ঋণসংকটের ঝড় শ্রীলঙ্কাতেই শেষ হবে না

এটি শ্রীলঙ্কার বাইরের ও অভ্যন্তরীণ কিছু কারণে সৃষ্ট সংকট নয়। এ পরিস্থিতি তৈরি হতে কয়েক দশক লেগেছেছবি : এএফপি

শ্রীলঙ্কার কলম্বোয় একটি শপিং মলে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করতেন সঞ্জনা মুদালিগ। গত জানুয়ারিতে তাঁর বেতন অর্ধেক কমিয়ে দেওয়া হয়। তিনি তাঁর গয়নাগুলো বেচে দিতে বাধ্য হন। শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর চাকরি ছেড়ে দেন, কারণ অফিসে যাওয়া-আসার যে খরচ দাঁড়ায়, তা তাঁর বেতনের চেয়ে বেশি। তখন থেকে তিনি রান্নার জন্য গ্যাস বাদ দিয়ে জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করছেন। আগে সারা দিনে তিনি যে পরিমাণে খাবার খেতেন, এখন তার এক-চতুর্থাংশ খাবার খান।

ওয়াশিংটন পোস্ট-এ প্রকাশিত তাঁর গল্পটি শ্রীলঙ্কার অনেকের মধ্যে একটি। সেখানে লোকেরা তাদের ক্ষুধার্ত বাচ্চাদের মুখে খাবার দিতে পারছে না, সেখানকার বয়স্ক মানুষগুলো ওষুধের অভাবে ভুগছে। এ অবস্থা চলছে জানুয়ারিরও আগে থেকে। কিন্তু এই সংকটের মানবিক মূল্য শুধু তখনই আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করে যখন এই জুলাই মাসের শুরুর দিকে ‘আরাগালায়া’ (সিংহলি ভাষার এই শব্দের অর্থ ‘জনতার সংগ্রাম’) নামে পরিচিত ব্যাপক জনপ্রিয় আন্দোলনের উত্থান হয় এবং এর ধারাবাহিকতায় প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে রক্তপাতহীনভাবে ক্ষমতাচ্যুত হন।

গোতাবায়া ও তাঁর পরিবার ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে (যদিও তাঁর নির্বাচনী বৈধতা ছিল) শ্রীলঙ্কাকে লৌহমুষ্টি দিয়ে শাসন করেছে। এখন দেশটি যে অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার কারণে মরিয়া হয়ে উঠেছে, তার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় মিডিয়াই তাঁকে দায়ী করছে।

শুধু রাজাপক্ষেদের দোষারোপ করা খুবই সহজ। সাম্প্রতিক বছরগুলোর কথিত দুর্নীতি ও প্রধান অর্থনৈতিক নীতি বিপর্যয় (যেমন অস্বাভাবিক কর হ্রাস এবং সার আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ) শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পতনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করেছে। পাশাপাশি নিঃসন্দেহে, এই কয়েক বছরে রাজাপক্ষে পরিবার দেশটিতে যে আক্রমণাত্মক সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ উসকে দিয়েছে, সেটিও এ বিপর্যয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এটি শুধু এ গল্পের একটি ছোট অংশমাত্র। শ্রীলঙ্কায় সংকটের গভীর এবং অন্তর্নিহিত কারণগুলো বেশির ভাগ মূলধারার ভাষ্যকারেরা খুব কমই উল্লেখ করেছেন। সম্ভবত তার কারণ, সেগুলো উল্লেখ করলে বিশ্ব অর্থনীতির কর্মপদ্ধতি-সম্পর্কিত অনেক অস্বস্তিকর সত্যি বেরিয়ে আসত।

এটি শ্রীলঙ্কার বাইরের ও অভ্যন্তরীণ কিছু কারণে সৃষ্ট সংকট নয়। এ পরিস্থিতি তৈরি হতে কয়েক দশক লেগেছে। ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে ‘উন্মুক্ত অর্থনৈতিক নীতি’ গ্রহণ করার পর থেকে শ্রীলঙ্কা লাতিন আমেরিকার চিলির মতো নব্য উদারবাদী সংস্কারের ক্ষেত্রে ‘এশিয়ার পোস্টার বয়’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। বিদেশ থেকে আনা পুঁজি খাটিয়ে গড়ে তোলা রপ্তানি খাতকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভিত্তি বানানোর যে কৌশলটি শ্রীলঙ্কা নিয়েছিল, এখন তা উদীয়মান অর্থনীতির সবার কাছেই পরিচিত। এ কৌশলের অনুসরণ শ্রীলঙ্কাকে উত্তরোত্তর বৈদেশিক মুদ্রা ধার করার দিকে পরিচালিত করেছিল। এ ধারদেনা করার ক্ষেত্রে দেশটিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং দাভোস সক্রিয়ভাবে উৎসাহিত করেছিল।

সমস্যাটি শেষ হয়ে যায়নি। এখানে কোনো অর্থপূর্ণ ঋণ পুনর্গঠন করা হয়নি। আইএমএফ উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য আহা-উঁহু করেছে ঠিকই, কিন্তু তারা প্রায় কিছুই করে না। শুধু তা-ই নয়, আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক উভয়ই তাদের ঋণ পরিশোধের জন্য জোরজবরদস্তি করে এবং আইএমএফ তার আরোপিত সারচার্জের ভয়ংকর ব্যবস্থার মাধ্যমে সমস্যাটিকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দা-পরবর্তী সময়ে উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো কম সুদে ঋণ দেওয়া শুরু করে। এর ফলে শ্রীলঙ্কা তার নিজস্ব ব্যয়ের অর্থ জোগাড় করতে আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ডের ওপর নির্ভর করেছিল এবং এ বন্ডের বিপরীতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ নিয়েছিল। ২০১২ থেকে ২০২০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ঋণের সঙ্গে জিডিপি অনুপাত দ্বিগুণ হয়ে প্রায় ৮০ শতাংশ হয়। রপ্তানি থেকে প্রাপ্ত আয় এবং বিদেশে কর্মরত শ্রীলঙ্কানদের দেশে পাঠানো অর্থ—এ দুই উৎসের বদৌলতে দেশটির ঋণ পরিশোধের সামর্থ্যও বাড়তে থাকে।

কিন্তু মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে খারাপ করে তোলে। দেশটির রপ্তানি আয় হ্রাস পায় এবং খাদ্য, জ্বালানিসহ প্রয়োজনীয় আমদানি পণ্যের দাম দ্রুত বেড়ে যায়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেলেও সরকারকে ঋণের সুদ দিতে হয়েছে। এমনকি যখন ডলারের অভাবে প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি করা যাচ্ছিল না, তখনো সেই সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে।

এ আলোকে দেখলে এটি স্পষ্ট যে এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার শুধু শ্রীলঙ্কা একা হবে না। অর্থনীতিবিদেরা যেসব দেশকে ‘উদীয়মান বাজার’ বলে থাকেন, সেসব দেশকে এখন ঋণসংকটের একটি আসন্ন ঝড়ের মোকাবিলা করতে হবে। বিগত সময়ে উন্নত অর্থনীতিতে অবিশ্বাস্যভাবে কম সুদের হার দেখা যাওয়ার মানে হলো অধিকতর তহবিল ধনী বিশ্ব থেকে ‘উদীয়মান’ এবং ‘অগ্রসরমাণ’ বাজারে প্রবাহিত হয়েছে। যদিও এটি আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে (আইএফআই) চিয়ারলিডারের মতো চাঙা করা অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করেছে, কিন্তু এটি সব সময়ই একটি সমস্যাযুক্ত প্রক্রিয়া ছিল। এর কারণ হলো, পুঁজি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে যেকোনো সমস্যার প্রথম লক্ষণে ফেলে দেয় এবং এ দেশগুলোই মহামারিতে অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। উন্নত অর্থনীতিগুলো ব্যাপক অর্থনীতি ভঙ্গুরতাবিরোধী ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়েছিল। সরকারের দিক থেকে ভর্তুকি দিয়ে উৎপাদন পুনঃসচল করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

অন্যদিকে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে অনেক বেশি রাজস্ব ব্যয় বাড়ানো থেকে বাধা দেওয়া হয়েছিল, মূলধন উড্ডয়নের সম্ভাবনাকে হুমকির মুখে ফেলেছিল। উদীয়মান অর্থনীতিকে ঋণের জাল থেকে বের করে আনতে বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে যে চেষ্টা হয়েছে, তাকে আধা খেঁচড়া চেষ্টা হিসেবে দেখা যেতে পারে। যেমন মহামারির প্রথম ধাপে ঋণের সুদ দেওয়া স্থগিত করা হয়েছিল। বাড়তি প্রায় কোনো ছাড়ই দেওয়া হয়নি। এতে শুধু সমস্যাটি স্থগিত হয়েছিল। সমস্যাটি শেষ হয়ে যায়নি। এখানে কোনো অর্থপূর্ণ ঋণ পুনর্গঠন করা হয়নি। আইএমএফ উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য আহা-উঁহু করেছে ঠিকই, কিন্তু তারা প্রায় কিছুই করে না। শুধু তা-ই নয়, আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক উভয়ই তাদের ঋণ পরিশোধের জন্য জোরজবরদস্তি করে এবং আইএমএফ তার আরোপিত সারচার্জের ভয়ংকর ব্যবস্থার মাধ্যমে সমস্যাটিকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

লেবানন, সুরিনাম ও জাম্বিয়া ইতিমধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ঋণখেলাপি হয়েছে। বেলারুশ খেলাপির দ্বারপ্রান্তে এবং মিসর, ঘানা ও তিউনিসিয়া মারাত্মক ঋণ সংকটে রয়েছে। এ ধরনের প্রায় সব দেশই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।


দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

জ্যোতি ঘোষ ম্যাসাচুসেটস আমহার্স্ট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক