যুদ্ধবিরতি বিষয়ে এই লেখা লেখার জন্য বেঁচে থাকব, এ কথা আমি ভাবিনি।
২০১৩ সালের ১৩ অক্টোবর গাজা শহরে আমার বাড়ি থেকে উৎখাত হলাম। অল্প কয়েকটা জিনিস সঙ্গে নিয়ে যেতে পেরেছিলাম। তার মধ্যে ছিল আমার ল্যাপটপ। জানতাম, এটা দিয়ে অজস্র গণহত্যার দলিল আমি লিখব। তবে তা কাউকে দেওয়ার জন্য আমি বেঁচে থাকব কি না, তা জানতাম না।
তবে, আমি এখনো বেঁচে আছি। আমার মতো সাংবাদিকদের বারবার মনে হয়েছে, ইসরায়েলিরা যেন বিশেষ করে আমাদের মৃত্যু নিশ্চিত করতে চাইছে।
কিন্তু এই টিকে থাকার জন্য মূল্য দিতে হয়েছে। সারা জীবনের জন্য আমার কাছে জীবন আর মৃত্যুর অর্থ পালটে গেছে।
গত ১৫ মাসে আমাকে মধ্য ও দক্ষিণ গাজা উপত্যকার তিনটি আশ্রয়কেন্দ্রে জোর করে স্থানান্তর করা হয়েছে। সবচেয়ে দূরের আশ্রয়টি ছিল আমার বাড়ি থেকে প্রায় ৪০ মিনিটের পথ। এই পুরো সময়ে মৃত্যুকে আমি আমার ফেলে আসা বাড়ির চেয়ে কাছাকাছি অনুভব করেছি।
আমি এর মধ্যে প্রতিবেদন লিখে গেছি। সেখানে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বর্বরতার কথা এসেছে। আমার প্রত্যেক সাংবাদিক সহকর্মীর মৃত্যুর খবর শোনার পর মনে হয়েছে, এরপর হয়তো আমার নাম আসবে সেই তালিকায়। কিন্তু আমার কাছে তখন বেঁচে থাকার অর্থ শুধুই টিকে থাকা নয়। বরং সময়ের বিরুদ্ধে দৌড়ানো আর বেশি গল্প সংগ্রহ করা সম্ভব, তা সংগ্রহ করার চেষ্টা করা। আমার অন্য সহকর্মীদের মতো বোমা বা গুলিতে মরে যাওয়ার আগে কণ্ঠহীন আমার ফিলিস্তিনি জনতার কথা যতটা সম্ভব শুনিয়ে যেতে পারি।
যখন ইসরায়েল আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের গাজায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করল, তখন থেকেই স্থানীয় ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের ওপর বিশাল এক দায়িত্ব নেমে আসে। ইসরায়েলিরা ধারাবাহিকভাবে বিদ্যুৎ বন্ধ করে রাখত যেন আমাদের মতো সাংবাদিকেরা স্তব্ধ হয়ে যায়।
গাজার বাস্তুচ্যুত মানুষেরা প্রায়ই নিজের অজান্তে এমনি করে তাঁদের ফেলে আসা মহল্লার নাম ধরে ডেকে ওঠেন। আমার বিস্ময় লাগে! আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি গণহত্যার মুখোমুখি হওয়ার পরও গাজার ফিলিস্তিনিরা ঘরে ফেরার ধারণাটি আঁকড়ে ধরে রেখেছেন।
আমরা ছোট ছোট বিজয়ের মধ্য দিয়ে আশা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছাদে সময় কাটাতে হয়েছে, রাস্তায় হেঁটে বেড়াতে হয়েছে ই-সিম সিগন্যাল পেতে। প্রতিটি বার্তা পাঠাতে, প্রতিটি প্রতিবেদন পৌঁছে দিতে কতটা ধৈর্য আর ঝুঁকি নিতে হয়েছে! আমাদের পাঠানো একেকটা সংবাদ, একেকটা প্রতিবেদন ছিল নিঃশব্দ একেকটি বিজয়।
আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার সময় সবকিছুর যেন অর্থ পালটে যেতে দেখলাম চোখের সামনে। যখন কয়েক মাস পরে সৌর প্যানেলের সাহায্যে প্রথমবার টিভি চালাতে সক্ষম হলাম, দেখলাম এক সংবাদ সম্মেলনে গাজায় চলমান বর্বরতা আর সাধারণ নাগরিকদের প্রতিদিনের হত্যার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু বক্তৃতার চেয়ে আমাকে বেশি টানল বক্তার নিখুঁত স্যুট, তাঁর সামনে থাকা ঝকঝকে পানির গ্লাস এবং পাশে রাখা জুসের বোতল। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল পানির বোতল ভরার দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানো মানুষ, যেসব মানুষ গোসল করার পানি দুর্লভ বলে জানে।
এ সপ্তাহে অবশেষে বহুপ্রতীক্ষিত গাজায় যুদ্ধবিরতির চুক্তি ঘোষণা করা হয়েছে। যখন এই চুক্তি ঘোষণা করা হয়, তখন আমি দেইর আল-বালাহর আল-আকসা হাসপাতালে। আমি ইচ্ছা করেই মুহূর্তটি এমন একটি জায়গা থেকে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যা আমার স্মৃতিতে জীবন আর মৃত্যুর এক প্রতীক হিসেবে আঁকা থাকবে।
এই হাসপাতালেই আমি বহু সাক্ষাৎকার নিয়েছি। যাঁরা ইসরায়েলি হামলায় লক্ষ্যবস্তু হয়েছিলেন, যাঁরা হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছিলেন আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য, আমি তাঁদের সাক্ষ্য নিয়ে রেখেছি।
ব্লকেডের মধ্যে থাকা প্রায় সব হাসপাতালের মতো, এই হাসপাতালও সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতার সাক্ষী। এই হাসপাতাল নিজেও একটি গণহত্যার স্থান। এখানে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী হাসপাতালের প্রাঙ্গণে অস্থায়ী তাঁবুতে থাকা বাস্তুচ্যুত বেসামরিক মানুষদের জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিল।
যুদ্ধবিরতি ঘোষণার ঠিক আগে ও পরে, আমি হাসপাতালের ভেতর ৯ জন ফিলিস্তিনির সঙ্গে কথা বলি। তাঁরা ছিলেন বাস্তুচ্যুত মানুষ, সাংবাদিক, কেউ বা রোগী। তাঁদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলে তাঁরা প্রথম কী করতে চান। তাঁদের উত্তর ছিল একটাই। কত সহজ কিন্তু অসম্ভব হৃদয়বিদারক এক চাওয়া। তাঁরা উত্তর গাজায় নিজেদের বাড়িতে ফিরে যেতে চান।
যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়া আমরা কাছ থেকে দেখেছি, ইসরায়েল কীভাবে উত্তর গাজায় রয়ে যাওয়া মানুষদের প্রতি হিংস্র পশুর মতো আচরণ করেছে। গাজা থেকে বাসিন্দাদের তাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে ইসরায়েল নিরন্তর কাজ করেছে। জোরপূর্বক উচ্ছেদের আদেশ, ক্ষুধার্ত রাখা, গণহত্যা—কিছুই বাকি ছিল না। এরপরও যাঁরা বাড়ি ছাড়তে অস্বীকার করেছেন, তাঁদের সরাসরি হত্যা করা হয়েছে।
কিন্তু ইসরায়েলের উচ্ছেদের আদেশ মেনে চলাও কি নিরাপদ বিকল্প ছিল? না। গাজার সর্বত্র ফিলিস্তিনিরা যেকোনো মুহূর্তে বোমায়, গুলিতে নিহত হতে পারেন।
যুদ্ধবিরতি ঘোষণার দুই দিন আগের কথা। ফিলিস্তিনিরা দম আটকে অপেক্ষা করছিলেন। দেইর আল-বালাহর সবচেয়ে জনাকীর্ণ একটি এলাকায় দেখলাম একটি গাধাচালিত গাড়ির চালক আমার পাশ দিয়ে চলে গেলেন। তিনি পাগলের মতো চিৎকার করছিলেন—শুজাইয়া, রিমাল, তাল আল-হাওয়া! এগুলো গাজার সিটি অঞ্চলের কিছু এলাকার নাম। এসব এলাকা থেকে আমাদের এক বছরের বেশি আগে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা হয়েছিল। মনে হচ্ছিল, লোকটা যেন সেখানে আমাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়িতে ফিরে যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন।
গাজার বাস্তুচ্যুত মানুষেরা প্রায়ই নিজের অজান্তে এমনি করে তাঁদের ফেলে আসা মহল্লার নাম ধরে ডেকে ওঠেন। আমার বিস্ময় লাগে! আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি গণহত্যার মুখোমুখি হওয়ার পরও গাজার ফিলিস্তিনিরা ঘরে ফেরার ধারণাটি আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। ১৫ মাসের নিরন্তর সন্ত্রাস, বোমাবর্ষণ, ক্ষুধা ও ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে ঘরবাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। পুরো সম্প্রদায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে প্রায়। কিন্তু তখনো প্রার্থনার সময় টিকে থাকার আগে ঘরে ফেরার প্রার্থনা এসেছে আগে।
আমি হেসে উঠলাম। অজান্তেই আমার আঙুল ব্যাগের ভেতরে চলে গেল। আমার আঙুলে ঠেকল গাজা সিটিতে ছেড়ে আসা আমার বাড়ির চাবি। সেই বাড়ির দরজা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর গোলায় উড়ে গেছে। কিন্তু এই চাবি সব সময় আমার সঙ্গে থেকেছে। কেন যেন আমার মন আমাকে বারবার বলেছে, হয়তো কোনো এক দিন আমার এই চাবি দরকার হবে।
মাহা হুসেইনি গাজা অধিবাসী, পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী