পরিবেশ নিয়ে ভাবনা কি গরিবের ঘোড়ারোগ

ওমর খৈয়ামের সেই বিখ্যাত কবিতা আমরা সবাই জানি, ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও/ বাকির খাতায় শূন্য থাক।/ দূরের বাদ্য কাজ কী শুনে/ মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক।’

পরিবেশ প্রসঙ্গে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশের মানুষেরা এ কথা বেশ ভালোভাবেই মানে বা মানতে বাধ্য হয়। তারা যতটা সম্ভব নগদ উন্নয়নের পেছনে পড়িমরি করে দৌড়ায়, কারও থেকে পিছিয়ে পড়তে চায় না, কারণ পিছিয়ে পড়লেই তো হারিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। উন্নয়নের পেছনে অন্ধের মতো ছুটতে গিয়ে পরিবেশ বা জলবায়ুর যে কোথায় কী বিপর্যয় হলো, সেটা দেখার আর কোনো অবসর বা সুযোগ থাকে না বললেই চলে; ‘দূরের বাদ্য’ শোনার ইচ্ছাটাও হারিয়ে যায়। মনে ভয় জাগে, ভবিষ্যতের পরিবেশ নিয়ে বিলাসিতা করলে আর বর্তমানের উন্নয়ন হবে না।

ওমর খৈয়ামের সেই উপদেশকে শিরোধার্য করে নগদ উন্নয়নকে হাত পেতে নিতে গিয়ে বাকির খাতায় কেবল শূন্যই বসাতে হয়, ওখানে পরিবেশ বা জলবায়ুর বিষয়টা স্থান পায় না বললেই চলে।

গরিব দেশগুলো এখন যে বিদেশি সাহায্য পায়, তার সঙ্গে পরিবেশ রক্ষার শর্তও জুড়ে দেওয়া থাকে। তারা যেখানে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ন্যূনতম ব্যয় নির্বাহ করতেই হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে গ্যাসচালিত বৈদ্যুতিক গ্রিডের সম্প্রসারণ করা তাদের সাধ্যাতীত। এ ব্যাপারে যে ধনী দেশগুলো তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসছে, তা–ও নয়। এ কারণেই এখন আফ্রিকান দেশগুলোকে যখন তাদের জনগণের ন্যূনতম চাহিদা না মিটিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর উপদেশ বা পরামর্শ দেওয়া হয়, তখন তাদের কাছে সেসব উপদেশ বা পরামর্শকে নিতান্তই হাস্যকর মনে হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
আরও পড়ুন

উন্নত বিশ্বের কথা অবশ্য আলাদা। তারা একদিকে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাচ্ছে, অন্যদিকে উন্নতিও করছে। সেখানে যেহেতু ইতিমধ্যে যথেষ্ট উন্নতি হয়ে গেছে, সেহেতু পরিবেশ সামলাতে গিয়ে বর্তমান উন্নতির হার কম হলেও তারা অনেকেই এ ধারাকে অব্যাহত রাখতে চাইছে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলো যেহেতু নানা সমস্যায় জর্জরিত, তাদের জন্য ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূর করা এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করা আশু করণীয় হয়ে উঠেছে।

এখানে কূটাভাসটা হচ্ছে, তারা তাদের জনগণের এসব মৌলিক চাহিদা যত দ্রুত দূর করার চেষ্টা করে, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা ততই বাড়তে থাকে। ১৯৯০ সাল থেকে ৭২টি উন্নয়নশীল দেশের তথ্য–উপাত্ত নিয়ে আইএমএফ এক গবেষণা করে দেখেছে, গড়ে বার্ষিক জিডিপি ১ শতাংশ বাড়লে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ গ্যাস নিঃসরণ হয়।

২০৩০ সালের মধ্যে ভারত ও ইন্দোনেশিয়া বাড়তি ৮০০ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই–অক্সাইড উৎপন্ন করবে, যা গোটা জার্মানি এক বছরে যে পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে তার সমান। এই নিঃসরণের মাত্রা অন্যান্য দ্রুত বর্ধনশীল দেশ, যেমন ব্রাজিল, মিসর ও ফিলিপাইনেও একইভাবে বাড়ছে।

আরও পড়ুন

উন্নত বিশ্বের অনেক নেতা অবশ্য বলছেন, তাঁরা একটা তহবিল গঠন করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়নে যেমন সাহায্য করবেন, তেমনি কার্বন নিঃসরণও কমিয়ে আনবেন। গত ২৩ জুন প্যারিসে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে এসব নেতা কথা দিয়েছেন, তাঁরা বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলারের একটি ‘পরিবেশ অর্থায়ন’ ফান্ড গঠন করবেন।

যদিও হিসাব করে দেখা গেছে, যে উদ্দেশ্যে তাঁরা এই তহবিল গঠন করছেন, সেই উদ্দেশ্য পূরণ করতে হলে কমপক্ষে বার্ষিক ২ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলার লাগবে এবং এর ভেতর অন্তত ১ ট্রিলিয়ন ডলার সাহায্য হিসেবে আসতে হবে তাঁদের কাছ থেকেই। এই ১ ট্রিলিয়ন ডলার ও ১০০ বিলিয়ন ডলারের ভেতরকার ফারাক লক্ষ করলেই পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে আমাদের সব কষ্টকল্পিত আশা মুহূর্তেই বুদ্‌বুদের মতো মিলিয়ে যায়।

আরও পড়ুন

গরিব দেশগুলো এখন যে বিদেশি সাহায্য পায়, তার সঙ্গে পরিবেশ রক্ষার শর্তও জুড়ে দেওয়া থাকে। তারা যেখানে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ন্যূনতম ব্যয় নির্বাহ করতেই হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে গ্যাসচালিত বৈদ্যুতিক গ্রিডের সম্প্রসারণ করা তাদের সাধ্যাতীত। এ ব্যাপারে যে ধনী দেশগুলো তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসছে, তা–ও নয়। এ কারণেই এখন আফ্রিকান দেশগুলোকে যখন তাদের জনগণের ন্যূনতম চাহিদা না মিটিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর উপদেশ বা পরামর্শ দেওয়া হয়, তখন তাদের কাছে সেসব উপদেশ বা পরামর্শকে নিতান্তই হাস্যকর মনে হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তাদের বরং এতে ক্রুদ্ধ হওয়ার কথা, কারণ ওই পরামর্শদানকারী উন্নত দেশগুলোর নিজেদের কার্বন নিঃসরণ এখনো উল্লেখযোগ্য হারে ক্ষতিকর।

যাহোক, মানুষ এখন দুই দলে বিভক্ত। এক দল চাইছে এত দিন ধরে উন্নত দেশগুলো যেভাবে উন্নত হয়েছে, সেই একই উন্নয়নের পথে হাঁটতে; আরেক দল বলছে যে না, এখন আর আগের মতো উন্নয়ন করলে চলবে না, এখন পরিবেশের দিকে খেয়াল রাখতে হবে, তাতে মানুষের যদি ক্ষুধা বা দারিদ্র্য বাড়ে, তা–ও সই। কোনটা বেশি খারাপ—দরিদ্রতর বর্তমান, নাকি উষ্ণতর ভবিষ্যৎ—সে বিষয়ে এ দুই পক্ষ একমত হতে পারছে না।

আরও পড়ুন

এখানে মজার ব্যাপার হচ্ছে, ধনী দেশগুলো যে আমাদের কার্বন নিঃসরণ কমাতে বলছে, সেটা কিন্তু বর্তমান বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী নয়। বর্তমান বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য যে কার্বন মূলত দায়ী, সেটা অনেক আগে থেকেই বায়ুমণ্ডলে জমা হয়ে আছে এবং সেগুলো উদ্‌গিরণ করেছে ওই ‘পরিবেশসচেতন’ উন্নত দেশগুলো। পরিবেশদূষণের ক্ষেত্রে একজন উন্নত দেশের নাগরিক একজন অনুন্নত দেশের নাগরিকের চেয়ে বহুগুণ বেশি দায়ী। তার চেয়েও বড় কথা, এই পরিবেশদূষণে যারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, সেই অনুন্নত দেশের নাগরিকদের তো এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সামর্থ্যই নেই।

ওমর খৈয়ামের উপদেশ মেনে পরিবেশ বিসর্জন দিয়ে হলেও গরিব দেশগুলো এখন বাধ্য হয়ে নগদ উন্নয়নকে হাত পেতে নেবে। এমনকি সামর্থ্য নেই বলে তাদের বাকির খাতায়ও শূন্য থেকে যাবে। এ ক্ষেত্রে বলটা এখন উন্নত দেশগুলোর কোর্টে। এই ধরিত্রীকে বাসযোগ্য রাখতে চাইলে উন্নত বিশ্বকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর পাশে এসে শক্তভাবে দাঁড়াতেই হবে।

● সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক পিএসসির সদস্য এবং মাউশি ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক

আরও পড়ুন