ফিলিস্তিনি শিশুদের প্রাণ কি এতই তুচ্ছ

ফিলিস্তিনি মায়েদের নিয়ে আঁকা আলোচিত কার্টুন।
টুইটার থেকে সংগৃহীত

আজকের দিনটি আগামী দিনের থেকে হয়তো ভালো,

কেবল মৃত্যুগুলোই আজ নতুন

প্রতিদিনই জন্ম নেয় যে নতুন শিশুরা

তারা ঘুমোতে যাওয়ার আগেই ঘুমিয়ে পড়ে, মৃত্যুতে ।

তাদের গণনা করা মূল্যহীন।

—ফিলিস্তিনি জাতিসত্তার কবি মাহমুদ দারবিশ

গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে বিশেষ করে টুইটারে একটি কার্টুন অনেকেরই নজর কেড়েছে। কার্টুনটিতে দেখা যাচ্ছে, একজন ফিলিস্তিনি নারীকে দুইভাবে আঁকা হয়েছে। এক পাশে দেখা যাচ্ছে, তিনি অন্তঃসত্ত্বা। আরেক পাশে সেই মা বহন করছেন শিশুসন্তানের মরদেহ। শিশুটি রক্তাক্ত, তার দেহে জড়ানো ফিলিস্তিনি ঐতিহ্যবাহী রুমাল ও লাল-সবুজ পতাকা। আর মায়ের চোখের জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।

আলা আল লাগতা নামে এক কার্টুনিস্ট এ কার্টুনটি এঁকেছেন। তিনি আরবিতে একটি ক্যাপশনও দিয়েছেন। সেটির ইংরেজি করা হয়েছে এভাবে: ইন প্যালেস্টাইন, দ্য মাদার ক্যারিজ হার সন টুয়াইজ! এর মানে দাঁড়ায়, একজন ফিলিস্তিনি মা তার ছেলেকে দুইবার বহন করেন—একবার গর্ভধারণের সময়, আরেকবার মৃত্যুর সময়।

কোনো মা-বাবার জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ, সন্তানের মরদেহ বহন করা। আর সেই কঠিন কাজটিই করতে হয় ফিলিস্তিনিদের। কারণ, ইসরায়েলিদের হামলার লক্ষ্যবস্তুই থাকে ফিলিস্তিনি ছেলেশিশু, কিশোর ও তরুণেরা। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড গাজায় ইসরায়েলের সর্বশেষ হামলাতেও তেমনটি আমরা দেখি। তাদের ভাষায়, সেটি অভিযান। এর একটি চটকদারি নামও দিয়েছে—‘ট্রুথফুল ডোন’ (সত্য ভোর)।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, গত শুক্রবার থেকে গাজা উপত্যকায় বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েল। অথচ গাজা থেকে ইসরায়েলের দিকে কোনো রকেট ছোড়া হয়নি, অন্যান্য সময় যে যুক্তি দিয়ে হামলা চালানো হয়। গাজার সশস্ত্র গোষ্ঠী ইসলামিক জিহাদের হামলার আশঙ্কা থেকে বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েল। এরপর পাল্টা জবাব দেয় ইসলামিক জিহাদ।

তিন দিন ধরে পাল্টাপাল্টি হামলার পর মিসরের মধ্যস্থতায় অস্ত্রবিরতিতে যায় দুই পক্ষ। এবারের ঘটনায়ও বরাবরের মতো ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের শিকার হয়েছে ফিলিস্তিনিরাই। ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৪৪ ফিলিস্তিনি, এর মধ্যে শিশু ১৫টি। ফেসবুক ও টুইটারে রক্তাক্ত ফিলিস্তিনি শিশুদের ছবি ছড়িয়ে পড়েছে। যার প্রেক্ষিতেই ফিলিস্তিনি মায়েদের নিয়ে বেদনাদায়ক কার্টুনটি আমরা দেখতে পাই।

এবারের ইসরায়েলি হামলায়ও পশ্চিমা মোড়লদের একই সুর আমরা পাই। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের ভাষ্য ছিল এমন, ইসরায়েলের নিজেকে রক্ষার অধিকার রয়েছে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে একই বাক্যই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে থাকেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাসও ইসরায়েলের সমর্থনে বিবৃতি দিয়েছেন। এর মাধ্যমে মূলত ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের হামলার ন্যায্যতাই দেওয়া হয়।

অন্যান্যবার হামাস যুক্ত থাকলেও, এবার তাদের দেখা যায়নি। হামাস যুক্ত হলে যুদ্ধপরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত হতো। ইসরায়েলও সম্ভবত তেমনটি চাইছিল। কিন্তু গাজার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে চাপে আছে হামাস, যেহেতু সেখানকার সরকার তারা। ফলে ইসরায়েলের আশা পূর্ণ হলো না বলা চলে!

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গত বছর রমজানের শেষ দিকে ইসরায়েল সবচেয়ে বড় হামলা চালায় গাজায়। সেবার হামাস, ইসলামিক জিহাদসহ সাধারণ ফিলিস্তিনি সবাই পাল্টা জবাবে জড়িয়ে পড়ে। ইসরায়েলের হামলায় গাজা শহর রীতিমতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। টানা এগারো দিনের হামলায় আড়াই শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের ছোড়া রকেটে ইসরায়েলি মারা যান বারো জন। নিহত ফিলিস্তিনিদের মধ্যে শিশুই ছিল ৬৬টি। ইসরায়েলি হামলায় একসঙ্গে এত ফিলিস্তিনি শিশুর মৃত্যু স্মরণকালে আর ঘটেনি।

বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর দাবি করেছিল, ইসরায়েল যুদ্ধাপরাধ করেছে। এর তদন্ত হওয়া উচিত। কিন্তু এ বিশ্বে ইসরায়েলের বিচার কে করবে!

সেবার ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে গাজাবাসীর প্রতি সংহতি জানিয়েছিল বিশ্বের অনেক মানুষ। মুসলিম দেশগুলো ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, ফ্রান্সের মতো দেশের শহরে শহরে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। এমনকি ইসরায়েলি দূতাবাসের সামনেও জমায়েত হয়। এবারের হামলায় তেমন কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখা যায়। গতবারের তুলনায় এবারের হামলা তীব্র না হলেও বা দীর্ঘায়িত না হলেও তুলনামূলকভাবে বিশ্ববাসীর তেমন প্রতিবাদ দেখা যায়নি।

যুগ যুগ ধরে ফিলিস্তিনিদের জমিতে অবৈধ দখলদার ইসরায়েল। একটু একটু করে ফিলিস্তিনের প্রায় গোটা মানচিত্রই গিলে ফেলছে দেশটি। একটি সার্বভৌম ভূখণ্ডের ওপর এমন দখলদারি ও আগ্রাসন বিশ্ববাসী শুরু থেকেই মেনে নেয়নি। ফলে ফিলিস্তিনের কোথাও ইসরায়েলি হামলার ঘটনায় বিশ্বের নানা জায়গা থেকে প্রতিবাদের আওয়াজ ওঠে।

এবারের চিত্র ভিন্ন হওয়ার প্রধান কারণ, বিশ্বের মনোযোগ এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দিকে। তাছাড়া করোনা মহামারি পরবর্তী এ যুদ্ধের ধাক্কায় বৈশ্বিক অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থা। দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতি ছড়িয়ে পড়েছে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। সাম্প্রতিক তীব্র দাবদাহ ও দাবানলের কারণে ইউরোপের পরিস্থিতিও ভয়াবহ।

এবারের ইসরায়েলি হামলায়ও পশ্চিমা মোড়লদের একই সুর আমরা পাই। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের ভাষ্য ছিল এমন, ইসরায়েলের নিজেকে রক্ষার অধিকার রয়েছে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে একই বাক্যই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে থাকেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাসও ইসরায়েলের সমর্থনে বিবৃতি দিয়েছেন। এর মাধ্যমে মূলত ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের হামলার ন্যায্যতাই দেওয়া হয়।

আরও লক্ষণীয় বিষয় ছিল, এবারের ঘটনায় আরব দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া বা প্রতিবাদও খুব একটি চোখে পড়েনি। আরব লীগ প্রতিক্রিয়া জানালেও সেটি তেমন জোরালো ছিল না। ফিলিস্তিনিদের প্রতি বরাবরই এমন আচরণ কি করে না আরব বিশ্ব? আরব দেশগুলো ইসরায়েলকে সরাসরি স্বীকৃতি দিতে শুরু করেছে—বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিকভাবে সম্পর্ক স্থাপন করার মাধ্যমে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচেষ্টায় সেটি শুরু হয়।

সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সফরকে কেন্দ্র করে সৌদি আরবের আকাশও উন্মুক্ত হয়ে গেল ইসরায়েলের জন্য। ফলে এমন পরিস্থিতিতে নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের পাশে আরব বিশ্বকে আশা করাই এখন ভুল।

ফিলিস্তিন ইস্যুতে পশ্চিমা মিডিয়ার একচোখা নীতি নতুন নয়। গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে একটি প্রাথমিক স্কুলে ১৯ জন শিশু নিহত হয়েছিল বন্দুকধারীর হামলায়। এমন ঘটনায় গোটা বিশ্বের মিডিয়াই মানবিক হয়ে ওঠে। এমন ঘটনায় আমরাও স্তব্ধ হয়ে যাই। সেটিই স্বাভাবিক। তবে ফিলিস্তিনি শিশুদের ক্ষেত্রে তেমন মানবিকতা আমরা পাই না পশ্চিমা মিডিয়াগুলোর কাছে।

ইউক্রেনেও রাশিয়ার হামলায় নিহত হচ্ছে শিশুরা। গত মাসের মাঝামাঝিতে রুশ হামলায় নিহত হয় লিজা নামে তিন বছর বয়সী এক ইউক্রেনীয় শিশু। পরির মতো ফুটফুটে শিশুটির মৃত্যুই প্রমাণ করে যুদ্ধের ভয়াবহতা। কিন্তু পশ্চিমা মিডিয়া যেভাবে ইউক্রেনের একটি শিশুর নামকে এককভাবে তুলে আনল, তেমনটি আমরা দেখি না ফিলিস্তিনি শিশুদের ক্ষেত্রে। ইসরায়েলি হামলায় ফিলিস্তিনের এত এত শিশু নিহত হয়, তাদের কারও নামটি জানা হয় না আমাদের।

বিষয়টি খুবই করুণভাবে ওঠে আসে ফিলিস্তিনি পলিসি নেটওয়ার্ক আল-শাবাকার সদস্য ইয়ারা হাওয়ারি কণ্ঠে। ৯ আগস্ট কাতারভিত্তিক আলজাজিরায় এক নিবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘আমরা জানি, আমরা ইউক্রেন না। আমরা জানি, আমরা ইউক্রেনীয়দের মতো একই ধরনের সমর্থন পাব না। দখলধারী শক্তিকে প্রতিরোধ করতে আমাদের যে অধিকার, সেটিকে রক্ষা করতে কেউ এগিয়ে আসবে না। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো আমাদের শহীদদের মহিমান্বিত করে কোনো ছবি প্রকাশ করবে না। পপ তারকা, হলিউড অভিনেতা এবং প্রধানমন্ত্রীরা গাজার ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আমাদের পরিবারগুলোকে দেখতে আসবে না।’

এমন সহজ-সরল বয়ানের মাধ্যমে পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে ইসরায়েলি দখলদারির নির্মম শিকার ফিলিস্তিনিদের প্রতি পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি। ফলে সামনের দিনগুলোতেও হয়তো আমরা ইসরায়েলি হামলায় ফিলিস্তিনি শিশুদের রক্তাক্ত হতে দেখব।

একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে তার শিশুদেরই আগে শিকার করতে হয়, সেটি কে না জানে। তবে তা হতে না দিতে ফিলিস্তিনি নারী বা মায়েরা কতটা বদ্ধ পরিকর সেটিও আমাদের জানা আছে। সন্তানের লাশ কাঁধে নেওয়া এসব মায়েরা একেকটি সাহসী ও নির্ভীক প্রজন্মই জন্ম দিয়ে যান, ইসরায়েলি দখলদারির বিরুদ্ধে লড়তে। মাহমুদ দারবিশও তাঁর কবিতায় বলে গেছেন—

‘আমাদের এই ভূমি বন্ধ্যা নয়

প্রতিটি ভূমির রয়েছে একটি জন্মক্ষণ

প্রতিটি সকালেই রয়েছে বিপ্লবের জন্য প্রতিশ্রুতি।’

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সহসম্পাদক। ইমেইল: [email protected]