রাশিয়া যেন কোনোভাবেই খাদ্যকে অস্ত্র বানাতে না পারে

রাশিয়াকে মোকাবিলা করা আন্তর্জাতিক উদ্যোগগুলো অস্বস্তিকর বাস্তবতার মুখে পড়ে কী মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে, তা ইউক্রেন যুদ্ধ দেখিয়ে দিয়েছে। ক্রেমলিনকে বিচ্ছিন্ন করার মূল্য হিসেবে ইতিমধ্যে বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা বিশাল ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ খাদ্য সরবরাহের শৃঙ্খলাকে ব্যাহত করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে এটিই সবচেয়ে বড় আঘাত এবং এটি সম্ভবত আরও কয়েক মাস অব্যাহত থাকবে। পৃথিবী নামক এই গ্রহের পুষ্টির চাহিদার ওপর এই সংঘাতের প্রভাব কমিয়ে আনা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।

রাশিয়ার মতো ইউক্রেনও বিশ্বের বৃহত্তম খাদ্যশস্য ও ভোজ্যতেল সরবরাহকারী দেশ। এই কারণে মস্কো এই ক্রমবর্ধমান খাদ্যসংকটকে কৃত্রিমভাবে আরও বাড়িয়ে তুলছে, যাতে সংকটের শিকার হওয়া বাকি বিশ্ব খাদ্যঘাটতি থেকে বেরিয়ে আসার উপায় হিসেবে ইউক্রেনকে রাশিয়ার কাছে নতিস্বীকার করতে চাপ দেয়।

পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে পশ্চিমা নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই এমন একটি নীতি তৈরি করতে হবে, যার মাধ্যমে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকট মোকাবিলা করা—উভয় লক্ষ্য অর্জন করা যায়। এটি সহজ হবে না, কিন্তু এটি অসম্ভবও নয়।

গত জুলাইয়ের শেষে তুরস্কের মধ্যস্থতায় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছে। সে চুক্তি অনুযায়ী, কৃষ্ণসাগরের মধ্য দিয়ে শস্যের চালান সরবরাহ নির্বিঘ্ন করতে উভয় পক্ষ রাজি হয়েছে। চুক্তিটিতে মস্কো এবং কিয়েভ উভয়কেই যুদ্ধাঞ্চলের বাইরে অতি জরুরি খাদ্যশস্য সরবরাহকারী জাহাজগুলোতে আক্রমণ না করার আহ্বান জানানো হয়েছে। একদিকে রাশিয়া পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনের ওপর তার দখলকে সুসংহত করার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির পশ্চিম-সমর্থিত সরকার দখলকৃত অঞ্চলগুলো থেকে আক্রমণকারী রুশ সেনাবাহিনীকে হটানোর জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অবস্থায় আছে। এই দুই শক্তির রশি–টানাটানির মধ্যে পড়ে ‘বিশ্বের রুটির বাস্কেট’খ্যাত ইউক্রেনে খাদ্য নেওয়ার জন্য প্রবেশ করা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

ইউক্রেন আগে থেকেই অন্যান্য দ্বন্দ্ব, জলবায়ু পরিবর্তন, ক্রমবর্ধমান জ্বালানি খরচ এবং কোভিড-১৯ মহামারি দ্বারা প্রভাবিত ছিল, এরপর এই যুদ্ধ সেখানকার পরিস্থিতিকে শোচনীয় করে তুলেছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দামের ঊর্ধ্বগতি সারের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে এবং যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞা সরবরাহব্যবস্থাকে বিপন্ন করে তুলেছে। একটি বড় বৈশ্বিক সংঘাত এড়াতে এবং একই সঙ্গে রাশিয়াকে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ধ্বংস করা থেকে বিরত রাখতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারা মস্কোকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করতে অর্থনৈতিক ও আর্থিক যুদ্ধের ওপর বহুলাংশে নির্ভর করেছে।

বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর স্বার্থে রাশিয়ার এই সার আরও ভালোভাবে সরবরাহ করা নিশ্চিত করতে হবে। এটি করা হলে রাশিয়াকে খুব বড় ধরনের অর্থনৈতিক সহযোগিতা করা হবে তা নয়। এটি মস্কোকে খুব বেশি সাহায্য করবে না। রাশিয়ার খাদ্যের ওপর নির্ভরতা কমানোর জন্য রাশিয়ার সার রপ্তানিকে সহজতর করা জরুরি।

ক্রেমলিন তার নিজস্ব এবং ইউক্রেনের শস্য সরবরাহকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। যদিও রাশিয়া তার সামরিক উদ্দেশ্যগুলো অর্জন করতে পারছে না এবং তারা আরও আর্থিক চাপের মুখোমুখি হতে পারে; তথাপি খাদ্যশস্যের সরবরাহ ব্যাহত করে ক্ষুধার যন্ত্রণা তারা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে পারে। এ অবস্থায় উন্নয়নশীল বিশ্বে খাদ্যের ঘাটতি এবং মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে লাখ লাখ অভিবাসী ইউরোপে বিপজ্জনক যাত্রার কারণ হতে পারে; যেমনটি আরব বসন্ত এবং ইরাক ও সিরিয়ার যুদ্ধের সময় হয়েছিল। এটি ইউরোপকে রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।

ক্রেমলিন বিশ্বাস করে, জ্বালানির মতো খাদ্যসংকটও গুলি ভরা একটি বন্দুক, যা তারা পশ্চিমের মাথায় ঠেকিয়ে রেখেছে। তবে তেল ও গ্যাসের মতো বিশ্বজনীন স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পদ নিয়ে একটি ভারসাম্যমূলক আইন প্রণয়ন ও তা কার্যকর করা গেলে মস্কোর ওপর চাপ বজায় রাখা যাবে। এটি করা সম্ভব হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অপুষ্টি, দুর্ভিক্ষ, ব্যাপক অভিবাসন এবং মানবিক বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব হবে।

রাশিয়ান প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের ওপর ইউরোপের নিরঙ্কুশ নির্ভরতা ছিল। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মহাদেশটি ধীরে ধীরে সেই আসক্তি থেকে নিজেকে অনেকটা মুক্ত করতে পেরেছে। এই নির্ভরতা পুরোপুরি থেকে মুক্ত হতে আরও সময় লাগবে। জ্বালানির বিকল্প উৎস খুঁজে বের করা একটি দীর্ঘমেয়াদি ও সময়সাপেক্ষ প্রচেষ্টা। কিন্তু অন্যান্য খাদ্য-উৎপাদনকারী দেশগুলো থেকে আরও বেশি শস্য আহরণ ও তা সুরক্ষিত করা এবং এর মাধ্যমে রাশিয়ার খাদ্যকে অস্ত্র বানানোর চেষ্টাকে নস্যাৎ করা তুলনামূলকভাবে সহজ হতে পারে।

সে ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে ফসলের ফলন বাড়াতে ইউক্রেনীয়, রাশিয়ান এবং বেলারুশিয়ান সারের প্রবাহ অব্যাহত রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া অন্যতম প্রধান সার রপ্তানিকারক দেশ। বিশ্বের ২৩ শতাংশ অ্যামোনিয়া, ২১ শতাংশ পটাশ, ১৪ শতাংশ ইউরিয়া এবং ১০ শতাংশ ফসফেটের জোগান দেয় রাশিয়া।

আরও পড়ুন

এই রাসায়নিকগুলোর আন্তর্জাতিক শস্য উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি করার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ার সার আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়নি, তবে রাশিয়ান সার কারখানাগুলোর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এতে সারের অর্থ পরিশোধে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে এবং পরিবহন-সম্পর্কিত বাধাগুলো এই কৌশলটির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।

বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর স্বার্থে রাশিয়ার এই সার আরও ভালোভাবে সরবরাহ করা নিশ্চিত করতে হবে। এটি করা হলে রাশিয়াকে খুব বড় ধরনের অর্থনৈতিক সহযোগিতা করা হবে তা নয়। এটি মস্কোকে খুব বেশি সাহায্য করবে না। রাশিয়ার খাদ্যের ওপর নির্ভরতা কমানোর জন্য রাশিয়ার সার রপ্তানিকে সহজতর করা জরুরি।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • কামরান বোখারি ওয়াশিংটন ডিসির নিউ লাইনস ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসির পরিচালক