বর্তমানে দেশে ব্যাংকিং খাতের প্রধানতম সমস্যা হচ্ছে ক্রমবর্ধমান ও নিয়ন্ত্রণহীন কুঋণ বা মন্দ ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, বর্তমানে ঋণের ৯.৯৩ শতাংশ হচ্ছে কুঋণ; যার মধ্যে ২০ শতাংশের বেশি মন্দ ঋণ আছে ৯টি ব্যাংকের, বিশেষত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর। (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন, ২০২৩)।
বিশ্বখ্যাত ক্রেডিট রেটিং কোম্পানি ২০২৩–এ বাংলাদেশকে দুর্বলতম ব্যাংকিং ব্যবস্থা (৯/১০ স্কোর, ১০–এর মধ্যে যার মানে সবচেয়ে দুর্বল) হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ব্যাসেল নীতি-৩ অনুযায়ী বাংলাদেশের মূলধন পর্যাপ্ততার দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্নে¤অবস্থান করছে। বর্তমানে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার প্রভিশনিং ঘাটতি রয়েছে ১৫টির বেশি ব্যাংকের। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ঋণশ্রেণীকরণ ও পুনঃ তফসিল করা হলে কুঋণের পরিমাণ অনেক বেড়ে যেতে পারে, যা আইএমএফ কর্তৃক পূর্বাভাসকৃত ৩ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। ব্যাংকিং ব্যবস্থার বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত গভর্নরের কাছে কিছু সুপারিশ তুলে ধরতে চাই।
প্রথমত, গত ২৮ আগস্ট প্রথম আলোতে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের একটি উক্তি দেখলাম। তিনি যর্থাযথই বলেছেন, ‘এস আলম ইতিহাসের প্রথম ব্যক্তি, যিনি সুপরিকল্পিতভাবে ব্যাংক লুট করেছেন। এমন সুপরিকল্পিতভাবে পৃথিবীতে কেউ ব্যাংক ডাকাতি করেছে কি না, তা জানা নেই।’
ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান একটি অত্যন্ত পেশাগত ব্যবস্থাপনার সমষ্টি। যার ফলে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে সাধারণ আমানতকারী ও গ্রাহকদের আস্থা অর্জনে নিরলসভাবে কাজ করে যেতে হয়। কিন্তু এস আলম তার উদ্ভাবিত অভিনব পন্থায় শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের নির্দিষ্টসংখ্যক শেয়ার (৫১ শতাংশ বা তার বেশি) কেনার মাধ্যমে তার নিয়ন্ত্রিত সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা বোর্ড দখল ও তাদের পছন্দ অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ নিয়োগ দিয়েছেন। ইসলামী ব্যাংকের মতো শক্তিশালী একটি ব্যাংকে তিনি তাঁর পিএস আকিজ উদ্দিনকে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন।
এ ব্যাংকে নজিরবিহীনভাবে চট্টগ্রামের একটি নির্দিষ্ট এলাকার অধিবাসীদের বিভিন্ন সময়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে কোনো ধরনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ছাড়াই বা নামমাত্র মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তা অতীতে ব্যাংকিং সেক্টরে কল্পনার অতীত ছিল। যার ফলে ইসলামী ব্যাংকের মতো একটি শক্তিশালী ব্যাংককে বহুদিন ‘লাইফ সাপোর্ট’ দিয়ে টিকিয়ে রাখতে হয়েছিল। এ ছাড়া এস আলম কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত আরও কয়েকটি ইসলামি ব্যাংককে নিয়মের কোনো তোয়াক্কা না করে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তারল্য–সুবিধা প্রদান করা হয়েছে।
দুঃখজনকভাবে তৎকালীন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আমলা থেকে অর্থনীতিবিদ বনে যাওয়া গভর্নরের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। ফলে ব্যাংকিং সেক্টরের বহুল প্রচলিত বিধিবিধান ও অনুশাসন–ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল, যা এ সেক্টরকে করেছে ভঙ্গুর ও তৈরি হয়েছে আমানতকারীদের আস্থাহীনতা। ফলে ব্যাংকের অনেক গ্রাহক অর্থ উত্তোলন করে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে বিভিন্ন অনুৎপাদনশীল খাতে তাঁদের সঞ্চয় স্থানান্তর করেছেন। ফলে ব্যাংকিং ব্যবস্থা অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পতিত হয়েছে।
এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এস আলম ও সালমান এফ রহমানের মতো মাফিয়া কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলো থেকে নামে-বেনামে তাঁদের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুকূলে বিতরণ করা বৃহৎ ঋণ চিহ্নিতকরণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচ্চপদস্থ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের দিয়ে ‘বিশেষ পরিদর্শন টিমের’ মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণগুলো যাচাই-বাছাই করা। বিশেষত ঋণদান প্রক্রিয়া, বিতরণ করা অর্থের ব্যবহার, ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের জামানত, জামানতের পর্যাপ্ততা নির্ধারণের মাধ্যমে ভালো ঋণ ও মন্দ ঋণকে যথাযথভাবে শ্রেণীকরণ, তাদের বিপরীতে প্রভিশনিংয়ের ব্যবস্থাকরণ। ওই সময়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে কোনো ঋণ অনুমোদন করা হয়ে থাকলে অবিতরণকৃত ঋণের কিস্তিগুলো অবিলম্বে বন্ধ করা। এসব ঋণ প্রদানে ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণাদি সাপেক্ষে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং যোগ্য-দক্ষ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের যথাযথ পদায়নের মাধ্যমে সুশাসনের কঠিন বার্তা প্রেরণ।
দ্বিতীয়ত, বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্তিশালীকরণের কোনো বিকল্প নেই। যেকোনো রাজনৈতিক সরকার কখনোই চাইবে না যে তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যার ফলে বর্তমান সময়ই শ্রেষ্ঠ হবে যেকোনো বড় ধরনের গুণগত পরিবর্তন। সারা পৃথিবীতে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হয় ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম বা ‘ফেড’–এর চেয়ারম্যানকে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে তিনি অর্থনীতির প্রয়োজনে যেকোনো ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা ভোগ করেন, যার ফলে ফেডের যেকোনো সিদ্ধান্তের প্রভাব শুধু যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা পৃথিবীতেই প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। উন্নত দেশগুলো বিভিন্ন ধরনের অংশীদারত্ব বজায় রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করে অনেকে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে থাকে।
এ ছাড়া পৃথিবীর অনেক দেশই তাদের রিজার্ভ ইউএস ডলারে সংরক্ষণ করে থাকে, যার ফলে ফেডের যেকোনো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন সবার জন্য সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে থাকে। ‘ব্যাংক অব ইংল্যান্ড’ সারা পৃথিবীতে আধুনিক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রোল মডেল হিসেবে পরিগণিত, তার প্রণীত আর্থিক শৃঙ্খলা ও মুদ্রা নিয়ন্ত্রণে তার অবারিত স্বাধীনতার জন্য। ২০১২ সালে প্রণীত ‘দ্য ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস অ্যাক্ট’ অনুযায়ী যুক্তরাজ্যের গভর্নরের মেয়াদ ৮ বছর করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সংকটকালীন একজন গভর্নরের সর্বোচ্চ ২৪ বছর পর্যন্ত একাধারে দায়িত্বে থাকার রেকর্ড আছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার ওপর সম্পাদিত গবেষণা ও অতীত লিটারেচার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গভর্নরের পদের মেয়াদ বৃদ্ধির সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা ও তাদের কাজের কার্যকারিতা সরাসরি সম্পৃক্ত। এ ক্ষেত্রে অনেক দেশেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের পদকে সাংবিধানিক পদ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে মর্যাদার আসনে আসীন করেছে। অতীতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিষ্ঠিত ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ’ থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের নির্দেশনা জারি করা হয়েছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীন সত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংককে মুদ্রানীতি প্রণয়ন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও আর্থিক শৃঙ্খলা নিশ্চিতকরণে একচ্ছত্র ক্ষমতা ও স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্তিশালী করার পাশাপাশি এ ছাড়া বিভিন্ন সমস্যায় পর্যবসিত ব্যাংকগুলোর পর্ষদ ভেঙে দিয়ে পেশাগতভাবে দক্ষ লোকদের দিয়ে বোর্ড গঠন করা জরুরি। বিশেষ করে যাঁদের ব্যাংকিং, ফিন্যান্স, অ্যাকাউন্টিং ও সার্বিক অর্থনীতি বিষয়ে উচ্চতর ট্রেনিং ও গবেষণা বিষয়ে পারদর্শিতা আছে। যেটা বর্তমান গভর্নরের পদক্ষেপে পরিলক্ষিত হয়েছে, যা অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক।
তৃতীয়ত, সারা পৃথিবী যেখানে করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করতে একক মালিকানা বা মালিকানার কেন্দ্রীভূতকরণ নিরুৎসাহিত করে, সেখানে ব্যাংক কোম্পানি সংশোধন আইন ২০১৮–তে একজন পরিচালককে একাধারে ৬ বছর থেকে (যা ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ অনুযায়ী প্রবর্তন করা হয়েছিল) তা ৯ বছরে উন্নীত করা হয়।
২০২৩ সালের সংশোধনীতে তা আবার ১২ বছরে উন্নীত করা হয়, যা পরিবারকেন্দ্রিক দখলদারি ও একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। তা ছাড়া একই পরিবার থেকে ২০১৮ সালের সংশোধনের মাধ্যমে দুজন পরিচালক থেকে চারজন করা হয়, যা অনেক সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের সংশোধনীতে তিনজনে কমিয়ে আনা হয়। এতে প্রতীয়মান হয় কীভাবে প্রভাবশালী পক্ষগুলো নিজেদের পারিবারিক ও ব্যবসায়িক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পলিসিকে বিভিন্ন সময় প্রভাবিত করেছে। এসব সিদ্ধান্ত আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে অগ্রসর করার পরিবর্তে পশ্চাৎপদতার দিকে নিয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রণীত কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রবিধান অনেক ব্যাংক পরিপালনে শিথিলতা দেখিয়ে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীকে অনৈতিক সুবিধা প্রদান করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ঋণের সর্বোচ্চ সীমা নগদ তহবিলের ক্ষেত্রে মূলধনের ১৫ শতাংশ (ফান্ডেড ক্রেডিট) ও অনগদ তহবিলের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশসহ সর্বমোট ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দেওয়া যেতে পারে, যা অনেক ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যত্যয় করেছে। ফলে ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে ও আমানতকারীদের আমানতের নিশ্চয়তা বিঘ্নিত হচ্ছে।
এ ছাড়া মন্দ ঋণের ওপর নির্ভর করে একটি ব্যাংক তার সর্বমোট ঋণের কত শতাংশ বৃহৎ ঋণ হিসেবে দিতে পারবে, এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা আছে, যা অনেকাংশে ব্যত্যয় করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ কোনো ব্যাংকের কুঋণ ৩ শতাংশ বা এর নিচে হলে সেই ব্যাংক তার সর্বমোট ঋণের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বৃহৎ ঋণ দিতে পারবে। কিন্তু যেসব ব্যাংকের মন্দ ঋণ ২০ শতাংশ বা তার ওপরে, সেসব ব্যাংক সর্বমোট ঋণের ৩০ শতাংশ ওপরে ‘বৃহৎ ঋণ’ হিসেবে দিতে পারবে না। এসব প্রবিধান যেকোনো বাণিজ্যিক ব্যাংক বা আর্থিক বৃহৎ বা একক ঋণের ঝুঁকি এড়িয়ে সম্ভাব্য ঋণের ঝুঁকি এড়িয়ে ঋণের পোর্টফলিও সম্প্রসারণে সহযোগিতা করে যথাযথভাবে পরিচালন করলে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা বড় ধরনের ঝুঁকির সম্মুখীন হতো না।
চতুর্থত, সদ্য সাবেক গভর্নর অনেকটা জোরপূর্বক বিভিন্ন ব্যাংক পর্ষদের চেয়ারম্যান ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ডেকে দুর্বল ব্যাংক ও সবল ব্যাংককে একত্রীকরণের জন্য যেসব অভিনব পন্থা শুরু করেছিলেন, সে বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে। কয়েকটি ব্যাংক এ ধরনের ঘোষণা দিয়ে বড় ধরনের বিপদে পড়েছে। বিশেষ করে যেসব দুর্বল ব্যাংককে একত্রীকরণের আকস্মিক ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, সেসব ব্যাংক বড় ধরনের তারল্য–সংকটে পড়েছিল। এতে করে Rumour Run-Crisis-এর মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, যার ফলে কোনো গুজবের বা খবর ছড়ানোর ফলে আমানতকারীরা তাঁদের আমানত তাড়াহুড়ো করে উত্তোলন করতে যান। ফলে পৃথিবীর অনেক ব্যাংক তারল্য–সংকটে পড়ে দেউলিয়া হয়েছে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে ‘রিপাবলিক ফাস্ট ব্যাংক অব ফিলাডেলফিয়া’ দেউলিয়া হয়েছে তারই উদাহরণ। আমাদের দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের বড় ধরনের আমানত হারিয়েছিল আকস্মিক মার্জার ঘোষণার কারণে। পাশাপাশি বহুদিন ধরেই বেশ কয়েকটি ইসলামি ব্যাংককে নিয়মবহির্ভূতভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তারল্যের জোগান দিয়েছে।
বর্তমান গভর্নর পদে এসেই ঘোষণা করেছেন যে দুর্বল ব্যাংককে আর সহযোগিতা প্রদান করা হবে না। বাজার প্রতিযোগিতার এই যুগে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকেই কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত পেশাগত প্রতিষ্ঠান, যা আমানতকারীদের ও গ্রাহকদের আস্থা অর্জনের মাধ্যমেই টিকে থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, দুটি ব্যাংকে একত্রীকরণ অনেকটা দুটি পৃথক মানুষের মধ্যে বিবাহবন্ধনের মতো। বলপ্রয়োগ করে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করলে যেমন সেটা টিকবে না, তেমনি জোরপূর্বক ব্যাংক মার্জার সফল বা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। যেকোনো দুটি ব্যাংকের একত্রীকরণ হতে হবে ব্যাংকগুলোর শক্তিমত্তা-দুর্বলতা ও অর্থনৈতিকভাবে নিরূপিত লাভ-ক্ষতির নিরিখে। মনে রাখতে হবে, ব্যাংক একত্রীকরণ একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া, যা সম্পন্ন হতে দু-তিন বছর সময় পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। আবার অনেক সময় পূর্বঘোষিত একত্রীকরণের সিদ্ধান্ত পরবর্তী বিচার–বিশ্লেষণ ও দর-কষাকষির অনৈক্যের কারণে ভেস্তে যেতে পারে।
পঞ্চমত, ব্যাংকের পাশাপাশি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে বিশেষ নজর প্রদান জরুরি। বর্তমানে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিশেষ নজরদারির কারণে বিভিন্ন ব্যাংকের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা, সুশাসনের অভাবের খবর পরিলক্ষিত হলেও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমান করুণ ও ভীতিকর চিত্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নজরে আসছে না। ৩৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্তত ৮-১০টি প্রতিষ্ঠানের দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম। যার অন্যতম কারণ ব্যাংকে বিধিবিধানগুলো অগ্রাহ্যকরণ, নিয়মবহির্ভূতভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ প্রদান। বিশেষত পর্ষদের সদস্য, চেয়ারম্যানসহ তাঁদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে ঋণ বিতরণ, বিতরণ করা অর্থ অন্যত্র সরিয়ে ফেলা বা লোপাটের উদ্দেশ্যে মানি লন্ডারিংসহ বিদেশে অর্থ পাচার। এসব অপকর্মের সঙ্গে উচ্চপদস্থ কিছু দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তাও জড়িত। যাঁরা পর্ষদ সদস্যদের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে তাঁদের মালিকপক্ষকে অনৈতিক সুবিধা প্রদান করেছেন। এঁদের চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
