‘আমেরিকা ফার্স্ট’ কৌশলে কোন দেশের লাভ, কোন দেশের ক্ষতি

ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে সবচেয়ে বিপদে পড়বেন অভিবাসীরাছবি : রয়টার্স

ট্রাম্প প্রশাসন সম্প্রতি যে জাতীয় নিরাপত্তাকৌশল (ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্ট্র্যাটেজি—এনএসএস) প্রকাশ করেছে, তা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে একটি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এই নথি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়—যুক্তরাষ্ট্র অতীতের পথ ছেড়ে নতুন পথে হাঁটতে চায়। তবে এই নীতি বাস্তব দুনিয়ায় কতটা কার্যকর হবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। কারণ, বিশ্বরাজনীতি দ্রুত বদলাচ্ছে এবং ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাও জটিল।

এই কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি। এর মূল কথা হলো, যুক্তরাষ্ট্র শুধু নিজের মূল জাতীয় স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দেবে। অন্য কোনো বিষয় তখনই গুরুত্বপূর্ণ হবে, যদি তা সরাসরি আমেরিকার স্বার্থে আঘাত হানে। এই দৃষ্টিভঙ্গি ট্রাম্পের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের সঙ্গেও মিল রয়েছে।

এই নীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ। কৌশলপত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমেরিকার অর্থনৈতিক শক্তি বাড়ানো এবং বিশ্বে তার অর্থনৈতিক নেতৃত্ব ধরে রাখাই এখানে প্রধান লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হিসেবে ধরা হয়েছে বাণিজ্যনীতি। পুরো নথিতেই ট্রাম্পের লেনদেনভিত্তিক ও একতরফা চিন্তাধারার প্রতিফলন দেখা যায়।

এই এনএসএসের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, এতে স্বীকার করা হয়েছে, বর্তমান বিশ্ব আর একক ক্ষমতাকেন্দ্রিক নয়। বিশ্ব এখন বহু মেরুর; অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব আছে, কিন্তু তারও সীমা রয়েছে। কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র আর পুরো বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবে না। এটি কেবল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং বৈশ্বিক ক্ষমতার বাস্তব পরিবর্তনের স্বীকৃতি। বিশেষ করে অর্থনৈতিক শক্তির ভারসাম্য এখন আর এককভাবে আমেরিকার হাতে নেই।

এনএসএসে যখন বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব ও আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখবে, তখন সেটির অর্থ দাঁড়ায়—বিশ্বের বড় ও মাঝারি শক্তিধর দেশগুলোর প্রভাব মেনে নেওয়া। তবে এর মানে এই নয় যে যুক্তরাষ্ট্র অন্য কোনো দেশকে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে দেবে।

কৌশলপত্রে স্পষ্ট বলা হয়েছে, এমন কোনো শক্তিকে উঠতে দেওয়া হবে না, যা আমেরিকার স্বার্থের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র জোট গড়বে। কিন্তু একই সঙ্গে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে সব শক্তির প্রভাব কমাতে গিয়ে আর অযথা রক্ত ও সম্পদ ব্যয় করা হবে না।

এই নথি থেকে বোঝা যায়, ট্রাম্প প্রশাসন একটি সীমিত ও বেছে নেওয়া বৈশ্বিক নেতৃত্বে বিশ্বাস করে; অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র সব জায়গায় হস্তক্ষেপ করবে না। এটি আগের মার্কিন নেতৃত্বের ধারণা থেকে বড় ধরনের সরে আসা। নথিতে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে—গ্রিক দেবতা অ্যাটলাসের মতো কাঁধে করে পুরো বিশ্বব্যবস্থা বহন করার দিন শেষ।

শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের আগেকার জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলগুলোরও তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। সেগুলোকে বলা হয়েছে অতিরিক্ত বিস্তৃত ও সীমাহীন। নথিতে দাবি করা হয়েছে, তখনকার মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা বিশ্বাস করতেন, বিশ্বজুড়ে স্থায়ী মার্কিন আধিপত্যই আমেরিকার জন্য সবচেয়ে ভালো। নতুন কৌশল এই ধারণা থেকে সরে এসেছে। এখন বলা হচ্ছে—অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় তখনই গুরুত্বপূর্ণ, যখন তা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে আঘাত হানে। এটিকেই নথিতে একটি প্রয়োজনীয় নীতিগত সংশোধন বলা হয়েছে।

এই কৌশলপত্রে পাকিস্তানের নাম নেই। তবে এর নীতিগত দিকগুলো পাকিস্তানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে। শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এই কৌশল কতটা বাস্তবে প্রয়োগ করা হয়। কারণ, ট্রাম্পের অনিশ্চিত ও খামখেয়ালি নেতৃত্ব যুক্তরাষ্ট্রের নীতির ধারাবাহিকতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন তোলে।

এই কৌশলপত্র এমন এক বিশ্বের ধারণা তুলে ধরে, যেখানে বড় শক্তিগুলো নিজেদের প্রভাববলয়ে প্রভাব বিস্তার করবে। সেখানে তারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবে। নথিতে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কে এটি একটি চিরন্তন বাস্তবতা—বড়, ধনী ও শক্তিশালী দেশগুলোর প্রভাব সব সময় বেশি থাকে।

এই এনএসএসের আরেকটি বড় পরিবর্তন হলো—এতে বড় শক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা নিয়ে খুব বেশি কথা বলা হয়নি। চীন ও রাশিয়ার ক্ষেত্রে সংঘাত এড়িয়ে চলার নীতি নেওয়া হয়েছে। কোথাও তাদের শত্রু বলা হয়নি; বরং রাশিয়ার সঙ্গে আবার কৌশলগত স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য একটি হুমকি হিসেবে দেখা হয়েছে।

এই কৌশলপত্রে সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে অভিবাসনকে। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এটি ঠেকানোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এই লক্ষ্য পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গেও যুক্ত। সে কারণে পশ্চিম গোলার্ধকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে ধরা হয়েছে। সেখানে পুনর্জাগরিত মনরো নীতি কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে। লক্ষ্য হলো—অভিবাসন বন্ধ করা, মাদক পাচার ঠেকানো এবং চীনের প্রভাব মোকাবিলা করা।

চীনকে এখানে ‘সমপর্যায়ের কাছাকাছি শক্তি’ বলা হয়েছে। তাকে প্রতিযোগী হিসেবে দেখা হয়েছে, সরাসরি হুমকি হিসেবে নয়। তবে এতে চীনকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের ঘেরাও নীতি দুর্বল হয়নি; বরং এ জন্যই ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলা হয়েছে। এই অঞ্চলেই যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় জিততে চায়।

নথিতে চীনের শিল্পদক্ষতা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রশংসাও করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন ভারসাম্য গড়তে চায় এবং পারস্পরিক লাভজনক অর্থনৈতিক সম্পর্কের কথা বলেছে। একই সঙ্গে তাইওয়ান নিয়ে সংঘাত ঠেকানোর প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। এই লক্ষ্যেই তাইওয়ানের কাছে ১১ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, যা পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করতে পারে।

ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশলে ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দেওয়া হয়েছে। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ও অন্যান্য সম্পর্ক উন্নত করার কথা বলা হয়েছে। তবে মূল লক্ষ্য হলো, ভারতকে আঞ্চলিক নিরাপত্তায় বড় ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করা। যুক্তরাষ্ট্র এখনো ভারতকে চীনের বিপরীতে একটি কৌশলগত ভারসাম্যকারী শক্তি হিসেবে দেখে। এ কারণেই ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের একটি দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তি তৈরি হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্য এখন আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান কৌশলগত অগ্রাধিকার নয়। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে—যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি উৎস বৈচিত্র্যময় হয়েছে, পরাশক্তির প্রতিযোগিতা কমেছে এবং ইরান সামরিকভাবে দুর্বল হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এখানেও কোনো শত্রুশক্তিকে একচ্ছত্র আধিপত্য বা জ্বালানি পরিবহন পথের নিয়ন্ত্রণ নিতে দেবে না।

ইউরোপের ক্ষেত্রেও কঠোর ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। ইউরোপকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ও অভিবাসনের কারণে সভ্যতাগত সংকটে পড়া অঞ্চল হিসেবে দেখানো হয়েছে। ইউরোপীয় সরকারগুলোর বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ক্ষুণ্ন করার অভিযোগ তোলা হয়েছে। অভিবাসন ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে ডানপন্থী জনতাবাদী শক্তিকে সমর্থন দেওয়ার কথাও বলেছে। এটি অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার দাবির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

এই দ্বিচারিতা স্পষ্ট হয়েছে ভেনেজুয়েলার ক্ষেত্রে। যুক্তরাষ্ট্র সেখানে হস্তক্ষেপ করেছে এবং তাদের সরকারকে বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন বলেও ঘোষণা দিয়েছে।

এই কৌশলপত্রে পাকিস্তানের নাম নেই। তবে এর নীতিগত দিকগুলো পাকিস্তানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে। শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এই কৌশল কতটা বাস্তবে প্রয়োগ করা হয়। কারণ, ট্রাম্পের অনিশ্চিত ও খামখেয়ালি নেতৃত্ব যুক্তরাষ্ট্রের নীতির ধারাবাহিকতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন তোলে।

  • মালিহা লোধি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত।

ডন থেকে নেওয়া অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