মানুষের কাছে সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় সম্ভবত তাঁর নিজের বাসা, বাসা যেন বাইরের সব ধরনের ক্ষয়ক্ষতি থেকে তাকে রক্ষা করে চলেছে। ভাবনাটা যে অযৌক্তিক, এমনটিও নয়। রাস্তায় বের হলেই যানজট, ছিনতাইকারীর হুমকি, তাপপ্রবাহ, অকস্মাৎ বৃষ্টি— ক্লান্তিকর, প্রতিযোগিতাপূর্ণ ও অনিশ্চিত দৈনন্দিন জীবন। নিজের বাসায় ফেরা মানে সবকিছু থেকে মুক্তি, একটু নিজের মতো জিরিয়ে আবার পরের দিনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার সুযোগ। কিন্তু যদি বলি এই ঘরেও আপনি সব রকমের ঝুঁকি থেকে নিরাপদ নন; বরং এক মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে আপনার বাসাও আপনাকে খুব সামান্যই নিরাপত্তা প্রদান করে?
ঢাকা, দিল্লি বা লাহোরের যেকোনো বাসিন্দাই জানেন যে তাঁরা বায়ুদূষণের হটস্পটে বাস করছেন। আইকিউএয়ারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ঢাকার গড় বায়ুদূষণের মাত্রা ছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত মানের ১৬ গুণের বেশি।
এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স বলছে, ঢাকার বায়ুর মান এতটাই খারাপ যে এর ফলে শহরের জনসংখ্যার গড় আয়ু প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর কমে যাচ্ছে। বাসাবাড়ির ভেতরের বায়ুদূষণ যেহেতু চোখে পড়ে না, বেশির ভাগ মানুষই জানেন না যে বাসার ভেতরে ও বাইরে বায়ুদূষণের মাত্রা প্রায় সমান। দরজা, জানালা, ভেন্টিলেশন সিস্টেমের মাধ্যমে বাইরের দূষণ বাসাবাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে এবং ভেতরের বাতাসকেও প্রায় একই পরিমাণ দূষিত করে তোলে।
সম্প্রতি করা এক গবেষণার অংশ হিসেবে আমরা মিরপুরের মধ্যবিত্ত এলাকায় এক হাজারের বেশি পরিবারকে বায়ুদূষণসংক্রান্ত কিছু প্রশ্ন করি। উত্তরে বাইরের বাতাসের মান নিয়ে তাদের হতাশা স্পষ্ট—৭৬ শতাংশ মানুষ মনে করেন, তাঁদের বাসাবাড়ির বাইরে বায়ুদূষণের মাত্রা গুরুতর। অথচ বাসাবাড়ির ভেতরের বাতাসের অবস্থা নিয়ে তাঁরা অবগত নন বললেই চলে, মাত্র ২৪ শতাংশ মানুষ মনে করেন, তাঁদের ঘরের বাতাস গুরুতরভাবে দূষিত। কাজেই এটা একদম স্পষ্ট যে গবেষণায় অংশগ্রহণকারী বেশির ভাগের কাছে বাইরের বাতাসের দূষণই মূল সমস্যা, তাঁদের কাছে তাঁদের বাসা বরং দূষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার একটা উপায়।
তাঁদের এই বিশ্বাস কতটা সঠিক তা যাচাই করতে আমরা ৫০০ পরিবারের বাসায় বায়ুদূষণ মাপার জন্য এয়ার মনিটর স্থাপন করি। এ ছাড়া বাইরের বায়ুদূষণ মাপার জন্য গবেষণা এলাকার দুটি বাসার ছাদেও মনিটর স্থাপন করা হয় ।
ফলাফলে উঠে আসে—ঘরের ভেতরের বায়ুদূষণ গড়ে বাইরের দূষণের ৭৭ শতাংশ। অর্থাৎ যেসব মধ্যবিত্তের অ্যাপার্টমেন্ট বাসা বায়ুদূষণ থেকে তুলনামূলক বেশি নিরাপদ হওয়ার কথা, সেগুলোতেও বাইরের বায়ুদূষণের বেশির ভাগ (তিন-চতুর্থাংশ) প্রবেশ করে। আপনার বাসার ভেতরের বাতাস আপনার জন্য স্বাস্থ্যকর তো নয়ই; বরং বিপজ্জনকও হতে পারে। কাজেই আপনি ঢাকা শহরে বসবাস করলে বায়ুদূষণ থেকে আপনি কোথাও নিরাপদ নন।
বাইরের বায়ুদূষণের কতটুকু বাসায় প্রবেশ করে বলে তাঁরা মনে করেন, সেটিও আমরা পরিবারগুলোকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তাদের মতে গড়ে মাত্র ৪৩ শতাংশ বায়ুদূষণ ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে, যা বাস্তবচিত্রের অর্ধেকেরও কম। যেহেতু এয়ার মনিটর ছাড়া বাসার ভেতরের বায়ুদূষণ মাপার কোনো উপায় নেই, তাই তাদের এ রকম ধারণা জন্মানো অস্বাভাবিক কিছু নয়।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ঘরের ভেতরের প্রকৃত বায়ুদূষণ মানুষের ধারণার প্রায় দ্বিগুণ। যদিও ঘরের ভেতরের বায়ুদূষণ বাইরের তুলনায় কিছুটা কম, তবে মানুষ ঘরের ভেতরের দূষণের মাত্রা ব্যাপকভাবে কম মনে করে। বাসাবাড়ির ভেতরে বায়ুদূষণের মাত্রা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকা আমাদের ওপর সরাসরি অনেক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। প্রথমত, পরিবারগুলো বাসাবাড়ির ভেতর বায়ুদূষণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করে না।
ঘরের ভেতরের বায়ুদূষণের মাত্রা সম্পর্কে জ্ঞানের অভাবের সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। প্রথমত, মানুষ ঘরের ভেতরের বায়ুদূষণ থেকে সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে না।
উদাহরণস্বরূপ, আমরা দেখেছি যে ১ শতাংশেরও কম পরিবারের বাসায় বায়ু পরিশুদ্ধের জন্য এয়ার পিউরিফায়ার আছে এবং যাদের এয়ার পিউরিফায়ার আছে, তাঁরাও খুবই অল্প সময়ের জন্য ব্যবহার করেন। এ ছাড়া পরিবারগুলো মনে করে, দিনের বেশির ভাগ সময়ই তারা বায়ুদূষণ থেকে সুরক্ষিত। তাই বায়ুদূষণ কমানোতে সরকারের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত বলেও তারা মনে করে না।
আমাদের গবেষণায় আমরা দেখতে পেয়েছি, বায়ুদূষণ বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সমস্যা, সেটি বাসাবাড়ির বাইরে দূষণের মাত্রা বিবেচনায় হোক অথবা বাসাবাড়ির ভেতরের মাত্রা বিবেচনায়ই হোক। এই তথ্য জনসাধারণের মধ্যে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন, যাতে আমরা এয়ার পিউরিফায়ারের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা নিজেকে এবং পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে পারি।
মার্টিন ম্যাটসন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর
তিভরাত গার্গ ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া সান ডিয়েগো
মৌলিক জাগনানী টাফটস ইউনিভার্সিটি
আশফাক চৌধুরী ইন্টারন্যাশনাল গ্রোথ সেন্টার এবং আরকেড ফাউন্ডেশন