ব্যাংকিং সেক্টর ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির হোতা সালমান এফ রহমানের নেতৃত্বে ব্যাংক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন একসময় বাংলাদেশ ব্যাংকের অত্যন্ত কার্যকরী সারপ্রাইজ ভিজিট বা অডিট, যা যেকোনো অভিযোগের ভিত্তিতে বা নির্দিষ্ট সময় পরপর করা হতো, তা বন্ধ করার দাবি জানিয়েছিলেন, যা অত্যন্ত হাস্যকর এবং এতে তাদের ঋণ জালিয়াতি বা অসৎ উদ্দেশ্যই প্রতীয়মান হয়। বর্তমান সামগ্রিক অবস্থার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরিং সামর্থ্যের অভাব, নিয়মবহির্ভূত কাজের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতা ও ব্যাংকিং অনুশাসনের অভাব দায়ী।
উপরন্তু, বর্তমান প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত সরকারকে অভ্যন্তরীণ উৎস, বিশেষ করে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে প্রাক্কলিত অভ্যন্তরীণ ঋণের সীমা ২৫১,৬০০ কোটি টাকা কমিয়ে নিয়ে আসার জন্য। বিকল্প হিসেবে বর্তমান সরকার বহুজাতিক ঋণদান সংস্থা, বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক ও এআইআইবি থেকে অনুদান স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে বৈদেশিক ঋণ নিতে পারে। এতে ঋণের সুদ, মুদ্রাস্ফীতির উল্লম্ফন ও বৈদেশিক মুদ্রার চাপ কিছুটা হলে স্থিমিত হবে। পাশাপাশি এতে দেশীয় উদ্যোক্তারা ‘ক্রাউডিং আউট ইফেক্ট’ বা ‘ঋণের প্রবাহ’ বাধাগ্রস্ত হওয়া থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। তা ছাড়া বর্তমানে পলিসি রেট ৯ শতাংশ বাড়ানোয় অনেক উদ্যোক্তার জন্য ব্যাংকঋণ গ্রহণ অনেক ব্যয়বহুল হবে, যা তাদের পরিকল্পিত বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করবে। বিশেষ করে যেসব ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান মন্দ ঋণে জর্জরিত, তাদের বড় ধরনের ঋণ বিতরণ থেকে নিরুৎসাহিত করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণ বিতরণ উৎসাহিত করা উচিত।
সাধারণত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ঋণের ক্ষেত্রে ঋণ ব্যবস্থাপনার খরচ একটু বেশি হলেও বৃহৎ ঋণের তুলনায় স্প্রেড বা নেট মার্জিন বেশি হয়ে থাকে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে, বিশেষ করে সদ্য জুলাই থেকে শুরু হওয়া সহিংসতা ও বিশেষ কয়েকটি জেলায় আকস্মিক বন্যার ভয়াবহতায় অর্থনীতি একপ্রকার থমকে গেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত কৃষি খাতকে উজ্জীবিত করার জন্য এবং বর্তমান খাদ্যের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কৃষি খাতে বিশেষ নজর প্রদান।
বর্তমানে লাগামহীন খাদ্য মূলস্ফীতি ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, যা বিগত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ কিছু সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি কৃষি খাতকে উজ্জীবিত করার জন্য কম বা বিনা মূল্যে বীজ বিতরণ, সারের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ দাম সহনীয় করা প্রয়োজন। তা ছাড়া এ খাতের জন্য কিছু দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রয়োজন, যেমন পণ্য পরিবহন ও বাজারব্যবস্থা সহজীকরণ ও চাঁদাবাজমুক্তকরণ, জরুরি পণ্য সংরক্ষণাগার নির্মাণ, কৃষি খাতে নতুন প্রযুক্তি যুক্তকরণ ও যান্ত্রিকীকরণ ও কৃষি খাতকে নতুন প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় করা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষ ছাড়ে সিএমএসএমই ও কৃষি খাতের জন্য ‘বিশেষ পুনঃ অর্থসংস্থান স্কিম’ চালু করে ব্যাংকগুলোকে প্রণোদনা ও উৎসাহিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার মাধ্যমে বর্তমানে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষকে মূল্যস্ফীতির দুর্ভোগ থেকে স্বস্তি প্রদান করতে পারে।
নাজমুল এইচ পলাশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক