যত দূর মনে পড়ে, ১৯৯২ সালের বড়দিনের আগের রাতেই আমি প্রথম বুঝেছিলাম, সান্তা ক্লজ বলে আসলে কেউ নেই। তখন আমার বয়স ১০। টেক্সাসের অস্টিনে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ি। টুথ ফেয়ারি আর ইস্টার বানির গল্প (টুথ ফেয়ারি হলো সেই কাল্পনিক চরিত্র, যে নাকি শিশুর দুধদাঁত পড়লে বালিশের নিচে রেখে গেলে এসে দাঁতের বদলে টাকা বা উপহার দিয়ে যায়। আর ইস্টার বানি হলো আরেকটি কল্পিত চরিত্র, যে নাকি ইস্টারের সময় শিশুদের জন্য ডিম বা উপহার লুকিয়ে রাখে।) আগেই ভেঙে গিয়েছিল।
কিন্তু শৈশবটা পুরোপুরি ছাড়তে মন চাইছিল না বলে হয়তো সান্তাকে ধরে রেখেছিলাম যত দিন পারি। একদিন দেখি, আমার মা–বাবাই সেই উপহারগুলো দিচ্ছেন, যেগুলো নাকি উত্তর মেরু থেকে এসেছে। সেই দিন আমি কেঁদেছিলাম।
তিন দশকের বেশি সময় পরে এসে এই ছুটির মৌসুমে অনেক মার্কিন একই রকম প্রতারিত বোধ করছেন আরেকজন লাল পোশাকের মানুষকে ঘিরে। তবে সেটা লাল সান্তা নন, সেটা ‘মাগা লাল’। অর্থাৎ ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ট্রাম্প নিজেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বড় হাতের অক্ষরে দাবি করেছেন, ভেনেজুয়েলা নাকি আগে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ‘তেল, জমি ও অন্যান্য সম্পদ’ চুরি করেছে। বৃহস্পতিবার এনবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি ভেনেজুয়েলার সঙ্গে যুদ্ধের আশঙ্কাও নাকচ করেননি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার ক্ষমতায় ফিরে প্রায় এক বছর পূর্ণ করতে চলেছেন। এ সময়ে তিনি তাঁর মূল প্রতিশ্রুতিগুলোর প্রায় কোনোটা পূরণই করতে পারেননি। একমাত্র ব্যতিক্রম হলো উন্মত্তভাবে অভিবাসী তাড়ানো। সেটাই দেশটাকে ‘হলি, জলি’ বড়দিনের আবহে একধরনের পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।
রয়টার্স ও ইপসোসের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা নেমে এসেছে ৩৯ শতাংশে। কারণ, সাধারণ মানুষ ভয়াবহ জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে লড়ছে। ফল, সবজি আর মাংসের দাম আকাশছোঁয়া। ভাড়া ও বিদ্যুতের বিলও বাড়ছেই।
এ বছরের ফেডারেল সরকার শাটডাউনের সময় লাখো মানুষ বাস্তব অর্থেই অনাহারের আশঙ্কায় পড়েছিল। ‘আমেরিকাকে আবার মহান করো’ স্লোগানের সঙ্গে এ বাস্তবতার কোনো মিল নেই। শাটডাউনের কারণে চাকরি গেছে বহু মানুষের। বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৬ শতাংশে, যা প্রায় পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
রয়টার্সের ভাষায়, অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, ট্রাম্পের আমদানি শুল্কের ধাক্কায় নিয়োগ দেওয়া থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে নিয়োগকর্তারা। বাস্তব দুনিয়ার হিসাব অনুযায়ী, মার্কিন অর্থনীতি ঠিক করার প্রতিশ্রুতিতে ট্রাম্প পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু নিজের কল্পনার জগতে তিনি বর্তমান অর্থনীতিকে দিয়েছেন ‘এ+++++’ নম্বর। আর ‘খরচ চালানো কঠিন’—এ সংকটকে তিনি উড়িয়ে দিচ্ছেন ডেমোক্র্যাটদের বানানো ‘ভুয়া গল্প’ বলে।
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র কখনোই খুব সাশ্রয়ী দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল না। তাতে তো নির্মম পুঁজিবাদ আর ধনীদের শাসনব্যবস্থার মূল ভিত্তিই নড়ে যেত। রিপাবলিকান আর ডেমোক্র্যাটরা নিজেদের আদর্শগত বিরোধী বলে দাবি করলেও বাস্তবে তারা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। দুই দলই এমন এক বর্ণবাদী অভিজাত শাসন টিকিয়ে রাখে, যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর একটিতে দারিদ্র্যই মৃত্যুর বড় কারণ হয়ে থাকে।
