ভারতে এক সন্তান নীতির ধুয়া তোলা হচ্ছে কেন

জাতিসংঘের বিশ্ব জনসংখ্যা সম্ভাবনা ২০২২ রিপোর্ট বলছে, ২০২৩ সালে বিশ্বের বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ হিসেবে ভারত চীনকে ছাড়িয়ে যাবে। তারা বলেছে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যা ৮০০ কোটিতে পৌঁছে গেছে।

গত মার্চের প্রথম দিকে, চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খবর ছড়িয়েছিল, ভারতের জনসংখ্যা ইতিমধ্যেই চীনকে ছাড়িয়ে গেছে, অবশ্য বিশেষজ্ঞরা এ খবরের সত্যতা খারিজ করে দিয়েছেন। বর্তমানে ভারতে নারীরা তঁাদের মায়েদের চেয়ে কম সন্তান জন্ম দিচ্ছেন। তবে জন্মহার আগের চেয়ে কমলেও দেশটিতে জনসংখ্যা এখনো বেড়ে চলেছে। এ কারণেই হয়তো চীনের একসময়ের অনুসৃত ‘এক সন্তান নীতি’র মতো কোনো একটি নীতি ভারতের গ্রহণ করা উচিত বলে রাজনৈতিক মূলধারায় আলোচনা চলছে। কিন্তু ভারতকে চীনের বিগত জনসংখ্যা নীতি অনুকরণ করা উচিত—এই ধারণাটি ভয়ানক বিপজ্জনক।

উভয় দেশই জনসংখ্যাসংক্রান্ত কড়া নীতির পরম্পরা ধরে রাখার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে ভারতকে অনেক বেশি সতর্ক হতে হচ্ছে। কারণ, কঠোরভাবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নারী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য বিপর্যয়কর পরিণতি ডেকে আনতে পারে।

১৯৫২ সালে ভারত বিশ্বে প্রথম জাতীয়ভাবে পরিবার-পরিকল্পনা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে। এতে জন্মহার পড়তির দিকে যেতে শুরু করে, কিন্তু তার গতি ছিল মন্থর। এর ফলে পরিবারের আকার আগের মতোই বড় থেকে যায়। সরকার তখন ব্যাপকভাবে জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ কর্মসূচি কার্যকর করতে থাকে। বিশেষ করে ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ভারতে যখন ‘জরুরি অবস্থা’ ছিল, সে সময় মুসলমান এবং শহুরে দরিদ্রদের জোর করে এই কার্যক্রমের আওতায় আনা হয়েছিল।

১৯৪৯ সালে গণচীন প্রতিষ্ঠার পর শিশুমৃত্যু উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। ১৯৫০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে সে দেশের জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। এর ফলে দেশটি ১৯৮০–এর দশকের গোড়ার দিকে ‘এক সন্তান নীতি’ গ্রহণ করে এবং কোনো দম্পতি

কূটাভাস হলো এই, ভারতের জন্মহার এবং পরিবারের আকার সংকুচিত হচ্ছে নারীদের নিজস্ব প্রজনন পছন্দের কারণে। এখানে অনেক নারী দুটি সন্তান হওয়ার পরে (বা একটি ছেলে হওয়ার পরে) অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে গর্ভনিরোধ করছেন। ডাক্তার এবং নারীদের, অর্থাৎ গ্রামীণ দরিদ্র নারীদের আর্থিক প্রলোভন দেখিয়ে স্থায়ী জন্মনিরোধক অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে।

এক সন্তানের বেশি জন্ম দিতে পারবেন না বলে আইন তৈরি করে। ফলে জন্মহার কমে আসে। ভারত ও চীন উভয় দেশের ক্ষেত্রেই এই জনসংখ্যা নীতি ছিল অনেকটাই অনিচ্ছাকৃত।

চীনে সরকার একসময় এসে দেখল, জন্মহার কমে যাওয়ায় দেশে বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। তরুণ নাগরিকের সংখ্যা কমে গেছে। সরকার ২০১৫ আইন সংশোধন করে ঘোষণা দেওয়া হয়, সব দম্পতি চাইলে দুটি সন্তান নিতে পারবেন। ২০২১ সালে তিনটি সন্তানের অনুমতি দিয়ে আইন শিথিল করা হয়। কিন্তু এরপরও দেখা যাচ্ছে জন্মহার বাড়ছে না। বিশেষ করে শহুরে মধ্যবিত্তদের মধ্যে একাধিক সন্তান নেওয়ার আগ্রহ একেবারেই দেখা যাচ্ছে না।

ভারত ও চীন উভয় দেশেই গর্ভাবস্থায় ভ্রূণ সন্তানের লিঙ্গ শনাক্ত করা এবং বিশেষ করে কন্যাশিশুর ভ্রূণ ধরা পড়লেই গর্ভপাতের মাধ্যমে তা নষ্ট করে ফেলার প্রবণতা বেড়ে যায়। এটি জোরপূর্বক বিবাহ এবং মানব পাচারসহ নানা ধরনের সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করছে।

চীন এখন দেখতে পাচ্ছে, তারা তাদের এক সন্তান নীতি থেকে একেবারে উল্টো পথে হাঁটার পরও জনসংখ্যাগত পরিবর্তনকে আদি অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারছে না। শহুরে মধ্যবিত্ত দম্পতিরা ক্রমবর্ধমান আর্থিক চাপের মুখে পড়ে একাধিক সন্তান নেওয়ার বিষয়ে আগ্রহী হচ্ছে না। সরকার যদিও ‘অভিজাত’ শহুরে নারীদের সন্তান জন্ম দিতে উৎসাহিত করছে এবং নানা রকমের সুবিধা দিচ্ছে, কিন্তু গ্রামীণ ও সংখ্যালঘু নারীদের এখনো বেশি সন্তান নিতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।

চীনের মতো ভারতের কিছু রাজ্যে নারীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার এবং তঁাদের সন্তানদের নিয়ে ক্রমবর্ধমান উচ্চাকাঙ্ক্ষা জন্মহার কমাতে ভূমিকা রাখছে। চীনের মতো এই রাজ্যগুলো এখন বয়স্ক জনসংখ্যাধিক্যের মুখোমুখি হয়েছে। যেসব রাজ্যে অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় মুসলমানদের সংখ্যা বেশি, সেসব রাজ্যেও জন্মহার হ্রাস পেয়েছে, যদিও তার গতি বেশ ধীর।

জন্মহার কম হওয়া সত্ত্বেও কিছু রাজনীতিবিদ অধিকসংখ্যক মুসলিম জনসংখ্যা থাকা উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে চীনের সাবেক এক সন্তান নীতির মতো কিছু একটা চালু করার পক্ষে কথা বলেছেন। আদতে তাঁদের এই আহ্বানের সঙ্গে ভারতের জনসংখ্যাগত বাস্তবতার সম্পর্ক খুবই কম। মূলত মুসলমান ও দলিত শ্রেণির মানুষের জন্মহার নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের রাজনৈতিক চিন্তাপ্রসূত উদ্বেগের সঙ্গেই এই আহ্বানের সম্পর্ক বেশি।

আরও পড়ুন

চিন্তার বিষয় হলো এ ধরনের নীতি চালু হলে নারী ও সংখ্যালঘুদের ওপর অন্যায্য প্রভাব পড়তে পারে। ভারতের মুসলিম জনসংখ্যাবহুল চারটি রাজ্য ইতিমধ্যেই ‘দুই সন্তান নীতি’ আইন পাস করেছে।

এর বাইরে যেসব দম্পতি একটি সন্তান নেবেন, তঁাদের জন্য সরকারের দিক থেকে বিশেষ প্রণোদনার ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালে একজন সিনিয়র মন্ত্রী জাতীয়ভাবে ‘এক সন্তান’ নীতি গ্রহণের প্রস্তাব করেছিলেন। অতীতের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নীতির মতোই মুসলিম এবং নিম্নবর্ণের পরিবারগুলোকে নিশানা করে একটি বৃহত্তর হিন্দু জাতীয়তাবাদী অ্যাজেন্ডাকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তারা এগোতে চাচ্ছে।

চীনের এক সন্তান নীতির চূড়ান্ত প্রভাবের সময় যেমনটা ঘটেছিল, ঠিক তেমনিভাবে ভারতের জাতীয় স্তরে এই জাতীয় আইন পাস হলে বহু ভারতীয় সরকারি চাকরি ও অনেক নাগরিক সুবিধা হারাতে পারেন। যেমন কিছু রাজ্য এবং পৌরসভা ইতিমধ্যেই আইন করেছে, দুটির বেশি সন্তান আছে, এমন লোক সরকারি চাকরি পাওয়ার এবং রাজনৈতিক দায়িত্ব পাওয়ার অযোগ্য হবেন।

কূটাভাস হলো এই, ভারতের জন্মহার এবং পরিবারের আকার সংকুচিত হচ্ছে নারীদের নিজস্ব প্রজনন পছন্দের কারণে। এখানে অনেক নারী দুটি সন্তান হওয়ার পরে (বা একটি ছেলে হওয়ার পরে) অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে গর্ভনিরোধ করছেন। ডাক্তার এবং নারীদের, অর্থাৎ গ্রামীণ দরিদ্র নারীদের আর্থিক প্রলোভন দেখিয়ে স্থায়ী জন্মনিরোধক অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে।

 অন্য কথায়, ভারত অনেক আগে থেকেই ছোট পরিবারের দিকে ঝুঁকেছে। ২০২২ সালের জাতিসংঘের রিপোর্টে বলা হয়েছে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সেখানে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো কঠোর হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

অপরাজিতা সরকার সিডনির নিউ সাউথ ওয়েলস ইউনিভার্সিটির পোস্টডক্টরাল ফেলো

জোয়েল উইং-লুন নিউ সাউথ ওয়েলস ইউনিভার্সিটির হিস্ট্রি অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ বিষয়ের প্রভাষক