স্মার্ট বাংলাদেশে কাস্টমার সার্ভিস কেন এত আনস্মার্ট

টরন্টো থেকে আকাশপথের দূরত্ব খুব বেশি না হলেও ক্ষুধার্ত যাত্রীর কাছে হ্যালিফ্যাক্সের স্ট্যানফিল্ডে পৌঁছানোর পথটা লম্বা। আকাশপথের ভ্রমণ শেষে যেহেতু সড়কপথও বেশ কিছুটা ভ্রমণ করতে হবে, তাই এয়ারপোর্ট থকে বের হওয়ার আগেই নিচতলায় টিম হর্টনের দোকানে ক্রোঁয়াসা (এই ফরাসি সস্তা খাবার বাংলাদেশে এসে হয়ে গিয়েছে অবিশ্বাস্য দামি ক্রোসেন্ট) কেনার জন্য দাঁড়ালাম।

বয়স্কা বিক্রেতা যখন জানলেন, এক্ষুনি খাব, তখন অপূর্ব এক মায়াভরা হাসিতে জিজ্ঞাসা করলেন, একটু গরম করে দেব কি? বাটার ক্রোঁয়াসা হালকা গরম খেতে বেশ লাগে। হাতে সময় কম থাকলেও তাই গরম করেই দিতে বললাম। কিন্তু ওই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে যেন ক্ষুধা ও গন্তব্যে যাওয়ার তাড়া ছাপিয়ে তাঁর আন্তরিকতাপূর্ণ স্নিগ্ধ হাসি ও দরদ দিয়ে জিজ্ঞাসা করা প্রশ্নটি মনকে আচ্ছন্ন করল ভালো লাগায়।

২০১৩ সালে চলার পথে কয়েক মুহূর্তের অতি সংক্ষিপ্ত ব্যাপ্তির এ ঘটনা ২০২৪ সালেও স্মৃতি থেকে ম্লান হয় না ভদ্রমহিলার মুখের হাসি আর মমতার কারণে। কাজ সেরে হ্যালিফ্যাক্স থেকে টরন্টো ফেরার অনেক পরে জেনেছিলাম, পাঁচ মিলিয়নের কম যাত্রী চলাচল করেন যেসব বিমানবন্দরে, সেগুলোকে নিয়ে হওয়া জরিপে হ্যালিফ্যাক্সের স্ট্যানফিল্ড বিমানবন্দর ২০১০ সালে টানা চতুর্থবারের মতো যাত্রীর সন্তুষ্টি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিশ্বে প্রথম স্থান অধিকার করেছিল।

একটা বিমানবন্দর যাত্রীসেবায় শুধু বিমানবন্দরের নিচতলায় অবস্থিত একটা খাবারের দোকানের কর্মীর কাস্টমার কেয়ারেই প্রথম হয়ে যায় না। কিন্তু বিমানবন্দরের কাস্টমার কেয়ারের সামগ্রিক ভাবমূর্তি নির্মাণে আন্তরিকতা নিয়ে সেবা দিতে পারা মানুষগুলো অবশ্যই যাত্রীর সন্তুষ্টিতে ভূমিকা রাখেন।

মগবাজারে পাশাপাশি দুটি মুদিদোকানে একই ধরনের পণ্য বিক্রি হয়। প্রথম দোকানটিতে ঝকমকে রঙিন কাগজে মোড়ানো চমৎকারভাবে গুছিয়ে রাখা সব পণ্যে যে কারও দৃষ্টি আকৃষ্ট হওয়ার কথা। কিন্তু দোকানের বিক্রেতা মলিনবদনে বসে আছেন। ব্যবসায় খুব একটা লাভ হয় না বলে মন খারাপ।

দ্বিতীয় দোকানে মোটামুটিভাবে গুছিয়ে রাখা পণ্যসম্ভারের এক পাশে সহাস্যবদনে দোকানিকে দেখা যাচ্ছে। দোকানের সামনে ভিড়। হাসিমুখে পণ্য বিক্রি করে যাচ্ছেন ব্যস্ত দোকানি। দুই দোকানের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? একজনের বদন মলিন, অন্যজনের মুখে হাসি। হয়তো বলবেন, বিক্রি ভালো হলে তো মুখে হাসি আসবেই। বিষয়টা আসলে উল্টো। মুখের হাসি ভালো বিক্রির দ্বার প্রশস্ত করে।

হ্যালিফ্যাক্স বিমানবন্দরের কফির দোকানের দোকানি বা ঢাকার মুদিদোকানের ব্যস্ত দোকানি—এই মানুষগুলোর কি কোনো ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা আর্থিক সমস্যা নেই? তাঁরা কি সব দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত বলেই এভাবে হাসতে পারছেন? না। সেগুলো মনের সবচেয়ে পেছনের তাকে রেখে বর্তমানে যা করণীয়, তার দিকে তাঁরা পূর্ণ মনোনিবেশ করছেন। পণ্যের বিনিময়ে টাকা নিচ্ছেন বটে, কিন্তু অমূল্য হাসির কারণে সেই দোকানে বারবার যাওয়ার আগ্রহ ক্রেতার মনে তৈরি করে হচ্ছে।

