বাংলাদেশের সমতলে বসবাসরত জাতিগোষ্ঠীগুলোর প্রাণের পরব ঐতিহ্যবাহী কারাম। মূল শব্দ করম হলেও এখন সেটি এখন কারাম বলে প্রচলিত। শুধু বাংলাদেশ নয়; ভারত, নেপাল, মরিশাস, ফিজি প্রভৃতি দেশে কারাম পরব পালিত হয়ে থাকে। ‘গিঁইরালাই ভাদারআ মাসঅ, লাগালাই কারাম কেএ আঁস’, পড়েছে ভাদ্র মাস, মনে কারাম পরবের আশা জেগেছে। মাহাতো জনজাতির কুড়মালি ভাষায় ভাদ্র মাসকে ‘কারাম মাস’ বলা হয়ে থাকে। কারাম ভাদ্র মাসের পার্শ্ব একাদশীতে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তবে কোনো কোনো জনগোষ্ঠী আবার অন্য তিথিতেও আয়োজন করে থাকে। সমতলের, বিশেষ করে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, রংপুর, দিনাজপুর, খুলনা, সিলেটসহ প্রভৃতি অঞ্চলে এ সময় অনেক চঞ্চলতা ও ধর্মীয় উদ্দীপনার সঙ্গে কারাম উৎসব উদ্যাপন করা হয়।
সাঁওতাল, ওঁরাও, মাহাতো, বড়াইক, কুর্মি, সিং, পাহান, মাহালি, বেদিয়াসহ আরও কতিপয় জাতিসত্তা তাদের নিজ নিজ রীতিতে পালন করে থাকে। ২০১৩ সালে মাহাতোদের কুড়মালি ভাষায় প্রথম কারাম বিষয়ে উপন্যাস কারাম প্রকাশিত হয়। কারাম নামক গাছের ডাল কেটে বিভিন্ন প্রাচীন প্রথা মান্য করে এ উৎসব করা হয়। তাই এর নাম কারাম পরব। কারাম ডাল গেড়ে পূজা করা হয়, তাই এটি কোথাও কোথাও ডাল পূজা নামেও পরিচিত।
করম পরবে কেরমেতিরা তার বাবা-ভাইয়ের দীর্ঘায়ু কামনা করে; সেই সঙ্গে বৃক্ষের বন্দনা করে থাকে। জাতিগোষ্ঠীগুলো প্রকৃতিপ্রিয়। কৃষি ও বৃক্ষের সঙ্গে জাতিগোষ্ঠীগুলোর আত্মার সম্পর্ক। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও তারা তাদের নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি ধরে রাখতে এবং পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞ। সংশ্লিষ্ট সবার সহায়তা পেলেই হয়তো রক্ষা পাবে সমতলের জাতিগোষ্ঠীর বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে থাকা নিজ নিজ ভাষা-সংস্কৃতি।
কারামগাছ বা করমগাছের বৈজ্ঞানিক নাম হালদিনা করডিফোলিয়া। রুবিয়াসি হালদিনা গণের পত্রমোচী সপুষ্পক বৃক্ষ। এটিই এই গণের একমাত্র বৃক্ষ। এই গাছ দক্ষিণ এবং দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় জন্মে। ফুল ও ফল ধারণ ঘটে এপ্রিল থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে। বীজ দ্বারা সাধারণত পাখির মাধ্যমে বংশবিস্তার ঘটে। সংকটের বিষয় এটাই যে উল্লেখিত এলাকাসহ বেশ কিছু এলাকার মানুষ এই গাছ না থাকায় কাছাকাছি রকম দেখা যায়, এমন গাছের ডাল কেটে তাদের পূজায় ব্যবহার করছে, যা তাদের সংস্কৃতিকে চরমভাবে হুমকির মুখে ফেলছে। এ এলাকায় এখন আর করমগাছ নেই বললেই চলে।
কারাম পরবের আনুষ্ঠানিকতা পাঁচ দিনের। কোথাও কোথাও সাত দিন ধরে এ অনুষ্ঠান করা হয়ে থাকে। প্রথম দিন থেকেই যারা কারামপূজায় অংশগ্রহণ করে (কেরমেতি) তাদের আমিষ খাবার, হলুদ, তেল ও সব ধরনের মসলাজাতীয় খাওয়া যায় না।
কেরমেতি বলতে যারা কারামপূজায় অংশগ্রহণ করে তাদের বোঝায়। তারা বিশ্বাস করে যদি এই খাবারপদ্ধতির কেউ অনিয়ম করে, তাহলে তার অংশের বীজের অঙ্কুরোদ্গম (জাওয়া) মরে যায়। জাওয়া বলতে বোঝায় মাটি, বালু, মুং, কুর্থি, ছোলা ইত্যাদি উপকরণসামগ্রীর সমন্বয়ে চারাগাছের অঙ্কুরোদ্গমের যে ডালা তৈরি করা হয়। এটি বৃহৎ অর্থে বৃক্ষের তথা কৃষির বিভিন্ন বীজের অঙ্কুরোদ্গম, লালন-পালন ও সংরক্ষণকেই বোঝায়। গবেষকদের ধারণা, কৃষিসভ্যতার সূচনায় জাতিগোষ্ঠী নারী কৃষির সূচনা করে। কারাম পরবে মূলত বীজের অঙ্কুরোদ্গম, বীজ থেকে চারা তৈরি, সন্তানস্নেহে লালন-পালন ও সংরক্ষণ প্রতীকী অর্থে প্রকৃতিকেই বন্দনা করা হয়। বিভিন্ন রকম আচার ও গীতের মাধ্যমে জাওয়া তোলা হয়। প্রত্যেক দিন রাতে একই রকম আচার, গীত ও ঝুমুরের মধ্য দিয়ে জাওয়ায়পানি দেওয়া ও জাগানো হয়।
নিয়মিত পরিচর্যায় বীজগুলো এ সময় দুই পাতাবিশিষ্ট সবুজ চারাগাছ হয়। শেষের দিন কেরমেতিরা সন্ধ্যায় আঙিনায় করম ডাল গেড়ে শাপলা ফুল, শসা, ফিতা প্রভৃতি দিয়ে সাজিয়ে, ডালের গোড়ায় ডালাগুলো রেখে জ্বলন্ত প্রদীপ ও বরণডালা সাজে সজ্জিত কাঁসার থালা নিয়ে অধীর আগ্রহে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও প্রথা বুকে লালন করে পূজায় মনোনিবেশ করে। কার্মা ধার্মার উপদেশমূলক গল্প জানা বৃদ্ধার নীতি গল্প শুনতে শুনতে এবং সঠিক সময়ে ডালকে প্রণাম ও ফুল ছিটিয়ে ওই রাতেই পূজার কাজ সমাপ্ত হয়। এ গল্পে নানা রকম শিক্ষণীয় রূপক চরিত্র ব্যবহার করা হয়। যখন পৃথিবীতে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না, তখন এ জাতিসত্তার মানুষগুলো করম পরবে তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে কার্মা ধার্মার গল্প শেখানোর মাধ্যমে তাদের চরিত্র গঠন তথা মানবিক গুণাবলি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত এবং এখনো করছে বলে গবেষকেরা মনে করেন। পরক্ষণে রাতভর করম ডালকে ঘিরে ঢোল, মাদল, কাশি ও নিজ নিজ বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে ঝুমুর ও গীত পরিবেশিত হয়।
শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী, বয়স্কদের সমন্বয়ে ঢোল-মাদলের আওয়াজ ও প্রদীপের আলোয় পুরো জাতিগোষ্ঠী পল্লিগুলোতে নৈসর্গিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। পরদিন সকালে সবাই মিলে বিভিন্ন আচার সেরে গীত গাইতে গাইতে করম ডালকে নদীতে বিসর্জন দেওয়া হয়। বিসর্জনের সময় তারা গাইতে থাকে, ‘দেঁলিও গেঁ কেরমেতি দেলিও গে আঁসিস/ তহর বাপ-ভাই জাতে জিঅও লাখে বাসিস’ বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়, ‘কেরমেতি দিলাম তোমাকে আশীর্বাদ/ তোমার বাবা-ভাই যেন বাঁচে লক্ষ বছর।’
করম পরবে কেরমেতিরা তার বাবা-ভাইয়ের দীর্ঘায়ু কামনা করে; সেই সঙ্গে বৃক্ষের বন্দনা করে থাকে। জাতিগোষ্ঠীগুলো প্রকৃতিপ্রিয়। কৃষি ও বৃক্ষের সঙ্গে জাতিগোষ্ঠীগুলোর আত্মার সম্পর্ক। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও তারা তাদের নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি ধরে রাখতে এবং পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞ। সংশ্লিষ্ট সবার সহায়তা পেলেই হয়তো রক্ষা পাবে সমতলের জাতিগোষ্ঠীর বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে থাকা নিজ নিজ ভাষা-সংস্কৃতি।
উজ্জল মাহাতো লেখক ও গবেষক