ইরাকে মার্কিন হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যে কী ঘটতে চলেছে?

জর্ডানে ড্রোন হামলায় তিন মার্কিন সেনা নিহত হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত নতুন মোড় নেয়ছবি : রয়টার্স

ইরান–সমর্থিত ইরাকের হাশদ আল-শাবি সশস্ত্র গোষ্ঠীর ওপর বিমান হামলার ঘটনা সম্ভবত গত কয়েক বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক আগ্রাসন। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া উত্তেজনাপূর্ণ সংঘাতের মধ্যে এটিকে কেবল একটি কৌশল বলে চিহ্নিত করা যায়। বিশেষ করে ইয়েমেনের হুতিদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সংঘাত ভয়ানকভাবে বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে সেটা বলা যায়।

সিরিয়ায় অবস্থানরত রেভল্যুশনারি গার্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিশানা করে ইসরায়েল তাদের হত্যাকাণ্ড অব্যাহত রেখেছে। তেহরানের দিক থেকে বিরামহীনভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে বলা হচ্ছে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ‘জবাব না দিয়ে তারা চুপ করে বসে থাকবে না’। তেহরানের এই বক্তব্যকে আমরা যদি সত্য বলেও ধরে নিই, তারপরও কিন্তু এত দিন কাসেম সোলাইমানির হত্যাকাণ্ডের (২০২০ সালে হত্যা করা হয়) বাদলা নিতে আমরা দেখিনি।

যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলা জর্ডান, সিরিয়া ও ইরাকের সংযোগস্থলে অবস্থিত কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ড্রোন হামলায় তিন সেনা নিহত হওয়ার প্রতিশোধ। আইএসআইএস ঠেকাতে একটি আন্তরাষ্ট্রীয় নেটওয়ার্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে যুক্তরাষ্ট্রকে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। এর মধ্যে তেহরানের সমর্থনপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠী ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে চলেছে।

সুতরাং তেহরান-সমর্থিত প্রক্সি যোদ্ধারা যে মার্কিন অবস্থান লক্ষ্য করে অবিরাম হামলা করে যাবে, সেটা মোটেই আশ্চর্যের ঘটনা নয়। মার্কিন সেনাদের ওই স্থান থেকে চলে যেতে বাধ্য করানোর জন্য গত ৭ অক্টোবর থেকে মার্কিন লক্ষ্যবস্তুগুলোর ওপর অন্তত ১৬০ বার হামলা হয়েছে।

ইরাক সরকারের একজন মুখপাত্র এই সংঘাতের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের ভূখণ্ডকে ‘অতীতের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার যুদ্ধক্ষেত্র’ হিসেবে ব্যবহার করছে। বহু বছর ধরে ইরাকের ওপর যে জুলুম চলে আসছে, তা যথার্থভাবে প্রকাশ পায় ইরাকি মুখপাত্রের এই বক্তব্যে।

এসব বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র এখন পাগলের মতো ইসরায়েলের সঙ্গে আরবের সম্প্রীতি যাতে প্রতিষ্ঠা পায়, সে জন্য উচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছে। ওয়াশিংটন এখন চাইছে ইসরায়েল যাতে দুই রাষ্ট্র সমাধান মেনে নেয় এবং হামাস যাতে বন্দীদের মুক্তি দেয়। এই সুবিশাল প্রকল্প বাস্তব রূপ পেলে সেটা অবশ্যই মধ্যপ্রাচ্যে বড় একটা পরিবর্তন সূচনা করবে।

ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীর জোট হাশদ আল-শাবি গড়ে ওঠে ২০১৪ সালে। সম্ভবত আইএসআইএসের সঙ্গে যুদ্ধ করার উদ্দেশ্য থেকেই হাশদ আল-শাবির যাত্রা। কিন্তু আইএসআইএসের পরাজয়ের পর হাশদ আল-শাবি লোকবল ও অর্থবলে ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করে। বর্তমানে গোষ্ঠীটির জনবল ২ লাখ ৪০ হাজার। লোকবলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাজেটও বেড়েছে। আর এই অর্থের জোগান উদারভাবেই ইরাক সরকার দিয়ে আসছে। ‘প্রতিরোধের অক্ষশক্তি’ হিসেবে পরিচিত এই গোষ্ঠী শুধু ইরাক ও সিরিয়া নয়, গোটা অঞ্চলেই আধিপত্য বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে নেমেছে।

হুতিদের মতোই হাশদ আল-শাবির কয়েকটি উপদলের প্রশিক্ষণ হয় ইরানের কুদস ফোর্স ও লেবাননের হিজবুল্লাহর অধীন। ইরানের নির্দেশে এই সশস্ত্র গোষ্ঠী হামলা চালালেও অনেক ক্ষেত্রেই তারা বুনো বিড়ালের মতো বন্য আচরণ করে। দৃষ্টান্ত হিসেবে, হাশদ আল-শাবির ইরাকি অংশের উপদল হিজবুল্লাহ আল-নুজাবা ও কাতা’ইব হিজবুল্লাহর কথা বলা যায়। এ দুই উপদলের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা হয়, কে কাকে ছাপিয়ে বিদেশি বাহিনীর ওপর নির্লজ্জভাবে হামলা চালাবে।