এখন আমি ছুটিতে কেনটাকির লুইসভিলে মায়ের সঙ্গে আছি। কদিন আগে সুপারমার্কেটে গিয়ে আমাদের খরচ হয়েছে ২৩৭ দশমিক ২৭ ডলার। অর্থাৎ দক্ষিণ মেক্সিকোর সমুদ্রতটে আমার বাড়ির প্রায় এক মাসের ভাড়ার সমান। তা–ও আমাদের শপিং কার্ট ভরা ছিল না। মাত্র একটি মাংসের পণ্য ছিল। কোনো মদ্য পানীয়ও ছিল না।
এই লুইসভিল শহরই ২০২০ সালের মার্চে নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গ নারী ব্রিওনা টেলরকে পুলিশ গুলি করে হত্যার জন্য কুখ্যাত হয়েছে। তিনি ছিলেন ২৬ বছরের এক জরুরি বিভাগের কর্মী। চলতি বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ টেলর হত্যায় দোষী সাব্যস্ত এক সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার জন্য মাত্র এক দিনের কারাদণ্ড চেয়েছিল। ঘটনাটি ঘটেছিল ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের সময়। শেষ পর্যন্ত সেই কর্মকর্তা ৩৩ মাসের সাজা পান।
তাই বড়দিনের ইচ্ছার তালিকায় যদি কাঠামোগত বর্ণবাদ বা পুলিশি সহিংসতার অবসান থাকে, তাহলে হতাশ হওয়াই নিয়তি।
বিচার বিভাগের সাম্প্রতিক আরেক কাণ্ডও কম গুরুতর নয়। শিশু যৌন নির্যাতনকারী ও ধনকুবের জেফরি এপস্টেইনের মামলার সঙ্গে সম্পর্কিত অন্তত ১৬টি নথি হঠাৎই বিচার বিভাগের ওয়েবসাইট থেকে উধাও হয়ে গেছে। সেগুলো প্রকাশের কিছুক্ষণের মধ্যেই হারিয়ে যায়। এর একটি ছিল ট্রাম্পের একটি ছবি। এর আগে এপস্টেইন–সংক্রান্ত নথি প্রকাশে সরকারের বাধা নিয়ে দেশজুড়ে যে ক্ষোভ হয়েছিল, ট্রাম্প সেটাকেও ‘ডেমোক্র্যাটদের ভুয়া ষড়যন্ত্র’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।
আর যেসব নথি প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর অনেকটাই কালো করে ঢেকে দেওয়া। এপস্টেইনের এক ভুক্তভোগী মারিনা লাসেরদার ভাষায়, এটি ছিল ভুক্তভোগীদের মুখে আরেকটি চপেটাঘাত।
সব মিলিয়ে দেশের ভেতরের চিত্র বড়দিনের আনন্দ জাগায় না। যদিও এসব কথা বললেই আমাকে আবার ‘ভুয়া খবর’ ছড়ানোর অভিযোগ শুনতে হয়।
এদিকে উৎসবের এ সময়েই ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার আশপাশে নৌকায় নির্বিচার বোমাবর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নাবিকদের বিচারবহির্ভূত হত্যা। সবই নাকি ভেনেজুয়েলার ‘নারকোটেররিজম’ দমনের নামে। এখন যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার তেলবাহী ট্যাংকার ছিনতাইয়ের অনুমতিও দিয়েছে।
ট্রাম্প নিজেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বড় হাতের অক্ষরে দাবি করেছেন, ভেনেজুয়েলা নাকি আগে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ‘তেল, জমি ও অন্যান্য সম্পদ’ চুরি করেছে। বৃহস্পতিবার এনবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি ভেনেজুয়েলার সঙ্গে যুদ্ধের আশঙ্কাও নাকচ করেননি।
পৃথিবীর আরেক প্রান্তে, গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের গণহত্যা অব্যাহত আছে। এটি চলছে ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় হওয়া এক কথিত যুদ্ধবিরতির আড়ালে। তাঁর ডেমোক্র্যাট পূর্বসূরি জো বাইডেনের মতো ট্রাম্পও এই গণহত্যাকারী রাষ্ট্রকে মার্কিন করদাতাদের কোটি কোটি ডলার ঢেলে দিয়েছেন। এ যেন বড়দিনের মোজায় রাখা এক বিশাল ‘উপহার’।
প্রতিবছর বড়দিন আসে, আবার চলেও যায়। কিন্তু সত্যি বলতে, এ উৎসব মৌসুমে খুশি হওয়ার মতো কিছুই নেই।
বেলেন ফার্নান্দেজ রাজনৈতিক লেখক ও আল-জাজিরার নিয়মিত কলাম লেখক
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