গত ২৭ জুন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে টিভি বিতর্কে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিপর্যয়কর পরাজয়ের পর ডেমোক্রেটিক পার্টির চাঁদাদাতারা নভেম্বরের নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে বাইডেনকে স্বীকৃতি দেওয়া-না দেওয়া নিয়ে ধন্দে পড়ে গেছেন।
অনেক ধনী চাঁদাদাতা ডেমোক্র্যাট প্রার্থীর প্রচার শিবিরে আর্থিক সহায়তা দেওয়া স্থগিত করেছেন। তাঁরা বলছেন, বাইডেনের জায়গায় অন্য কোনো যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী দাঁড় না করানো পর্যন্ত তাঁরা চাঁদা দেবেন না। বাইডেনের বদলে নতুন প্রার্থী দেওয়া হলে তাঁরা আবার চাঁদার অর্থ ছাড় করতে শুরু করবেন।
এসব চাঁদাদানকারী প্রতিষ্ঠানের একটি হলো ডিজনি ফ্যামিলি ফরচুনের শাখা প্রতিষ্ঠান অ্যাবিগেল ডিজনি। এই অ্যাবিগেল ডিজনি চাঁদা স্থগিত করার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সিএনবিসিকে বলেছে, ‘বাইডেন এখনই সরে না দাঁড়ালে ডেমোক্র্যাটরা নিশ্চিতভাবে হেরে যাবেন।’
আউটলেটটি তাদের মোরিয়া ফান্ডের সভাপতি জিডেন স্টেইনের একটি উদ্ধৃতি দিয়েছে, যেখানে জিডেন বলেছেন, ‘যতক্ষণ না বাইডেনকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ততক্ষণ আমার পরিবার এবং আমি যে ৩০ লাখ ডলার অনুদান দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম, সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন থেকে বিরত থাকছি।’
সত্যি কথা বলতে, ৯ মাস ধরে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের চালানো গণহত্যায় বাইডেনের সমর্থন দিয়ে যাওয়ার চেয়ে এই নির্বাচনী বিতর্কে তাঁর হেরে যাওয়াটা অনেক কম গুরুতর রাজনৈতিক সীমা লঙ্ঘন। বাইডেন এত দিন গাজা ইস্যুতে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড সমর্থন করে দাতাদের কাছ থেকে কোনো বাধা পাননি; বরং তাঁদের কাছ থেকে তিনি প্রশংসাই পেয়ে এসেছেন; কিন্তু এখন টিভি বিতর্কের পর তাঁরা বেঁকে বসেছেন।
একটি বৈশ্বিক পরাশক্তির অধিনায়ক হিসেবে একজন অসংলগ্ন ব্যক্তির দায়িত্ব পালন নিয়ে ভোটারদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
টিভি বিতর্কের আগে ইপসোসের চালানো একটি জরিপে দেখা গিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য ভোটারদের মাত্র ২৮ শতাংশ বাইডেনের ‘মানসিক সুস্থতা’ সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু বিতর্কের পর এই সংখ্যা ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে ভোটার বা জনগণ বাইডেনকে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চান কি না, সেটির চেয়ে নির্বাচনী তহবিল জোগানো চাঁদাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কী চায়, সেটি বড় বিষয় হয়ে উঠেছে।
এর মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে, আমেরিকা ‘গণতন্ত্র’ বা ডেমোক্রেসি হিসেবে বারবার অভিহিত হলেও এটি আসলে একটি নির্লজ্জ প্লুটোক্রেসি (অভিজাত গোষ্ঠীর শাসন)। এটি মূলত বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর পরিচালিত একটি অসামান্য ক্ষমতা ও শক্তির আধার। এখানে এই দাতারা এতটাই প্রভাবশালী যে ভোটদান এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক চর্চাকেও তাঁরা নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে সত্যিকারের জনগণের ইচ্ছাকে এখানে খুব কমই গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে।
অর্থওয়ালারই যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করেন, এ কথা বলা যদিও ষড়যন্ত্রতত্ত্ব হিসেবে অনেকের কাছে মনে হতে পারে, কিন্তু এটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে অগোপন ষড়যন্ত্রতত্ত্ব।
প্রকৃতপক্ষে, প্লুটোক্রেটিক হস্তক্ষেপ এখানকার রাজনৈতিক পটভূমির একটি অংশে এতটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে যে নির্বাচনী ফলাফলকে প্রভাবিত করার জন্য ভোটারদের পাশে পাওয়ার চেয়ে দাতাদের পাশে পাওয়াটাই মুখ্য হয়ে উঠেছে।
২০২৩ সালের জুন থেকে চলতি বছরের মার্চ মাস নাগাদ হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রিত হয়ে আসা প্রযুক্তি উদ্যোক্তা, পুঁজিপতি ও অন্যান্য অভিজাত গোষ্ঠী প্রায় ১০ লাখ মার্কিন ডলার বাইডেনের যৌথ তহবিল সংগ্রহ কমিটির (যার নাম ‘বাইডেন ভিক্টরি ফান্ড’) হাতে তুলে দিয়েছে।
পলিটিকো ওয়েবসাইটটি এ বিষয়ে তাদের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে: ‘হোয়াইট হাউসে দাতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে বাইডেন বেআইনি কিছু করেননি। তাঁর পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্টরাও একইভাবে রাজনৈতিক সমর্থক ও দাতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য হোয়াইট হাউসের জাঁকজমক ও সরকারি সুবিধা ব্যবহার করেছেন।’
আর্থিক পুঁজির অধিকারী এসব লোকই যে কার্যকরভাবে রাজত্ব করে এবং রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেন, তা বোঝার জন্য এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর কী হতে পারে?
মার্কিন ‘গণতন্ত্রের’ এই খোলাখুলি আর্থিক কারসাজির বাইরেও কালোটাকার খেলা চলে। ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক সংস্থা ‘ওপেনসিক্রেটস’ মনে করে, ‘রাজনৈতিক ফলাফলকে প্রভাবিত করার জন্য যে কালোটাকা ঢালা হয়, সে অর্থের উৎস প্রকাশ করা হয় না।’
ফেডারেল ইলেকশন কমিশন (এফইসি) ইতিপূর্বে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় করপোরেশন ও বিশেষ স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর সীমাহীন ব্যয়ের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল। তবে এফইসির এই বিধিনিষেধ বাতিল চেয়ে একটি সংস্থার করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া এক আদেশে তা বাতিল হয়ে যায়। এটি নির্বাচনী প্রচারণায় কালোটাকার বন্যা বয়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করে।
মূলত সর্বোচ্চ আদালতের ওই রায় এখন প্লুটোক্রেসির প্রাতিষ্ঠানিক স্তম্ভে পরিণত হয়েছে। নিউইয়র্ক ল স্কুলের ব্রেনান সেন্টার ফর জাস্টিসের হিসাবমতে, সুপার প্যাকস্ (পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটি) নামের একটি গোষ্ঠী (যারা নির্বাচন প্রভাবিত করতে অর্থ ব্যয় করে থাকে) জন্ম হওয়ার প্রথম দশকে একাই খরচ করেছে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার।
তাত্ত্বিকভাবে সুপার প্যাকসকে তাদের দাতাদের কথা এফইসিকে জানাতে হবে। কিন্তু এই প্রয়োজনীয়তা আসলে সম্পূর্ণরূপে অপ্রাসঙ্গিক। কারণ, সুপার প্যাকস্ বিভিন্ন শেল কোম্পানি (বাস্তবে অস্তিত্বহীন কাগুজে কোম্পানি) এবং অলাভজনক গোষ্ঠীগুলোর কাছ থেকে সীমাহীন তহবিল পেতে পারে যারা, তাদের চাঁদাদাতাদের নাম প্রকাশ করতে বাধ্য নয়। ভোটারদের পক্ষে জানা সম্ভব হচ্ছে না, কোন গোষ্ঠী কোন উদ্দেশে কোন নেতার পেছনে অর্থ ঢালছে। ফলে নির্বাচনের ফল নির্ধারণে ভোটারদের চেয়ে পুঁজি লগ্নিকারী গ্রুপগুলোই বেশি ভূমিকা রাখছে বলে মনে হচ্ছে।
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত
বেলেন ফার্নান্দেজ মার্কিন সাংবাদিক ও লেখক।