যা–ই হোক, যুক্তরাষ্ট্র এবার যে শক্তভাবে পাল্টা ব্যবস্থা নিতে চলেছে, সেটা বুঝতে পেরে কাতা’ইব হিজবুল্লাহর নেতা আহমদ আল-হামাদি খুব দ্রুত পিছুটান দিয়েছেন। আহমদ আল-হামাদি ঘোষণা দিয়েছেন, তাঁর বাহিনী মার্কিনদের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা স্থগিত করেছে। এই গোষ্ঠীর শুরা পরিষদে কুদস বাহিনীর সদস্য থাকলেও ইরানের সংশ্লিষ্টতায় হামলা চালানোর বিষয়টি তারা খুব জোরালোভাবে অস্বীকার করেছে।

অন্যদিক হিজবুল্লাহ আল-নুজুবা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীর ‘কাপুরুষোচিত’ কর্মকাণ্ডে বিদ্রূপ প্রকাশ করেছে। তারা হামলা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করেছে।

কাতা’ইব হিজবুল্লাহ দাবি করেছে, ইরাক সরকার যাতে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে না পড়ে, সে জন্য তারা হামলা বন্ধ রেখেছে। কিন্তু এই গোষ্ঠী জন্মের পর থেকেই ইরাকের সার্বভৌমত্বকে যেভাবে বিপদে ফেলে আসছে, সেই বিবেচনায় তাদের এই দাবি নিছক হাস্যকর। গোষ্ঠীটি ইরাক সরকারের অংশীদার। অথচ ইরাক সরকার যে পরাশক্তির ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল, তাদের ওপরই হামলা করছে কাতা’ইব হিজবুল্লাহ।
লেবানন যদি বড় পরিসরে আঞ্চলিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে দেশটির হাজারো মানুষ হতাহত ও বাস্তুচ্যুত হতে পারে।

এদিকে গাজা সংঘাত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে তরুণদের মধ্যে ব্যাপক অজনপ্রিয় করে তুলেছে। মার্কিন আইনসভায় ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের প্রতিনিধিত্ব যেখানে সমানে-সমান; সেখানে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য ফিলিস্তিনের প্রতি সংবেদনশীল বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সমর্থন পাওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে আবার পশ্চিম তীরে যে সহিংসতার সুনামি চলছে, সেখানে মাত্র চারজন ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাইডেন প্রশাসনের এই পদক্ষেপ চরম হাস্যকর।

ইরাকে মার্কিন হামলার প্রসঙ্গে হোয়াইট হাউসের নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন কারবি বলেন, ‘এই হামলার উদ্দেশ্য হলো হামলা বন্ধ করা। আমরা ইরানের সঙ্গে একটা যুদ্ধ শুরু করতে যাচ্ছি না।’ কিন্তু তেহরানকে জবাবদিহির আওতায় না আনতে পারলে মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে যেসব হামলার ঘটনা ঘটছে, সেগুলো বন্ধ করা যাবে না।

এসব ঝুঁকি এবং ঘণ্টায়-ঘণ্টায় জন্ম নেওয়া অসহনীয় উত্তেজনা থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে গাজা যুদ্ধ বন্ধ করা। ইসরায়েল এখন পর্যন্ত দৃশ্যমানভাবে হামাস নির্মূল করতে ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং গাজায় তাদের সামরিক অভিযানের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা। হাজারো ফিলিস্তিনের জীবনের বিনিময়ে নেতানিয়াহুর ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা হচ্ছে। কিন্তু গাজা যুদ্ধ যেকোনো সময় তা সবচেয়ে খারাপ কিছু বয়ে নিয়ে আসতে পারে।

এসব বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র এখন পাগলের মতো ইসরায়েলের সঙ্গে আরবের সম্প্রীতি যাতে প্রতিষ্ঠা পায়, সে জন্য উচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছে। ওয়াশিংটন এখন চাইছে ইসরায়েল যাতে দুই রাষ্ট্র সমাধান মেনে নেয় এবং হামাস যাতে বন্দীদের মুক্তি দেয়। এই সুবিশাল প্রকল্প বাস্তব রূপ পেলে সেটা অবশ্যই মধ্যপ্রাচ্যে বড় একটা পরিবর্তন সূচনা করবে।

কিন্তু তার জন্য নেতানিয়াহুকে অবশ্যই রক্তপাত বন্ধ করতে হবে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতি তার বৈরিতার অবসান ঘটাতে হবে। আর তেহরানকে তাদের প্রক্সি যোদ্ধাদের ব্যবহার করা বন্ধ করতে হবে।

  • বারিয়া আলামুদ্দিন মধ্যপ্রাচ্য ও যুক্তরাজ্যের সম্প্রচারকর্মী এবং পুরস্কারজয়ী সাংবাদিক আরব নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত