প্রতিবাদ না করে ঘাস-ফুল-লতাপাতায় মজে যাচ্ছি কেন আমরা

প্রযুক্তিনির্ভর এই অস্থির সময়ে মানুষের আচরণ বদলে গেছে। কমে গেছে মানুষের ধৈর্য-সহ্য। সমালোচনা মোকাবিলার ক্ষমতা উবে গেছে। জুলুম ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই বিপদ। বিপদমুক্ত থাকতে অনেক সরব বিপ্লবী হয়ে গেছেন নীরব। দ্রোহের কবি হয়ে গেছেন প্রেমের কবি। প্রতিবাদী লেখক-বক্তা এখন নদী, পাহাড় ও সাগরের সৌন্দর্যে মজে বনে গেছেন পর্যটক ও প্রকৃতিপ্রেমী।

অবশ্য প্রকৃতি, নদীনালা, লতাপাতা ও বাতাবি লেবুর বাম্পার ফলনে মজে থাকাই নিরাপদ। প্রতিবাদ করে খাল কেটে কুমির আনার কী দরকার! সমাজের বেশির ভাগ মানুষ এখন নিজেই নিজের দর্শন ঠিক করে কায়দা-কৌশলে বেঁচে থাকে। ভেজাল ও ক্যাঁচালে কেউ যেতে চায় না। তাই বাড়ির পাশে প্রভাবশালী কোনো ব্যক্তি অসহায় কারও হক কেড়ে নিলে, ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করলে অথবা অন্যায়ভাবে জমি দখল করে নিলেও কেউ কোনো কথা বলতে চায় না। চলতি পথে অন্যায় চোখে পড়লেও মানুষ প্রতিবাদ না করে চোখ অন্যদিক ঘুরিয়ে নিজের গন্তব্যে চলে যায়। এমনকি অন্যায়ের প্রতিবাদ জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিতে পর্যন্ত মানুষ এখন ভয় পায়।

কয়েক বছর আগেও যাঁদের ফেসবুকে বিভিন্ন ইস্যুতে সত্য ও ন্যায়নিষ্ঠের পক্ষে জ্বালাময়ী পোস্ট দিতে দেখেছি, তাঁরা বর্তমানে ফুল-ফল-প্রকৃতির বন্দনায় ব্যস্ত। কারণ যেভাবেই হোক, এই ধারণা মানুষের মনের মধ্যে ঢুকে গেছে, ন্যায্য বা হক কথা বললেই বিপদ। পরিণতি ভয়ংকর। তাই ইদানীং নিজের সংকট সাংবাদিকদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মানুষের বক্তব্য দিতে আগ্রহ বেশি।

২.

ছোটবেলায় শেখা—‘সর্বদা সত্য কথা বলব’, ‘অন্যায়ের প্রতিবাদ করব’—এসব কথা এখন বইয়ের পাতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সমাজে অন্যায়, অবিচার ও জুলুমের প্রতিবাদের সব দায় যেন সাংবাদিকদের। আবার দিন শেষে নানা গঞ্জনা, বঞ্চনা ও অপবাদই জুটে সাংবাদিকদের কপালে। জুলুম, অন্যায়, দুর্নীতি ও দূষিত সমাজের সংস্কার না চেয়ে আমরা শুধু সাংবাদিকদের কাছে ফেরেশতার ভূমিকা প্রত্যাশা করি। মুশকিল আসানের হাতিয়ার হিসেবে তাঁদের ওপরই ভরসা করি।

এটা ভাবা হয় না, সাংবাদিকেরাও রক্তে-মাংসের মানুষ, তাঁরাও এই দূষিত সমাজেরই অংশ, তাঁদেরও সীমাবদ্ধতা আছে। আছে জীবনের ভয়ডর। তবে এটাও তো ঠিক সাংবাদিকতার বিষয়টিকে মানুষ অন্যভাবে বিবেচনা করে। তাই সাংবাদিকদের কাছে মানুষের প্রত্যাশাটাও ভিন্ন রকম। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নানা ছলাকলায় সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিবাদী মানুষ ও সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণ করে রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি ও বর্তমান বাস্তবতা যেন এমন—এই সমাজে অন্যায় বা জুলুম করলে কিছু হয় না; বরং প্রতিবাদ করলেই দোষ।

৩.

সংবাদ প্রকাশের জেরে অনলাইন নিউজপোর্টাল বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জামালপুর জেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক গোলাম রব্বানি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। ১৫ জুন দুপুরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। গোলাম রব্বানির স্বজনেরা বলছেন, সংবাদ প্রকাশের জেরে বকশীগঞ্জ উপজেলার সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম লোকজন দিয়ে তাঁকে হত্যা করিয়েছেন।

এই হত্যাকাণ্ডে বিচার কি হবে? বিচার হলেইবা কী? যেজন চলে গেলেন, তিনি তো আর ফিরবেন না। পরিবারে যে অসীম শূন্যতা তৈরি হলো, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন আরও বেড়ে গেল, তা তো পূরণ হওয়ার নয়। তিন সন্তান নিয়ে অথই সাগরে পড়া নিহত গোলাম রব্বানির স্ত্রী মনিরা বেগম এখন কী করবেন? স্বজনেরা কীভাবে পাবেন সান্ত্বনা। ‘যার চলে যায় সেই বোঝে যে হায়, বিচ্ছেদে কী যন্ত্রণা।’

৪.

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অন্যায়কারী ও প্রভাবশালীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। এখন কেউ জোরালোভাবে প্রতিবাদ করলে তাঁকে হুমকি দেওয়া হয়। এরপরও প্রতিবাদ করলে করুণ পরিণতি নেমে এসে। হামলা-মামলা ছাড়াও বাড়ির পাশে বা নদীর ধারে কিংবা ঝোপজঙ্গলে মেলে প্রতিবাদকারীর লাশ। আগে তো এমন ছিল না। এখন প্রতিবাদ করলেই লাশ হয়ে যেতে হয় কেন? কয়েক বছরের ব্যবধানে প্রভাবশালী ও জুলুমকারীদের এত অধঃপতন কীভাবে হলো, সেটা অবশ্য ভাবনার বিষয়, রাজনীতির বিষয়ও হতে পারে।

৫.

মাঝেমধ্যে ভাবি, কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর সময়ে যেসব কথা, পঙ্‌ক্তি ও বাক্য লিখে গেছেন, তিনি যদি এই সময়ে বেঁচে থেকে সেসব লিখতেন, তাহলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের গ্যাঁড়াকলেই তাঁরা জীবন ফানা হয়ে যেত। তা ছাড়া মানুষের চেতনা-অনুভূতিসহ নানা অনুভূতিতে আঘাত লাগায় প্রায়ই তিনি হামলার শিকার হতেন।
সমাজের এমন পরিস্থিতি থেকে মুক্তির কি কোনো পথ নেই? পথ নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু সেই পথের পথিকের অভাব। রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো শুদ্ধ ও মজবুত হলেই সমাজের অনেক দূষণ, দুর্নীতি, জুলুম-অন্যায় দূর হয়ে যায়। এসব দূর করতে সুনীতির ফেরিওয়ালা দরকার। সেই ফেরিওয়ালা ফিরবেন কি সমাজে?

  • তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোর সহসম্পাদক
    ই-মেইল: [email protected]