাদের ডিসকোর্সের সন্ধান দিচ্ছে।

যাঁদের সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা থাকার কথা, সেই কৃষক আজ অসহায়। কৃষক বিভক্ত। মধ্যস্বত্বভোগী ও লগ্নিকারীরা সংঘবদ্ধ। সরাসরি উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থেকে কেবল পানি বিক্রি করে তাঁরা বেশির ভাগ মুনাফা লুটে নিচ্ছেন। প্রজেক্টভিত্তিক চাষাবাদে পড়ে কৃষক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হারাচ্ছেন।  

পানিকেন্দ্রিক নয়া উপনিবেশবাদ

গ্রামীণ অর্থনীতিতে পানিকেন্দ্রিক নয়া উপনিবেশবাদ প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। নয়া প্রবণতাটি হলো প্রজেক্টভিত্তিক চাষাবাদ। কৃষক প্রজেক্ট শব্দটি আত্মস্থ করেছেন। চলছে আলু, মাছ, ধান, পেয়ারার চাষ। যাঁরা অর্থলগ্নি করছেন, তাঁরা শহর, আধা শহর ও দূরবর্তী এলাকার মানুষ। একেকটি প্রজেক্টের আওতায় ৬০-২৫০ বিঘা জমি চাষ হচ্ছে।

একটি প্রজেক্টের আওতায় হয়তো কোনো কৃষকের ১০ কাঠা জমি পড়েছে। তিনি নিজের মতো করে চাষাবাদ করতে চান, কিন্তু উপায় নেই। যিনি প্রজেক্ট করছেন, তাঁকে জমিটা দিতে হবে। আর তা না হলে গভীর নলকূপ থেকে পানি পাওয়া যাবে না। প্রজেক্টে অর্থলগ্নিকারী এবং গভীর নলকূপের মালিকের মধ্যে রয়েছে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। একজন পানির তথাকথিত মালিক, অন্যজন প্রজেক্টে অর্থলগ্নিকারী। মধ্যস্বত্বভোগীরা অর্থলগ্নিকারীদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নেয়।

পানি কিনে নিয়ে কৃষককে করতে হয় ফসল চাষ। যাদের কাছ থেকে পানি কিনতে হয় তাদের কাছে জিম্মি কৃষক।

যাঁদের সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা থাকার কথা, সেই কৃষক আজ অসহায়। কৃষক বিভক্ত। মধ্যস্বত্বভোগী ও লগ্নিকারীরা সংঘবদ্ধ। সরাসরি উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থেকে কেবল পানি বিক্রি করে তাঁরা বেশির ভাগ মুনাফা লুটে নিচ্ছেন। প্রজেক্টভিত্তিক চাষাবাদে পড়ে কৃষক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হারাচ্ছেন।  

গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রজেক্টভিত্তিক নয়া উপনিবেশবাদে ভুক্তভোগী কৃষক। কৃষক না বাঁচলে কৃষি বাঁচবে না। কৃষক কেবল জমি চাষ করেন না, জমি তাঁর পরিবার, বিশ্বাস ও দর্শনের অংশ। প্রজেক্টভিত্তিক নির্বিচার চাষাবাদে মুনাফা ছাড়া আর কিছু নেই। এটি প্রেম নয়, ভূমির সঙ্গে নিপীড়নমূলক সম্পর্ক। মাটির সুষম স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে জাতিসংঘ আজ বিশেষভাবে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। মাটিকে বলপূর্বক অধিক উৎপাদনে বাধ্য করা অপরাধ। উৎপাদন হওয়া উচিত ভারসাম্যপূর্ণ, নিপীড়নমূলক নয়। জমি ও উৎপাদনের ওপর কৃষকের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। মুনাফালোভী ও উৎপাদন–নিপীড়কদের থামাতে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ খুব জরুরি।

৪০ বছরের ভূগর্ভস্থ পানির হিসাব কোথায়

অনেক আগে বরেন্দ্র অঞ্চল খরাপ্রবণ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। গত শতাব্দীর আশির দশকের আগে এখানকার জমি ছিল এক ফসলি। ভূ-উপরিস্থ পানি দিয়ে চাষাবাদ চলত। কৃষকেরা ছিলেন অদৃশ্যবাদী। বৃষ্টি কমবেশি হলে তাঁরা মাঠে খোলা আকাশের নিচে বসে ইসতিসকার নামাজ পড়তেন। বৃষ্টি চাইতেন। উৎপাদনের প্রধানতম অস্ত্র সেই পানি এখন একটি চক্রের হাতে। এই চক্র পানি নিয়ন্ত্রণ করে এবং নির্বিচারে ব্যবহার ও সুবিধা নিচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানি প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক জনগণ, কোনো ব্যক্তি বা চক্র নয়।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) উদ্যোগে ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে চাষাবাদ শুরু করে গত শতাব্দীর আশির দশকে। লক্ষ্য ছিল কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি। এ সময় বিএডিসি বরেন্দ্র সমন্বিত এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প (বিআইএডিপি) নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ সালে গঠন করা হয় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। বিএমডিএ তখন ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারে এঁটেসেঁটে বসে।

একটি গভীর নলকূপে প্রতি সেকেন্ডে ৫৬ লিটার পানি উত্তোলন করা যায়। গত ৪০ বছরে কী পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হলো, তার হিসাব কে করবে?

বিএমডিএ সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে বরেন্দ্র তাদের গভীর নলকূপ রয়েছে ১৭ হাজারের ওপর। এ ছাড়া ব্যক্তিমালিকানা গভীর নলকূপ রয়েছে। এর প্রকৃত সংখ্যা জানা যায়নি। রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার সরনজাই ইউনিয়নে ব্যক্তিমালিকানায় ৫-৬টি আর বিএমডিএর ৩০-৪০টি গভীর নলকূপ রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। বিএমডিএর সূত্র জানায়, একটি গভীর নলকূপে প্রতি সেকেন্ডে ৫৬ লিটার পানি উত্তোলন করা যায়। গত ৪০ বছরে কী পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হলো, তার হিসাব কে করবে?

গভীর নলকূপ স্থাপনে দ্বৈত শাসন ও সমন্বয়হীনতা

বিএমডিএ এবং উপজেলা সেচ কমিটি বরেন্দ্র অঞ্চলের পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করে। উপজেলা সেচ কমিটির চূড়ান্ত অনুমোদন সাপেক্ষে গভীর নলকূপ বসানো হয়। একটি গভীর নলকূপ বাসাতে খরচ পড়ে ২০-২২ লাখ টাকা। ব্যক্তিগত গভীর নলকূপের সুনির্দিষ্ট খরচের হিসাব পাওয়া যায়নি। বিএমডিএর গভীর নলকূপে ড্রেনেজ সিস্টেম পাকা হওয়ায় পানির অপচয় কম হয়। ব্যক্তিগত মালিকানার গভীর নলকূপে ড্রেনেজ উন্নত না হওয়ায় পানির অপচয় বেশি।

ব্যক্তিগত মালিকানার গভীর নলকূপের পানির মূল্য বিএমডিএর গভীর নলকূপের তুলনায় বেশি। সরেজমিন তথ্যে দেখা গেছে, বিএমডিএর আওতায় এক বিঘা জমি চাষ করতে একজন কৃষককে ১ হাজার ৫০০ টাকার বিদ্যুৎ বিল (কার্ড) এবং অপারেটরকে ৫০০ টাকা দিতে হয়। অন্যদিকে ব্যক্তিগত নলকূপে এক বিঘা জমি চাষ করতে অনেক সময় তার চেয়েও বেশি খরচ গুনতে হয়। তবে এই খরচ কমবেশি হয়। ব্যক্তিগত নলকূপে পানির বাণিজ্যিক ব্যবহার অনেক বেশি।

ব্যক্তিগত নলকূপে পানির মূল্য নির্ধারিত হয় মালিকের ইচ্ছায়। আর বিএমডিএর ক্ষেত্রে নীতিমালার অনুসরণে। বিএমডিএর গভীর নলকূপ পরিচালনার ক্ষেত্রে কৃষকের অংশগ্রহণ রয়েছে, ব্যক্তিমালিকানায় তা নেই। এ অঞ্চলে পানি ব্যবস্থাপনা ক্ষেত্রে বিএমডিএ ও উপজেলা সেচ কমিটির দ্বৈত শাসন ও সমন্বয়হীনতা লক্ষ করা গেছে। গভীর নলকূপ স্থাপনের ক্ষেত্রে বিএমডিএ নির্ধারিত দুই হাজার ফুটের সীমারেখা বিবেচনা না করে অনেক ক্ষেত্রে উপজেলা সেচ কমিটি ব্যক্তিমালিকানায় গভীর নলকূপ স্থাপনের অনুমতি দিচ্ছে।

ভূগর্ভস্থ সিক্ত শিলাস্তর বা একুইফার অস্বাভাবিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতিবছর যে পরিমাণ পানি তোলা হয়, তার তুলনায় একুইফার পূরণ হচ্ছে না। একুইফার মৌলিক চরিত্র হারাচ্ছে। উন্নয়নের নীতিদর্শনের দিক থেকে মানুষ যা সৃষ্টি করিনি, তা ধ্বংস করতে পারে না। ভূগর্ভস্থ সিক্ত শিলাস্তর কী জনগণ, রাষ্ট্র বা সরকার তৈরি করেছে? তাহলে তা ক্ষতি করার অধিকার তাদের কে দিল?
এইসব পুকুর থেকে কতটা সুবিধা পান কৃষকেরা? যেখানে পানির চরম সংকট সেখানে পুকুর ইজারা দেওয়া মাছ চাষের জন্য

ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিএমডিএ নতুন করে গভীর নলকূপ স্থাপনের অনুমতি দিচ্ছে না। কিন্তু সরেজমিনে দেখা গেছে, বিএমডিএর যেসব গভীর নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে, সেগুলো নতুন করে বোরিং করে স্তর আরও নিচে নামাচ্ছে। তানোর উপজেলার সরনজাই ইউনিয়নে ১ গ্রামে ৯৫ ফুটের একটি গভীর নলকূপের পানির স্তর পড়ে যাওয়ায় সম্প্রতি তা বোরিং করে ১৭০ ফুটে নামানো হয়েছে।

নতুন করে গভীর নলকূপ স্থাপনের অনুমতি না দিলেও অকেজো হয়ে পড়া নলকূপগুলোর পানির স্তর ভালো পাওয়ার আশায় ভূগর্ভের গভীরে যেতে সহায়তা করছে বিএমডিএ। তবে বোরিং করে সব সময় পানির স্তর পাওয়া যাচ্ছে তা নয়; তানোর উপজেলার চককাজিজিয়া গ্রামের একজন কৃষক জানান, গভীর নলকূপ বসানোর জন্য তিনি পরপর সাতটি স্থানে বোরিং ও এ বাবদ ৯০ হাজার টাকা খরচ করেছেন, কিন্তু পানির স্তর পাননি।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এক কেজি ধান উৎপাদন করতে খরচ হয়েছে ১ হাজার ২০০ লিটার পানি। তাহলে গত প্রায় ৪০ বছরে বিএডিসি ও বিএমডিএ কী পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করল এবং এ পানি, জৈববৈচিত্র্য, পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতির আর্থিকমূল্য, অন্যদিকে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য থেকে যোগ-বিয়োগ করলে হিসাব পরিষ্কার হয়ে যায়।

ব্যর্থতার টেক্সট বুক উদাহরণ হতে যাচ্ছে কি

গত শতাব্দীর আশির দশকের তুলনায় সমকালীন ভূগর্ভস্থ পানির ব্যয় বেড়েছে ১১ গুণ। খাওয়ার পানির সংকট বাড়ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনূরা রেলওয়ে জংশনের আশপাশে চাতালে ধান প্রস্তুত করার জন্য মর্টার বসিয়ে পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। এ কারণে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় পানির স্তর নিচে নেমে গেছে এবং জনগণ দূর থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে বাধ্য হচ্ছে।

ভূগর্ভস্থ সিক্ত শিলাস্তর বা একুইফার অস্বাভাবিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতিবছর যে পরিমাণ পানি তোলা হয়, তার তুলনায় একুইফার পূরণ হচ্ছে না। একুইফার মৌলিক চরিত্র হারাচ্ছে। উন্নয়নের নীতিদর্শনের দিক থেকে মানুষ যা সৃষ্টি করিনি, তা ধ্বংস করতে পারে না। ভূগর্ভস্থ সিক্ত শিলাস্তর কী জনগণ, রাষ্ট্র বা সরকার তৈরি করেছে? তাহলে তা ক্ষতি করার অধিকার তাদের কে দিল?

দেশে পানি ব্যবস্থাপনার শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো রয়েছে। রয়েছে জাতীয় পানিসম্পদ কাউন্সিল। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থা, সংশ্লিষ্ট কমিশন নিয়ে এ কাউন্সিল গঠিত। অন্যদিকে রয়েছে জাতীয় পানি পরিকল্পনা, জাতীয় পানিনীতি, পানি আইন, অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, রূপকল্প ২০৪১, ও বদ্বীপ পরিকল্পনা। আরও রয়েছে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০ অর্জনে বিশেষ অঙ্গীকার।

প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও দলিলগুলো বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানি সুরক্ষা করতে পারছে না। এসব নিষ্ফলা প্রমাণিত হচ্ছে। নীতিপরিকল্পনা আর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলের পানিব্যবস্থা টেক্সট বুক উদাহরণ হতে যাচ্ছে।

বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের এ উদ্বেগজনক বিপর্যয় রোধে করণীয় নির্ধারণ জরুরি। জানি না কে এগিয়ে আসবেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অনুসরণ করি বলি, ‘যিনি আছেন মাটি আর মানুষের কাছাকাছি, তাঁর লাগি কান পেতে আছি!’

  • খান মো. রবিউল আলম যোগাযোগবিশেষজ্ঞ