ইসরায়েলকে কেন ইরানি হামলার জবাব ‘দিতেই’ হবে

ইসরায়েলে ইরানের হামলার ঘটনায় উল্লসিত ইরানি জনগণছবি: এএফপি

ইসরায়েলের কিছু স্বতঃসিদ্ধ বিষয় প্রচলিত আছে, যা চ্যালেঞ্জ করা যায় না। এ রকম জঘন্যতম একটা বিষয় এখন সামনে চলে এসেছে: আমাদের অবশ্যই ইরানি মিসাইল হামলার জবাব দিতে হবে। কিন্তু কেন ‘অবশ্যই’ আমাদের তা করতে হবে?
কারণ, আমাদের অবশ্যই তা করতে হবে, ব্যস। কারণ, তারা [ইরান] এর সূত্রপাত করেছে। কারণ, এবার আমাদের পালা। কারণ, জাতীয় সম্মানের বিষয়। কারণ, নিরাপত্তা। কারণ, যেকোনো দেশই পাল্টা আঘাত করতে পারে। কারণ, আমাদের তাহলে আর কী করতে বলতে চান আপনারা?আমরা কিছুই করব না? এসবই সত্যি। কিন্তু একটু যৌক্তিক চিন্তা করতে অসুবিধা কোথায়? এই যেমন এর খরচ বনাম লাভের বিষয়টি?

এটা অপ্রাসঙ্গিক। তারা আমাদের আঘাত করছে আর তাই আমরা অবশ্যই, চরমভাবে অবশ্যই তাদের পাল্টা আঘাত করব। আচ্ছা, যদি এই পাল্টা আঘাত আমাদের আগের যেকোনো যুদ্ধের চেয়ে আরও অনেক ভয়াবহ যুদ্ধে টেনে নিয়ে যায়? সেটা কোনো ব্যাপার না, আমরা অবশ্যই সমুচিত জবাব দেব। এগুলোই হলো খেলার ময়দানের নিয়মকানুন, যা দিয়ে এই দেশ শাসিত হয় আর যা এর ভবিষ্যৎকে বিপজ্জনক করে তুলছে।

আর ‘কে শুরু করেছে?’ জাতীয় শিশুতোষ প্রশ্নটি চিরন্তন হলেও প্রায় কখনোই এর একটিমাত্র উত্তর মেলেনি। ৭ অক্টোবরের ঘটনার জন্য এটা যেমন সত্যি, এর পরবর্তী ঘটনাক্রমের জন্যও তা সত্যি। এসবের জন্য একাধিক বিকল্প দরকার। কিন্তু আমাদের [ইসরায়েলিদের] এ আলোচনার গণ্ডি এত সংকীর্ণ যে এখানে শুধু কখন, কোথায় ও কতটুকু—এই তিনটি প্রশ্নই যথেষ্ট।

এই তো গত বুধবার অ্যামোস হারেল লিখেছেন যে ইসরায়েলে এখন বিতর্ক চলছে ইরানি হামলার জবাব কি এর সমাপ্তি ঘটাবে নাকি সংঘাত আরও বাড়াবে, তা নিয়ে। প্রথমটা তো সংঘাত আরও বাড়ানোর জন্য সামান্য হলেও ভূমিকা রাখবে। কিন্তু আমাদের কেন অবশ্যই জবাব দিতে হবে? আমরা এ থেকে কী পাব? এসব প্রশ্ন তোলা তো নিষিদ্ধ! ইরান হামলা করেছে। ইসরায়েলকে অবশ্যই জবাব দিতে হবে। কেন? খেলার ময়দানের নিয়ম, তাই।

ইসরায়েল মাত্র একবার, শুধু একবারে এই স্বতঃসিদ্ধ বিষয়টি ভঙ্গ করেছিল এবং ইচ্ছার বিরুদ্ধে। এতে অবশ্য সুফলও মিলেছিল। ইসরায়েলের কঠোরতম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খ্যাত আইজ্যাক শামির তা করেছিলেন। ইরাক থেকে নিক্ষেপ করা স্কাড মিসাইল ইসরায়েলে ধ্বংস ও মৃত্যু ঘটিয়ে আতঙ্ক তৈরি করেছিল। [১৯৯১ সালে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ইরাক এক মাসের মধ্যে ৪০টির বেশি স্কাড মিসাইল হামলা চালিয়েছিল তেল আবিব ও হাইফার ওপর। এতে সরাসরি দুজন মারা যায়, আর আতঙ্কে ও গ্যাস মাস্ক ঠিকমতো ব্যবহার করতে না পেরে আরও ৭০ জন মারা যায়। ২৮টি ভবন পুরোপুরি ধসে পড়ে।]

এই হামলার মুখে শামির আমেরিকার অনুরোধ মেনে নিয়েছিলেন। ইসরায়েল পাল্টা আঘাত করেনি। বাকিটা ইতিহাস। ওটাই ছিল ইসরায়েলের নিজেকে সংযত করার শেষবারের মতো ঘটনা। এতে কোনো ক্ষতি হয়নি, বরং বহু মানুষের জীবন রক্ষা পেয়েছে, প্রধানত ইরাকে। ইসরায়েলেরও নিজস্ব সেনা ও বেসামরিক নাগরিকদের জীবন রক্ষা পেয়েছে।

শামিরই ছিলেন প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি এ ধরনের বলিষ্ঠ নীতি গ্রহণে সাহস দেখিয়েছিলেন। আজকে ইসরায়েলে এমন একজনও সাহসী ইহুদি রাজনীতিবিদ নেই। একজন সেনা কর্মকর্তা বা একজন ভাষ্যকার তো নেই–ই, যিনি সংযত হওয়ার আহ্বান জানাবেন। আক্রমণের বিকল্প কিছু থাকতে পারে এ রকম চিন্তা করাও যেন ভয়ের বিষয়। আর এ ধরনের চিন্তাই তো বিপর্যয়ের পথ তৈরি করে।

এটা কোনো নৈতিকতা বা ন্যায্যতার বিষয় না, বরং যৌক্তিকতার বিষয়। ইরান ভুল করেছে মিসাইল হামলা চালিয়ে। এ ক্ষেত্রে ইসরায়েলের পূর্ণ বৈধ ও নৈতিক অধিকার আছে জবাব দেওয়ার। তাতে কি? ইসরায়েল যদি পূর্ণ শক্তি দিয়ে জবাব দেয়, তাহলে তো নরকের দ্বারগুলো সব খুলে যেতে পারে, যদি ইরানের সামর্থ্য–সম্পর্কিত প্রতিবেদনগুলো সত্যি হয়, আর যদি যুক্তরাষ্ট্র কঠোরভাবে জবাব না দিতে ইসরায়েলকে যে আহ্বান করেছে, সেই নীতিতে অটল থাকে। সে ক্ষেত্রে খরচের খাতটা ভীষণ ব্যয়বহুল হবে, লাভের অঙ্কটা হবে শূন্য। আর প্রাপ্তি? বড়জোর জয়ের একটা মিথ্যা অনুভূতি, যেমনটা গাজা ও লেবাননে হয়েছে ও হচ্ছে। সেই সঙ্গে জনগণের জন্য একতাল মাংসপিণ্ড! জনমত যেমন ইরানকে কঠোর জবাব দিতে পছন্দ করছে, তেমনি জনমতই এর মূল্য চুকাবে।

ইসরায়েল যদি পরিমিত জবাবের পথ বেছে নেয়, তাহলে ঝুঁকি হবে কম কিন্তু লাভের অঙ্ক হবে শূন্য। ‘আমরা অবশ্যই জবাব দেব’—এই কাণ্ডজ্ঞানহীন চিৎকার ছাড়া আর কোনো প্রাপ্তি যোগ হবে না। ইরানকে নিবৃত্ত বা নিরস্ত করা যাবে না, যেমনটা যায়নি হামাস ও হিজবুল্লাহকে। ইরানও হয়তো পরিমিত আরেকটা হামলা চালাতে পারে। তাহলে আমরা অবশ্যই আবার জবাব দেব। তারপর কী?

একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ থেকে আমরা এক কদম দূরে দাঁড়িয়ে আছি। ইসরায়েলের সত্যিকারের ও কাল্পনিক সামরিক সক্ষমতার বদৌলতে আমরা হয়তো জিতেও যাব। তারপর কী? এতে ইসরায়েলের পরিস্থিতির কি উন্নতি হবে? ইরান কি ইসরায়েলকে সমর্থন দিতে সার্বিয়ার সঙ্গে যোগ দেবে? দেশটি কি গাজা ও লেবাননের মতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে? দেশটির সরকারের পরিবর্তন ঘটবে? শাহ কি ফিরে আসবেন? ইরান কি নিরস্ত্র হবে? নাকি ইসরায়েলের মতো দেশটি প্রতিশোধের পাল্টা শোধ নেওয়ার ফাঁদে পতিত হবে? আট বছরব্যাপী চলা ইরাক-ইরান যুদ্ধের মতো আরেকটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে?

হায়, কেই–বা ভেবেছিল যে একদিন আমরা আইজ্যাক শামিরের অভাব অনুভব করব!

  • গিডিয়ন লেভি ইসরায়েলি সাংবাদিক। হারেৎজ–এ প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজি থেকে বাংলায় রূপান্তর করেছেন আসজাদুল কিবরিয়া