হাসিমুখে ক্রেতাকে অভ্যর্থনা জানানো সফল ব্যবসার নীতি। কারণ, অর্থের বিনিময়ে পণ্য প্রদান করলেও ক্রেতার উপস্থিতিতে যে বিক্রেতা ধন্য, তা প্রকাশ করার এটিই একমাত্র মাধ্যম।

অবশ্য ডিজিটাল যুগের ব্যবসায় ক্রেতা-বিক্রেতা পরস্পরের মুখদর্শন না করলেও চলে। আঙুলের গুটিকয় মৃদু স্পর্শেই মূল্য পরিশোধ ও কেনাকাটা সম্পন্নপূর্বক ঘরে বসেই পণ্য বুঝে নেওয়া যায়। তা সত্ত্বেও দোকানে সশরীর উপস্থিত হয়ে কেনাকাটার রেওয়াজ পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হতে আরও সময়ের প্রয়োজন। সুতরাং ক্রেতার সঙ্গে বিক্রেতার মিথস্ক্রিয়া ঘটা অনিবার্য। আর এই মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে যা প্রতিষ্ঠিত হয়, তা হলো আস্থা। ক্রেতা কেন আবার একই দোকানে যাবেন এবং বিক্রেতা কীভাবে তাঁর দোকানে ক্রেতার সংখ্যা বৃদ্ধি করবেন, তার ভিত্তি হলো আস্থা।

অনেক সময় পথের ধারে টঙের দোকানে সবজি বিক্রেতার মুখের হাসি তাঁর কাছ থেকেই আলু কিনতে আগ্রহী করে। আবার অভিজাত শপিং কমপ্লেক্সের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বিপণির মহামূল্যবান সব পণ্যের মাঝেও বিমর্ষ চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিক্রয়কর্মীকে দেখে ক্রেতা অন্য দোকানে চলে যান। কাস্টমার কেয়ার বলে যে ধারণ প্রচলিত আছে, সেটি উভয়পক্ষীয় আস্থা স্থাপনেরই নিদর্শন।

শুধু অনুকূল নয়, প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কাস্টমার কেয়ার যত্নের সঙ্গে করতে পারা একটা সফলতা। কিন্তু অধিকাংশ দোকানি কাস্টমার সার্ভিস দেন, কাস্টমার কেয়ার নয়। কাস্টমার সার্ভিস হলো প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়া। কাস্টমার কেয়ার হলো কাস্টমারের সঙ্গে একটা দীর্ঘমেয়াদি আন্তরিক সম্পর্ক স্থাপন করা।

পরিতাপের বিষয়, আমরা এখনো কাস্টমার সার্ভিসকে সর্বজনীন করতে পারিনি। একজন মানুষ সেবা নিতে পারবেন কি না, তা আমাদের দেশে নির্ভর করে তার সামাজিক অবস্থান, শ্রেণি, আর্থিক অবস্থা, লিঙ্গপরিচয় ইত্যাদির ওপর। নিচের বাস্তবতাটি তা–ই বলে।

কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামের বাসিন্দা শাফিনা অস্থায়ী গৃহকর্মী হিসেবে ঢাকার একটি আবাসিক এলাকায় কাজ করেন। বাড়িতে যাওয়ার সময় ট্রেনে টিকিট কেটে সন্তানদের নিয়ে স্বল্প খরচে সিটে বসে যে যাওয়া যায়, এ তথ্য তাঁর অজানা। দীর্ঘ পথ দাঁড়িয়ে তিনি বাড়ি যান।

যে বাসার গৃহকর্মী তিনি, তারা তাঁকে অনলাইনে টিকিট কেটে দিতে চাইলে বাধল বিপত্তি। তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রাথমিক পর্যন্ত এবং তিনি নিজের মুঠোফোনে আসা এসএমএস পড়তে পারেন না। অর্থাৎ এনআইডি ও মুঠোফোন নিয়ে তাঁকে সেই গৃহের মালিকের কম্পিউটারের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।

যাহোক, রেলের ওয়েবসাইটে তাঁর অ্যাকাউন্ট খোলা হলো, ই–মেইল খোলা হলো, নিবন্ধনের কোড এল তাঁর ফোনে এবং তাঁর টিকিট কাটা ও তা প্রিন্ট করা গেল। যেহেতু তিনি বাটনফোন ব্যবহার করেন, ঢাকায় আসার সময় তিনি স্থানীয় বাজারে গেলেন ইন্টারনেটওয়ালা দোকান থেকে টিকিট কেটে আনতে। কারণ, স্টেশনে টিকিট নেই। দোকানি বুঝলেন, এ রকম কাস্টমারকে চাইলেই ঠকানো যায়। দুটি টিকিটের জন্য চাইলেন ৭৫০ টাকা। যাওয়ার সময় শাফিনার টিকিটে ব্যয় হয়েছিল ২৯০ টাকা। অর্থাৎ সেবাকাঠামো আছে, কাস্টমার আছে, কিন্তু সেই সেবায় কাস্টমারের প্রবেশাধিকার নেই।

‘স্মার্ট’ বাংলাদেশে কাস্টমার সার্ভিস ও কাস্টমার কেয়ারের এ ধরনের নমুনা কাঠামোগত আনস্মার্টনেসেরই পরিচায়ক। নিরাপত্তার কারণ ও প্রতারণা ঠেকানোর উদ্দেশ্যে তৈরি করা এই সেবাকাঠামো কর্তৃপক্ষকে বাহবা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেও যাঁদের জন্য সেবা, তাঁদের কাছে আদৌ সেবা পৌঁছাচ্ছে কি না, তা বোধ করি জানা প্রয়োজন এবং জানার পথও আছে।

আবার সেবায় প্রবেশাধিকার আছে, কাস্টমারকে কেয়ার করার কর্মীও আছে। কিন্তু কেবল মুখে হাসি ফুটিয়ে কাস্টমারের সঙ্গে কথা বলতে পারাই কাস্টমার কেয়ার নয়। কাস্টমারের অভিযোগ শুনে তড়িৎ এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার মধ্যেও কাস্টমার কেয়ার প্রতিফলিত হয়।

এই সংস্কৃতির বিকাশ আমাদের দেশে করা সম্ভব ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েরই প্রো-অ্যাকটিভ ভূমিকার মাধ্যমে। যেখানে নিজের লাভটা বুঝে নেওয়ার সঙ্গে সম্মিলন ঘটবে সততা ও আন্তরিকতার।

ঢাকার একটি আবাসিক এলাকায় গত বছরের একেবারে শেষের দিকে উদ্বোধন করা হলো বিখ্যাত এক শপিং সেন্টারের শাখা। উদ্বোধনী সেলের ছাড় সংবাদ প্রচারে আকৃষ্ট হয়ে ক্রেতাসমাগম হলো বিপুল, আয়োজন হলো বিশাল। কিন্তু ছাড়ে ক্রয়কৃত নুডলস সেখান থেকে কিনে বাসায় রান্না করার পর তা আর মুখে তোলার জো নেই। নুডলস হয়ে গেল জাউ। আরেকটা নতুন প্যাকেট খুলে দ্বিতীয়বার রান্নার চেষ্টাতেও ফল ভিন্ন হলো না।

অগত্যা এক সপ্তাহ পর গিয়ে ক্যাশ কাউন্টারে অর্ধব্যবহৃত নুডলসের প্যাকেটটি ফেরত দিয়ে বললাম, এসব পচা জিনিস সেল দিয়ে বিক্রি করা আর ধোঁকাবাজি করা এক। এটা নিন, আপনাদের বসকে বলবেন, কাস্টমার এসে ফেরত দিয়ে গেছে, উনি যেন এটা খেয়ে দেখেন। মূল্য ফেরত পাওয়ার উদ্দেশ্য এখানে ছিল না, ছিল শুধু মানসম্পন্ন শপিং সেন্টারে মানহীন পণ্য বিক্রি থেকে তাদের বিরত থাকার অনুরোধ।

বাংলাদেশে কাস্টমাররা অভিযোগ করার সুযোগ পেলে বানিয়ে এবং বাড়িয়ে বলে মর্মে অভিযোগ আছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কাস্টমারের সত্য কথার জোর হোক আর কাস্টমারকে মুগ্ধ করার জন্য হোক, ক্যাশিয়ার বেশ বিনয়ের সঙ্গে একটু অপেক্ষা করতে বললেন। এক মিনিটেরও কম সময়ে তাঁদের কোনো এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হাজির হলেন (শাখাটি পুরোনো হয়ে গেলেও এ রকম তাড়াতাড়ি হাজির হওয়ার ধারা অব্যাহত থাকবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে)।

দুঃখ প্রকাশান্তে নুডলসের মূল্য ফেরত দিলেন। অবশ্য শ্রেণি ও লিঙ্গপরিচয় অন্য ক্ষেত্রের মতো এখানেও ভূমিকা রেখেছে, সন্দেহ নেই। একজন পুরুষ অথবা নিম্ন আর্থসামাজিক শ্রেণির একজন নারী এ ক্ষেত্রে একই রকম কাস্টমার কেয়ার পেতেন কি না, তা সন্দেহের বিষয়। যেমন অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও শাফিনাদের জন্য ট্রেনের টিকিট অনলাইনে কাটার পথ বন্ধ।

তবু যাহোক, কাস্টমার কেয়ারের রেওয়াজ আমাদের দেশে একটু একটু করে বদলাচ্ছে। যাত্রীর সন্তুষ্টি নিয়ে গবেষণা বা জরিপ সেবার মান উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হিসেবে অনেক দেশে প্রচলিত। তেমনই সেবায় কাস্টমারের প্রবেশাধিকার ও ফেয়ার কাস্টমার কেয়ার নিয়ে গবেষণা আমাদের দেশেও সেবার মান বাড়াতে পারে।

  • ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানা রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়