ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে ইউক্রেনীয় ও রুশ বাহিনীর মধ্যে তীব্র লড়াই চলছে
ছবি: রয়টার্স

ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনীয়দের হতাহত হওয়ার বিষয়ে একটি বিবৃতি দিয়ে পরে তা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। বিবৃতিতে তিনি লিখেছেন, এই যুদ্ধে এ পর্যন্ত ১ লাখ ইউক্রেনীয় সেনা ও ২০ হাজার বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। সামরিক-বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার এ তথ্য যে কাউকে ভারাক্রান্ত করে তুলবে।

যুক্তরাষ্ট্রের একজন শীর্ষ জেনারেল মার্ক মিলের বক্তব্যেও প্রায় একই ধরনের তথ্য মিলেছে। সম্প্রতি নিউইয়র্ক ইকোনমিক ক্লাবে অতিথি বক্তার বক্তব্যে তিনি বলেছেন, যুদ্ধে রাশিয়ার এক লাখের বেশি সেনা হতাহত হয়েছেন। ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর হতাহতের সংখ্যাও সম্ভবত একই।

ইউক্রেন সেনাবাহিনীর বিপুল এই ক্ষয়ক্ষতি পরিষ্কার একটি সংকেত দিচ্ছে। তা হলো মস্কোর সঙ্গে ওয়াশিংটনের কার্যত এই যুদ্ধ সংকটে পড়েছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে এখন যুদ্ধের গতিমুখ বদলাতে হবে। তা না হলে তাঁকে জাতীয় নিরাপত্তা সংকটে পড়তে হবে, যা তাঁর প্রেসিডেন্সির অবসান ঘটাতে পারে।

এ যুদ্ধে ইউক্রেন জিতে যাচ্ছে—এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে। কিন্তু বাস্তব সত্যটা ভিন্ন, কেননা ইউক্রেন সেনাবাহিনীর যে সৈন্য ক্ষয় হচ্ছে, তা পূরণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রত্যক্ষ যুদ্ধে ইউক্রেনের প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, রাশিয়া পদ্ধতিগতভাবে দেশটির অবকাঠামো ধ্বংস করছে এবং লাখ লাখ ইউক্রেনীয় দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন। এ প্রেক্ষাপটে আগামীকালও যদি যুদ্ধ থেমে যায়, তবু ইউক্রেনের পক্ষে বিপুল এই শূন্যতা পূরণ করা সম্ভব হবে না।

এর বিপরীতে রাশিয়ার জনবলসংকট থাকলেও সেটা ততটা প্রকট রূপ ধারণ করবে না। বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে নিয়োগের মতো অজনপ্রিয় কর্মসূচি দিয়ে হলেও মস্কো যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের সৈন্যের ঘাটতি পূরণ করবে। রাশিয়ার প্রক্সি সেনাদল ওয়াগনার গ্রুপও গত এপ্রিল মাস থেকে তাদের সৈন্য নিয়োগ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাড়িয়েছে। ৮ হাজার থেকে এই গ্রুপের সৈন্যসংখ্যা এখন ৪০ হাজার। রাশিয়ার কারাবন্দীদের মধ্য থেকে এবং মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার অনেক দেশ থেকে ওয়াগনার গ্রুপ তাদের সৈন্য নিয়োগ দিচ্ছে।

ইউক্রেনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, এ যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ওয়াগনার গ্রুপের সেনা হতাহতের সংখ্যা ৮০০ থেকে ১ হাজারের মধ্যে। যদিও অন্যরা বলছে, এ সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার। সবচেয়ে হকচকিত যে তথ্য নিয়ে সম্প্রতি বেশ আলোচনা হচ্ছে, তা হলো পোল্যান্ড কর্তৃপক্ষ বলেছে, ইউক্রেনে তাদের ১ হাজার ২০০ স্বেচ্ছাসেবী নিহত হয়েছেন। নিহত এসব স্বেচ্ছাসেবী পোল্যান্ডের স্থলবাহিনীর সদস্য। পোল্যান্ডের সেনাবাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ৬১ হাজার ২০০। ইউক্রেনে তাদের এত বেশি সেনা নিহত হওয়ায় পোল্যান্ড নতুন করে সেখানে সেনা পাঠানোর ঝুঁকি নেবে বলে মনে হয়নি। এ ছাড়া রাশিয়া প্রতিশোধ নিতে পারে, সেই ভয়ও তাদের রয়েছে।

সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, ইউক্রেনের স্থলবাহিনীর সেনাসংখ্যা এখন ১ লাখ ৯৮ হাজার। যেভাবে তাদের সৈন্য ক্ষয় হচ্ছে, তাতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি প্রকৃত সংকটের মুখোমুখি হয়েছেন। রাশিয়া এখন বেছে বেছে ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ও সেনাবাহিনীর কমান্ড পোস্ট ধ্বংস করছে। এ ছাড়া ইউক্রেনীয় বাহিনীর হাতে থাকা অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র, বিশেষ করে হিমার্স রকেট–ব্যবস্থা, আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও গোলাবারুদের ভান্ডার ধ্বংস করতে হামলা করছে।
যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনের এত ক্ষয়ক্ষতির কারণ হলো রাশিয়া এখন ড্রোন হামলা পরিচালনা করছে। এ ছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ বাহিনীর কমান্ড, নিয়ন্ত্রণ ও নেতৃত্বের উন্নয়ন হয়েছে। খেরসন থেকে রাশিয়া কৌশলগত কারণেই তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে। রুশ বাহিনী নিজেদের সেনাশক্তি অক্ষত রাখতে এবং আরও ভালো প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্যই এটা করেছে।

এখন সবচেয়ে তীব্র যুদ্ধ হচ্ছে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় বাখতমুট অঞ্চলকে কেন্দ্র করে। ধীরে হলেও রাশিয়ান ও স্থানীয় সেনাদের ধারাবাহিক অগ্রগতি ঘটছে। সেখানকার যুদ্ধ ইউক্রেনের যে পরিমাণ সেনা ও গোলাবারুদ খোয়া যাচ্ছে, তা দ্রুত প্রতিস্থাপন করা যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন

ইউক্রেন যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে ইউরোপকে শুষে খাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

এরই মধ্যে ইউরোপীয়রা নিশ্চিত করেছে, তাদের সম্পদ যে হারে নিঃশেষ হচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে ইউক্রেনকে সহায়তা অব্যাহত রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব না–ও হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ভান্ডারের উচ্চ প্রযুক্তির রকেট প্রতিরক্ষাব্যবস্থা হিমার্স, ট্যাংক–বিধ্বংসী অস্ত্র জাভেলিনের মতো সমরাস্ত্রেরও টান পড়তে শুরু করেছে। ১৫৫ এমএম গোলার মতো প্রথাগত গোলাবারুদের ঘাটতিও দেখা দিয়েছে ওয়াশিংটনের। ভান্ডার থেকে গুরুত্বপূর্ণ রসদ টান পড়ায় ওয়াশিংটন এখন তাইওয়ানকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করতে পারছে না।

২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকানরা সামান্য ব্যবধানে হলেও নিয়ন্ত্রণ পেয়েছে। সে কারণে, এখন দেশটির আইনসভায় প্রশ্ন উঠতে পারে, ইউক্রেনের জন্য কেন যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন নিজেদের জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলবে? বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কেন ইউক্রেনকে দেওয়া হচ্ছে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই প্রয়োজনীয় অস্ত্র নেই?

মোদ্দাকথা হচ্ছে, যুদ্ধে ইউক্রেনের সেনারা যেভাবে হতাহত হচ্ছেন এবং যেভাবে তাদের অবকাঠামো ধ্বংস হচ্ছে, তাতে খুব বেশি দিন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য জেলেনস্কির থাকার কথা নয়। ইউক্রেন সরকার যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির তথ্য সেন্সর করা সত্ত্বেও তাদের যে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, সেটা স্পষ্ট।

ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা যত ধ্বংস হতে থাকবে, দেশটি থেকে অন্য দেশে অভিবাসী হওয়া মানুষের সংখ্যা ততই বাড়তে থাকবে। কেননা, মানুষের আশ্রয় ও শীত নিবারণের উপকরণ দরকার। তরুণ জনগোষ্ঠী তাদের সম্ভাব্য পরিণতি এড়াতেও চায়।
নতুন সেনা নিয়োগ, প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র ও গোলাবারুদের ঘাটতির কারণে রাশিয়াও বড় ধরনের সংকটে পড়েছে। কিন্তু একটা বিষয় হলো, সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের আগে থেকেই রাশিয়ার হাতে বিপুলসংখ্যক যুদ্ধসরঞ্জামের মজুত রয়েছে। সেগুলো থেকেই তারা এখন ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র ও গোলাবারুদের জোগান দিচ্ছে।

অবস্থাদৃষ্টে এই যুদ্ধে অন্তত এখনকার মতো লাভবান হচ্ছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ‘ভালো একটা লড়াই করছেন’—সেটা দেখানোর মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে একজন শক্তিশালী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারছেন। যদিও তাঁর এই যুদ্ধের প্রক্সি যোদ্ধা ইউক্রেনীয়রা। কিন্তু জ্বালানিসংকট ও গুরুতর অর্থনৈতিক সমস্যা সঙ্গে করে ইউরোপে শীত নামতে শুরু করেছে। ফলে একদিন উজ্জ্বল ভোরে সবকিছুর সমাধান হবে—বাইডেনের এমন স্বপ্ন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে

  • স্টিফেন ব্রায়েন জ্যেষ্ঠ ফেলো, সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি অ্যান্ড ইয়র্ক টাউন ইনস্টিটিউট