রাশিয়ার সবচেয়ে ‘ভয়ংকর’ লোকটার উত্থান যেভাবে

ভ্লাদিমির পুতিন ও রমজান কাদিরভ
ছবি : রয়টার্স

রুশ রিপাবলিক অব চেচনিয়ার নেতা রমজান কাদিরভ সম্প্রতি পুলিশকে ক্ষমতা দিয়েছেন, চেচনিয়ার রাস্তায় ফিলিস্তিনের পক্ষে কোনো প্রতিবাদ হলে পুলিশ তাঁদের গুলি করে হত্যা করতে পারবে। প্রতিবেশী রুশ রিপাবলিক অব দাগেস্তানে গত ২৯ অক্টোবর সেমেটিক–বিরোধী দাঙ্গার ঘটনায় কাদিরভ এ আদেশ দেন।

ফিলিস্তিনিদের প্রতি কাদিরভের সমর্থন নেই, সেটা নয়। তাহলে তিনি কেন এমন আদেশ দিয়েছেন? কাদিরভ আসলে দেখাতে চান, চেচনিয়ার (একসময়ে বিদ্রোহী–অধ্যুষিত) ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণের মুঠোটি শক্ত রয়েছে এবং তিনি চাইলেই তাঁর অসীম ক্ষমতা দেখাতে পারেন। কাদিরভ দেখাতে চান, তাঁর এই ক্ষমতা চেচনিয়ার সীমানার মধ্যেই শুধু আবদ্ধ নয়, উত্তর ককেশাসের মুসলিম দেশগুলোতেও তার বিস্তার।

রাশিয়াজুড়ে কাদিরভ একজন ভয়ংকর ও সমীহ জাগানো ব্যক্তি। ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রার আগ্রাসন শুরুর পর সেটা আরও বেড়েছে। রাশিয়ার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে তাঁর ক্ষমতা ও প্রভাব তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেড়েছে। এই যুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ থেকে তাঁর অবদানের কারণেই সেটা হয়েছে।

উত্তর ককেশাসের ছোট্ট এই প্রজাতন্ত্রের নেতা কাদিরভ কীভাবে রাশিয়ার এত ভয়ংকর ব্যক্তিতে পরিণত হলেন?

রাশিয়ার ইতিহাস ও চেচনিয়ার রাজনীতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমরা মনে করি, কাদিরভের ক্ষমতা ও রাজনৈতিক বৈধতার ভিত্তি হলো তাঁর নিষ্ঠুর সেনাবাহিনী, জবাবদিহির অভাব, পুতিনের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবহার।

নিষ্ঠুর ক্ষমতার উত্থান

রমজান কাদিরভের বাবা আখমাদ কাদিরভ ১৯৯০-এর দশকে চেচনিয়ার একজন মুফতি ছিলেন। তিনি ও তাঁর ছেলে রমজান কাদিরভ ছিলেন চেচনিয়ার স্বাধীনতাসংগ্রামের কট্টর সমর্থক। যাহোক, ১৯৯৪-৯৬ সালে প্রথম চেচনিয়া যুদ্ধে স্বাধীনতাপন্থী সরকারের সঙ্গে আখমাদের বিরোধ হয়। সেই বিরোধের সূত্র ধরে তিনি ভ্লাদিমির পুতিনের বলয়ে ঢুকে পড়েন।

দ্বিতীয় চেচনিয়া (১৯৯৯-২০০৯) যুদ্ধের সময় পুতিন চেচনিয়া প্রজাতন্ত্রের ক্ষমতায় বসান আখমাদকে। দ্বিতীয় চেচনিয়া যুদ্ধে আখমাদের ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা বাড়ে তাঁর আগ্রাসী ভূমিকার কারণে।

২০০৪ সালে আখমাদ খুনের শিকার হন। সে সময় রমজানের বয়স ২৭ বছর।

চেচনিয়ার বৈধভাবে ক্ষমতায় বসার জন্য তাঁর বয়স তখনো তিন বছর কম। এই তিন বছরকে তিনি তাঁর ক্ষমতা সংহত করা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা নিশ্চিত করার কাজে ব্যবহার করেছিলেন। সেটা অর্জনের জন্য তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরিয়ে দেন, যাঁরা তাঁর বাবার ঘনিষ্ঠ ছিলেন। কয়েকজনকে নীরব করে দেন। কয়েকজনকে নির্বাসনে পাঠান। অন্যদের খুন করা হয়।

আরও পড়ুন
২০১১ সালে কাদিরভ খুব বলিষ্ঠভাবে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আমিই বস! আমিই স্টিয়ারিংয়ের চাকা!’ এই ঘোষণা তিনি দিয়েছিলেন চেচনিয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়ার চার বছরের মাথায়। এর পর থেকে তিনি বারবার মানবাধিকার ও আইনের শাসন ভূলুণ্ঠিত করে আসছেন। তাঁর সমর্থকেরা অপহরণ, নির্যাতন ও চেচনিয়ার লোকজনের কাছ থেকে অর্থ লুণ্ঠনে জড়িত।

২০০৭ সালে বয়স ৩০ হলে রমজানকে চেচনিয়ার সরকারপ্রধান করা হয়। সে সময় রাশিয়া তাদের কেন্দ্রীয় বাহিনীকে চেচনিয়ার সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযানে পাঠিয়েছিল। চেচনিয়ার সব ধরনের নিরাপত্তা–সম্পর্কিত সমস্যা ধৈর্যের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ নেন কাদিরভ। একটা অনুগত সেনাবাহিনী গঠন করতে সফল হন তিনি।

উঁচু পেশাদারিত্বের কারণে আধা সামরিক বাহিনী স্থানীয়ভাবে ‘কাদিরভিস্তি’ নামে পরিচিত। তাঁরা  প্রাইভেট সেনাবাহিনী হিসেবে কাজ করে। চেচনিয়ার ভেতরে ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন এবং সীমানা পেরিয়ে কাদিরভের প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার কাজটি তাঁরা করেন। কাদিরভের ঘনিষ্ঠ সেনারা রুশবিরোধী নেতা, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও অন্যদের খুনের সঙ্গে জড়িত। যদিও কাদিরভ এসব হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে আসছেন।

রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সমর্থনে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে কাদিরভ তাঁর সেনাদের প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদের পক্ষে যুদ্ধ করতে পাঠান। ২০১৪ সালে ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলে সংঘাত শুরু হলে তিনি সেখানেও তাঁর সেনাদের পাঠান। ২০২২ সালে ইউক্রেন আগ্রাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এসব ভূমিকা পুতিনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সমর্থকদের মধ্যে কাদিরভের অবস্থান আরও পোক্ত করে।

পুতিনের প্রতি শর্তহীন আনুগত্য

১৯৯৯ সালে পুতিনের ক্ষমতায় বসার বছরটিকে চেচেনের স্বাধীনতাসংগ্রামে সমাপ্তির শুরুর বছর বলে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু পুতিনের শাসনকালে কাদিরভ ও তাঁর সঙ্গীরা রুশ রাষ্ট্রের ভেতর অভূতপূর্ব মাত্রার স্বায়ত্তশাসন ভোগ করেন। এই স্বায়ত্তশাসন ভোগ করার বড় কারণ হলো, পুতিনের সঙ্গে কাদিরভের ব্যক্তিগত সম্পর্ক। আখমাদ কাদিরভের মৃত্যুর কয়েক দিনের মধ্যে রমজান ক্রেমলিনে হাজির হন। পুতিন খুব আন্তরিকভাবে তরুণ কাদিরভকে আলিঙ্গন করে নেন। সে ঘটনাই পুতিন ও কাদিরভের মধ্যে যে শক্তিশালী পৃষ্ঠপোষক-মক্কেল সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল।

প্রবল আনুগত্য এবং উত্তর ককেশাসের বিদ্রোহ দমনে সফলতার কারণে- চেচনিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কাদিরভের ওপর ছেড়ে দেন পুতিন। চেচনিয়ার অর্থনীতি পুনর্গঠনের জন্য পুতিন ব্যাপক ভর্তুকি দেন। এর ফলে দু-দুটি যুদ্ধে ধ্বংস হওয়া চেচনিয়া পুনর্গঠন করতে সক্ষম হন কাদিরভ। এর মাধ্যমে কাদিরভ নিজে প্রভূত সম্পদের মালিক হন এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ মিত্ররাও প্রচুর সম্পদের মালিক হন।

কাদিরভ সুফিবাদী পারিবারিক আবহে বেড়ে ওঠেন। কাদিরভের আমলে চেচনিয়ায় সুফিবাদী ইসলামের বিকাশ হয়েছে। সুফিবাদই সেখানে ইসলামের একমাত্র গ্রহণযোগ্য ঘরানা।

কাদিরভ চেচনিয়ার ভেতরে ধর্মকে তাঁর সমর্থক গোষ্ঠীকে মোহাবিষ্ট করতে এবং তাঁর রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শন করতে ব্যবহার করেন। মসজিদ, মাদ্রাসা নির্মাণের মাধ্যমে তিনি ইসলামি মূল্যবোধের বিকাশ ঘটিয়েছেন। পোশাকের কঠোর বিধিবিধানসহ জনপরিসরে জনগণ কী ধরনের ধর্মীয় আচরণ করবে, সে নির্দেশনাও তিনি দিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক মঞ্চে এবং রাশিয়ার ভেতরে রাজনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করতেও ইসলামকে ব্যবহার করছেন কাদিরভ। ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা হামলার ঘটনায় তিনি ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন দেন। শান্তি রক্ষা মিশনে সেখানে তাঁর সেনা পাঠানোর প্রস্তাব দেন।

কাদিরভ মনে করেন, ইউক্রেনে তাঁর সেনারা ‘পশ্চিমা শয়তানি মতাদর্শের’ বিরুদ্ধে পবিত্র জিহাদে অংশ নিচ্ছেন। তিনি মাঝেমধ্যেই চেচনিয়ার মসজিদগুলো থেকে ভিডিও পোস্ট করছেন, যেখানে দেখা যাচ্ছে, লোকজন ইউক্রেনে রাশিয়ার বিজয় ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য প্রার্থনা করছে।

২০১১ সালে কাদিরভ খুব বলিষ্ঠভাবে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আমিই বস! আমিই স্টিয়ারিংয়ের চাকা!’ এই ঘোষণা তিনি দিয়েছিলেন চেচনিয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়ার চার বছরের মাথায়। এর পর থেকে তিনি বারবার মানবাধিকার ও আইনের শাসন ভূলুণ্ঠিত করে আসছেন। তাঁর সমর্থকেরা অপহরণ, নির্যাতন ও চেচনিয়ার লোকজনের কাছ থেকে অর্থ লুণ্ঠনে জড়িত।

নিজের কর্তৃত্বে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়, এমন কোনো জন–অসন্তোষকে কাদিরভ নিষ্ঠুরভাবে দমন করতে প্রস্তুত। পুতিনের প্রতি তাঁর আনুগত্যের পেছনে কাদিরভের নিজস্ব অ্যাজেন্ডা আছে। সেখানে তাঁকে দুর্বল দেখাক, কাদিরভ সেটা চান না।

  • আনিয়া ফ্রি অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের ফ্যাকাল্টি অ্যাসোসিয়েট
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত