বুদ্ধি হারানো ছাড়া কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করা যাবে

‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর টুল যতই দ্রুত ও চমকপ্রদ হোক না কেন, এদের ওপর বেশি নির্ভরশীলতা আমাদের মনকে অলস করে দিতে পারে।’

সম্প্রতি জেমিনি ডিপ থিঙ্ক ও জিপিটি-৫ চালু হওয়ার পর বড় ভাষা মডেলের (লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল বা এলএলএম) দ্রুত উন্নতি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এখন বিশ্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ প্রতিষ্ঠান এই এলএলএম ব্যবহার করছে। হয়তো আপনি নিজেও এগুলো ব্যবহার করে দেখেছেন। প্রথমবার ব্যবহার করলে হয়তো আপনি মুগ্ধ হয়েছেন। আবার নতুন চ্যাটজিপিটির ক্ষেত্রে ততটা মুগ্ধ না–ও হতে পারেন। কিন্তু হয়তো খেয়াল করেছেন, এখন আপনি সহজে মনোযোগ হারাচ্ছেন, স্মৃতি আগের মতো কাজ করছে না, আর যেসব কাজ আগে সহজ মনে হতো, সেগুলো এখন কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

এটা আপনার কল্পনা নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর টুল যতই দ্রুত ও চমকপ্রদ হোক না কেন, এদের ওপর বেশি নির্ভরশীলতা আমাদের মনকে অলস করে দিতে পারে। এতে আমরা ধীর হয়ে যাই, সৃজনশীলতা কমে যায় এবং নিজে চিন্তা করার ক্ষমতাও হ্রাস পায়। চলমান গবেষণায় কিছু প্রধান প্রবণতা সামনে এসেছে।

গত দুই দশকে স্মার্টফোন ও অন্যান্য ডিভাইস আমাদের মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতা অনেক কমিয়ে দিয়েছে। সারাক্ষণ নোটিফিকেশন আসা এবং অবিরাম স্ক্রল করার প্রলোভন আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া ও কাজ শেষ করার ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। প্রতিটি মেসেজ বা আপডেটের পর মস্তিষ্ক সামান্য আনন্দ অনুভব করে, যা এই অভ্যাসকে আসক্তিতে পরিণত করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই ব্যাঘাত এবং তাত্ক্ষণিক সন্তুষ্টি দীর্ঘ মেয়াদে গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোযোগ দেওয়া আরও কঠিন করে তোলে।

আজকাল তথ্য সহজে হাতের কাছে থাকায় মানুষের স্মৃতি ও তথ্য সংগঠনের ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ‘গুগল ইফেক্ট’ নিয়ে গবেষকেরা দেখেছেন, স্মার্টফোনের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা স্মৃতিশক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। আগের প্রজন্মকে ফোন নম্বর, কবিতা, এমনকি পিরিয়ডিক টেবিল মুখস্থ করতে হতো।

এআইয়ের কারণে মানুষের যুক্তি প্রয়োগের ক্ষমতাও কমছে। অনেকেই এখন চিন্তার দায়িত্ব চ্যাটজিপিটি, জেমিনি বা ডিপসিকের মতো এআই টুলের হাতে ছেড়ে দিচ্ছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, এটি আমাদের পরিষ্কারভাবে চিন্তা করা, যুক্তি বোঝা এবং ভুল যুক্তি ধরার ক্ষমতা নষ্ট করছে। এটি মানসিকভাবে এমন, যেন আপনি নিজে ব্যায়াম না করে অন্য কাউকে দিয়ে ব্যায়াম করাচ্ছেন। এতে তাৎক্ষণিকভাবে শক্তি বাঁচে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতা দুর্বল হয়।

এলএলএমের আগে গবেষকেরা তথ্য জানতে চাইলে ইন্টারনেটে খুঁজে দেখতেন। তারও আগে লাইব্রেরিতে গিয়ে বই, জার্নাল বা অন্যান্য উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করতেন। প্রতিটি তথ্য যাচাইও করতে হতো। এই পুরো প্রক্রিয়া মস্তিষ্ককে প্রস্তুত করত। আমরা তথ্য মনে রাখতাম, প্রয়োগ করতাম, বিশ্লেষণ করতাম এবং নতুন কিছু তৈরি করতাম। এই ধাপে ধাপে চিন্তার প্রক্রিয়া স্মৃতি, বিশ্লেষণ ও সৃজনশীলতা বাড়াত।

কিন্তু এখন যদি আমরা সব কাজ এলএলএমের ওপর ছেড়ে দিই, নিজের খোঁজখবর, যাচাই ও বিশ্লেষণ বাদ দিই, তাহলে মস্তিষ্কের সেই ক্ষমতাগুলো ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যাবে। মস্তিষ্ক ব্যায়াম না করলে দুর্বল হয়ে যায়, আর এই ধাপগুলোই ছিল মস্তিষ্কের ব্যায়াম। এখন আর আমরা ধারণাগুলো খুঁটিয়ে দেখা, বিতর্ক করা বা চ্যালেঞ্জ করার অভ্যাস রাখি না। ফলে চিন্তাশক্তি ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে।

প্রাচীন গ্রিসের মানুষেরা বুঝতেন, শিক্ষার্থীদের বিনোদন বা প্রশংসা দিয়ে শেখানো সম্ভব নয়। প্রকৃত শিক্ষা আসে যখন শিক্ষার্থীদের বিশ্বাসকে প্রশ্নের মুখে ফেলা হয়। সক্রেটিসীয় পদ্ধতিতে (সক্রেটিক মেথড) শিক্ষক জিজ্ঞাসা করতেন, ‘তুমি এটি দিয়ে কী বোঝাচ্ছ? এর পক্ষে কী প্রমাণ আছে? অন্য কোনো দৃষ্টিভঙ্গি কি ভেবেছ?’ এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা অনুমান যাচাই করতে এবং যুক্তি আরও ধারালো করতে বাধ্য হতো।

শেষমেশ আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কি আমাদের মস্তিষ্ককে এআইয়ের হাতে ছেড়ে দেব, নাকি এলএলএমকে এমন একজন প্রতিদ্বন্দ্বীর মতো ব্যবহার করব, যে আমাদের চিন্তাশক্তি আরও ধারালো করতে সাহায্য করবে।

  • নাইরি উডস অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লাভাটনিক স্কুল অব গভর্নমেন্টের ডিন

  • স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত