আমাদের দেশে নিয়ম আছে, তবে মানতে নেই!

বাংলাদেশের বেশির ভাগ অফিস-আদালতে ঢুকলেই প্রথমে মনে হয়, আমরা এক শৃঙ্খলাপূর্ণ, আইননিষ্ঠ স্বর্গরাজ্যে বাস করছি। দেয়ালে বাঁধানো ফ্রেমে নিয়মকানুনের তালিকা ঝুলছে, নোটিশ বোর্ডে লেখা রয়েছে নাগরিক সেবার প্রতিশ্রুতি, আর টেবিলের ওপর ফাইলের স্তূপ দেখে মনে হয়, এখানে সময়, কাজ আর ন্যায়বিচারের জয়জয়কার চলছে।

কিন্তু করিডরে মাত্র কয়েক পা বাড়ালেই বোঝা যায়, আসল মহোৎসব চলছে অপেক্ষার হলঘরে, যেখানে সেবাপ্রার্থী নাগরিকেরা ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে ধৈর্যের লড়াই করছেন, আর দায়িত্বপ্রাপ্তরা ব্যস্ত আছেন অদৃশ্য ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’ কাজে। এখানে নিয়ম আছে, কিন্তু তা মানার তাগাদা নেই। দায়িত্ব আছে, কিন্তু পালন করার ইচ্ছা নেই। পুরো ব্যাপারটা যেন এক অনন্ত মঞ্চনাটক। স্ক্রিপ্ট ঠিক আছে, অভিনেতারা মেকআপ করে প্রস্তুত, কিন্তু অভিনয় করার মুড নেই কারও।

সরকারি দপ্তরে ফাইলের গতি দেখে মনে হয়, ফাইলগুলো যেন যোগব্যায়ামের শবাসনে শুয়ে আছে, যেখানে বসে একবার আরাম পেলে আর নড়াচড়া করতে চায় না। নিয়ম বলে, ফাইল কয়েক মিনিট কিংবা ঘণ্টার মধ্যে এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে যাবে। কিন্তু বাস্তবে ফাইল এক টেবিলে এমন আরাম পায় যে দিন, সপ্তাহ, এমনকি মাসও কেটে যায়।

আদালতের গল্পও কম রঙিন নয়। মামলার তারিখ আসে, আবার যায়; যেন ঋতুর পরিবর্তন। সাক্ষী হাজির হননি, নথি প্রস্তুত হয়নি বা আইনজীবীর জরুরি কাজ আছে—এমন অজুহাতের যেন অভাব নেই। মামলার ইতিহাস অনেক সময় এত দীর্ঘ হয় যে তা বংশপরম্পরায় গল্প হয়ে যায়, ‘এই মামলা তোমার দাদার আমলে হয়েছিল, এখনো চলছে।’

দেশের সব জায়গায় এখন ম্যানেজমেন্ট সংস্কৃতি এক অনন্য শিল্পে পরিণত হয়েছে। কোনো লাইসেন্স লাগলে, ফাইল কমপ্লিট করাতে হলে, ডাক্তারের সাক্ষাৎ চাইলে সরাসরি বলা হবে না যে টাকাপয়সা লাগবে। কিন্তু ইঙ্গিত দেওয়া হবে—সময় লাগবে, তবে চাইলে একটু তাড়াতাড়ি করা যেতে পারে।

এদিকে আবার সরকারি হাসপাতাল হলো এ ব্যস্ত অলসতার আলাদা চ্যাপটার। সকালে হাসপাতালে ঢুকলে মনে হবে, এখানে চিকিৎসার চেয়ে লাইন দেওয়ার মহড়া চলছে। রেজিস্ট্রেশন কাউন্টারে ভিড় ঠেলে রোগী পৌঁছালে দেখা যায়, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী সাইন ইন করে নাশতায় বের হয়েছেন।

ডাক্তারের কক্ষ খালি, অথচ টেবিলের ওপর স্টেথিসকোপ আর প্রেসক্রিপশন প্যাড এমনভাবে রাখা যেন ডাক্তার সাহেব মুহূর্তেই এসে বসবেন। কিন্তু মুহূর্ত মানে এখানে এক ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা, কখনো অর্ধেক দিন। রোগীর বেড কম, ওষুধের অভাব চিরন্তন, আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট পেতে হলে কয়েক দিন ঘুরতে হয়। অনেক সময় রোগী ভালো হয়ে যায়, কিন্তু রিপোর্ট আসে না!

শিক্ষক হিসেবে নিজেদের কথাও তো বলতে হয়! দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক অফিসগুলোতেও এক ব্যতিক্রমী নাটক মঞ্চস্থ হয়। শিক্ষার্থী সার্টিফিকেট-মার্কশিট তুলতে গেলে প্রথমে জানতে পারে, ফাইল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পরে জানা যায়, ফাইল আছে, কিন্তু এক গুরুত্বপূর্ণ সই বাকি। সেই সই নেওয়ার জন্য তাকে তিন তলা থেকে পাঁচ তলায়, সেখান থেকে রেজিস্ট্রার অফিস, আবার প্রভোস্ট অফিসে ঘুরতে হয়। প্রতিটি অফিসে নতুন অজুহাত, নতুন নির্দেশ।

শিক্ষকেরা নিজের গবেষণা বা ক্লাসের কাজ বাদ দিয়ে প্রশাসনিক নথিপত্রের জন্য, পরীক্ষার বিলের জন্য দিনের পর দিন ধৈর্যের পরীক্ষা দেন। অনেক সময় একটি ছোট্ট কাগজে একটি সই করাতে যত দৌড়াদৌড়ি করতে হয়, ততটা নোবেল প্রাইজ জিততেও লাগে না!

আমাদের দায়িত্বের সংজ্ঞা এখানে (দেশের সবখানে) অভিনব। দায়িত্ব মানে অফিসে উপস্থিতি, সাইন ইন, আর মাঝেমধ্যে চায়ের কাপে চুমুক, ফ্রি পত্রিকায় চোখ বোলানো। সকালে টাইম কার্ডে সাইন ইন করে কেউ বাজারে চলে যান, কেউ ব্যাংকে, কেউবা সোজা বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নেন। অফিসে বসে থেকে কাজ করা এখানে ‘অতিরিক্ত যোগ্যতা’।

জনসেবা দপ্তরে গিয়ে যদি নাগরিক কোনো সেবা চান, তাঁকে প্রথমেই বলা হবে, ‘আপনার কেসটা একটু জটিল’। এই ‘জটিল’ শব্দটির আসল অর্থ হলো, আপনি অন্তত তিন-চারজন ভিন্ন কর্মকর্তার টেবিলে ঘুরবেন, আর প্রতিটি টেবিল থেকে একটি নতুন কাগজ বা সিল আনার নির্দেশ পাবেন। আপনার ফাইলও এক ডেস্ক থেকে আরেক ডেস্কে ‘শরীরচর্চা’ করবে, তবে মূল কাজ এগোবে না।

তাই দেশের সব জায়গায় এখন ম্যানেজমেন্ট সংস্কৃতি এক অনন্য শিল্পে পরিণত হয়েছে। কোনো লাইসেন্স লাগলে, ফাইল কমপ্লিট করাতে হলে, ডাক্তারের সাক্ষাৎ চাইলে সরাসরি বলা হবে না যে টাকাপয়সা লাগবে। কিন্তু ইঙ্গিত দেওয়া হবে—সময় লাগবে, তবে চাইলে একটু তাড়াতাড়ি করা যেতে পারে।

আদালতে জামিনের কাগজ নিয়মে ছয় মাস লাগবে, কিন্তু সঠিক ‘চাবি’ পেলে দুই দিনেই হয়ে যাবে। নিয়ম আছে, কিন্তু তা মানতে গিয়ে আপনি যদি ধৈর্য হারান, তার দায় আপনারই। কারণ, এই দেশে নিয়ম মেনে চলা একপ্রকার বিলাসিতা। দিন শেষে তাই সবাই ‘ম্যানেজ’ করে যার যার কাজ উদ্ধারের চেষ্টায় ব্যস্ত।

জবাবদিহির অভাব এই নাটকের সবচেয়ে বড় রহস্য। কেউ দায়িত্বে গাফিলতি করল, তাতে তার কী ক্ষতি? প্রায়ই কিছুই না। অডিট রিপোর্ট, ওয়ার্ক প্রোফাইল শুধু রিপোর্ট আকারে জমা থাকে, আর দুর্নীতি দমন কমিশন মাঝেমধ্যে বড় বড় ফাইল হাতে ছবি তোলে। ছোটখাটো অবহেলা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, যেন এগুলো ‘সিস্টেমের প্রাকৃতিক নিয়ম’। আর যখন কর্তারা-কর্মীরা জানেন, কিছু না করলেও কিছু হবে না, তখন কেন তাঁরা মাথা ঘামাবেন?

অফিসে সময় কাটানোও একধরনের শিল্পে পরিণত হয়েছে। একটি আবেদন নিয়ে আপনি ঢুকবেন, আর সেই আবেদন এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে ‘ভ্রমণ করবে’। প্রতিটি নতুন ডেস্কে আপনাকে নতুন একটি কারণ দেখিয়ে আবার শুরুতে ফেরত পাঠানো হবে। প্রযুক্তি দিয়ে এসবের সমাধান করা যেত। অনলাইন আবেদন, ফাইল ট্র্যাকিং, ডিজিটাল স্বাক্ষর—সবই সম্ভব, কিছু জায়গায় শুরুও হয়েছে।

কিন্তু প্রযুক্তি এলে শর্টকাটের পথগুলো বন্ধ হয়ে যায়। তাই প্রযুক্তি ঢুকলেও পুরোনো কাগজ-কলমের পদ্ধতি সচল রাখা হয়, যাতে ‘ম্যানেজ’ সংস্কৃতি অক্ষত থাকে। প্রযুক্তি এখানে অনেকটা ‘শোপিস’ দেখানোর জন্য ভালো, কিন্তু কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে নানা অজুহাত।

দিন শেষে এসবের পরিবর্তন চাইলে লাগবে কঠোর শাস্তি, স্বচ্ছ প্রক্রিয়া, ভালো কাজের পুরস্কার, আর সর্বোপরি মানসিকতার পরিবর্তন। দায়িত্ব মানে শুধু অফিসে বসে থাকা নয়; বরং সত্যিই কাজ করা, এটা আমাদের মনে গেঁথে দিতে হবে। কাজ এগোনোর জন্য নাগরিককে ঘুষ, পরিচিতি বা অসংখ্য অপ্রয়োজনীয় কাগজের ঝামেলায় ফেলা বন্ধ করতে হবে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বুঝতে হবে, অফিসের চেয়ার কেবল বসার জন্য নয়; বরং কাজের জন্য।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা কি সত্যিই এই পরিবর্তন চাই? নাকি গোপনে খুশি আছি এই সিস্টেমে, যেখানে নিয়ম মানতে হয় না, কিন্তু নিজের কাজ ঠিকই ম্যানেজ হয়ে যায়? হয়তো এ কারণেই বছরের পর বছর আমরা একই কৌতুক শুনে যাচ্ছি, ‘বাংলাদেশে নিয়ম আছে, তবে মানতে নেই।’

এই কৌতুক এতবার বলা হয়েছে যে এখন সেটাই আমাদের প্রশাসনিক সংস্কৃতির অফিশিয়াল সংজ্ঞা হয়ে গেছে।

  • ড. ইকবাল আহমেদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক