পরীক্ষা মানে নম্বর, ফল মানে জিপিএর বিকল্প কী

পরীক্ষা কী এবং কেন নেওয়া হয়, এটা অভিভাবকদের জানা নেই। জানা নেই বলে তাঁরা মনে করেন, বেশি বেশি পরীক্ষা নিলে আর কিছু না হোক, খানিক পড়াশোনা অন্তত হয়। শুধু অভিভাবকদের কথা বলছি কেন, শিক্ষকেরাও পরীক্ষা নেওয়ার কারণ সম্পর্কে অবগত নন। সে জন্য কোনো কোনো স্কুলে প্রায় সারা বছরই পরীক্ষা চলতে থাকে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের শিখন কার্যক্রম চলে পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে।

এসব পরীক্ষায় আবার নম্বরপ্রাপ্তির ব্যাপারটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। ফলে হরেদরে যেভাবেই হোক, বেশি নম্বর পাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা চেষ্টা চালায়। চেষ্টার অংশ হিসেবে অনেকে পরীক্ষার হলে নকল নিয়ে যায়, কেউ কেউ অন্যের খাতা দেখে উত্তর লেখার চেষ্টা করে। অভিভাবকেরা এদিক দিয়ে আরেক কাঠি সরেস। তাঁরা পারলে সন্তানের হাতে প্রশ্নপত্র তুলে দেন। কারণ, নম্বরটাই তো আসল! আর শিক্ষকেরা এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে টোপ দেন—তাঁদের কাছে প্রাইভেট পড়লে শতকরা এক শ ভাগ প্রশ্ন কমন পাওয়া যাবে। হায়!

শিক্ষাক্রমে পরীক্ষাকে বলা হয় মূল্যায়ন। প্রতিটি বিষয়ের জন্য মোটাদাগে কিছু যোগ্যতা নির্ধারণ করা আছে। শিক্ষার্থী সেসব যোগ্যতার কতটুকু অর্জন করল, তা পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করা হয়। পরীক্ষা যোগ্যতা যাচাইয়ের একটি প্রক্রিয়ামাত্র, শিখন কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য মোটেও পরীক্ষা নেওয়া নয়। শিখন কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য শিক্ষার্থীকে প্রতিটি বিষয়ের নির্ধারিত যোগ্যতাগুলো অর্জন করানো।

বর্তমানে স্কুলে যেসব পরীক্ষা হয়, তার ফলাফলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর শ্রেণি রোলও নির্ধারিত হয়। অথচ রোল বা ক্রম নির্ধারণ করা শিখনকালীন মূল্যায়ন কিংবা সামষ্টিক মূল্যায়নের উদ্দেশ্য হতে পারে না। এটি হওয়ার কারণে সবাই নম্বরের পেছনেই ছুটছে। শিখন-দুর্বলতা পূরণ করার ব্যাপারটি আড়ালেই থেকে যাচ্ছে

এ যোগ্যতা অর্জনের কাজে পাঠ্যবই মূল শিখন-উপকরণ হিসেবে কাজ করে। আর শ্রেণিকক্ষ হয় প্রধান জায়গা, যেখানে একসঙ্গে সব শিক্ষার্থীকে পাঠদান করা হয়। সারা বছর বিভিন্ন পাঠ ও কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীকে বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতা অর্জন করানো হয়। ধরা যাক, বাংলা বিষয়ে শিক্ষার্থীর জন্য নির্ধারিত একটি যোগ্যতা এমন, ‘শিক্ষার্থী কোনো গল্প পড়ে তার মূলভাব বুঝতে পারবে এবং নিজের জীবনের সঙ্গে গল্পের কাহিনি ও চরিত্রকে মেলাতে পারবে।’ শিক্ষক শ্রেণিতে পাঠ্যবই অনুসরণের মাধ্যমে এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে এই যোগ্যতা পূরণের চেষ্টা চালাবেন।

কোনো শ্রেণিতে সব শিক্ষার্থীর পাঠ গ্রহণের ক্ষমতা সমান থাকে না। এমনকি বিষয় অনুযায়ীও একজন শিক্ষার্থীর পাঠ গ্রহণ ক্ষমতার হেরফের হয়। অর্থাৎ কোনো একটি পাঠ, তা বাংলারই হোক আর অন্য বিষয়েরই হোক—সব শিক্ষার্থী একই সঙ্গে একই সময়ে বুঝবে না। একসঙ্গে বোঝার দরকারও নেই। শিক্ষাবছরের যেকোনো সময়ে পাঠটি বুঝতে পারলে বা আয়ত্তে আনতে পারলেই চলবে। একেকটি ছোট ছোট পাঠের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন যোগ্যতা অর্জন করানোর চেষ্টা করা হয়। আর পরীক্ষার মাধ্যমে দেখা হয়, শিক্ষার্থী যোগ্যতা অর্জনের পথে কোন অবস্থানে আছে।

এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীর শিখন-দুর্বলতা টের পাওয়া যায়। পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য নম্বর বা জিপিএ প্রদান নয়, বরং শিক্ষার্থীর শিখন-দুর্বলতা শনাক্ত করা। শিখন-দুর্বলতা শনাক্ত করা সম্ভব হলে তা পূরণের উদ্যোগ নেওয়াও সম্ভব। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় পরীক্ষা মানে নম্বর, ফল মানে জিপিএ। এই পরীক্ষা আর ফল দেখে শিক্ষার্থীর দুর্বলতার জায়গাগুলো মোটেও টের পাওয়া যায় না।

পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর শিখন-দুর্বলতা বের করার উপায় নিয়ে ফিনল্যান্ডসহ অনেক দেশ কাজ করছে। এসব দেশের শিক্ষাপদ্ধতি বেশ কয়েক বছর ধরে বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হচ্ছে। তাদের রেজাল্ট কার্ডে বা মূল্যায়নপত্রে নম্বর বা জিপিএ থাকে না। সেখানে লেখা থাকে, কোন বিষয়ে কোন কোন জায়গায় দুর্বলতা রয়েছে।

আরও পড়ুন

অন্যভাবে বলা যায়, কোন কোন যোগ্যতার কতটুকু তারা অর্জন করেছে এবং কোনগুলো এখনো যথাযথভাবে অর্জন করতে পারেনি। এগুলোর সমন্বয়ে নির্ধারণ করা হয় একজন শিক্ষার্থী পরবর্তী শ্রেণিতে উন্নীত হতে পারবে কি না। যদি কোনো শিক্ষার্থী শিখন-দুর্বলতা নিয়ে পরবর্তী শ্রেণিতে ওঠে, সেগুলো পূরণ করে নেওয়ারও সুপারিশ থাকে মূল্যায়নপত্রে।

বাস্তব পক্ষে শ্রেণিকাজ চলার সময়েই শিক্ষক বুঝতে পারেন, কোন শিক্ষার্থী কোন যোগ্যতা অর্জনে কতটুকু পিছিয়ে। তিনি দলে বা জোড়ায় কাজ দিয়ে কিংবা আলাদা যত্ন নিয়ে শিক্ষার্থীকে তার শিখন-দুর্বলতা পূরণে সহায়তা করতে পারেন। এখানে সংশ্লিষ্ট যোগ্যতাটি অর্জন করানোই মুখ্য, তা শিক্ষাবছরের যেকোনো সময়েই হোক না কেন। যোগ্যতা অর্জনের পুরো প্রক্রিয়াটি নিশ্চিত করার জন্য পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে একটি এক্সেলশিট। এর বিকল্প হিসেবে কোনো অ্যাপসও তৈরি করে নেওয়া যায়।

এক্সেলশিট বা অ্যাপসে পারদর্শিতার নির্দেশকগুলো চিহ্নিত করা থাকবে। যেমন ‘সাইকেল চালাতে পারা’ যদি একটি যোগ্যতা হয়, তবে একে কয়েকটি পারদর্শিতার নির্দেশক দিয়ে চিহ্নিত করা যেতে পারে: ক. কেউ ধরে থাকলে সাইকেলে প্যাডেল মারতে পারছে, খ. কারও সাহায্য ছাড়াই সাইকেল চালিয়ে কিছু দূর যেতে পারছে, গ. একা একা রাস্তার নিয়ম মেনে সাইকেল চালাতে পারছে। তিনটি ধাপকে ‘সাইকেল চালাতে পারা’ যোগ্যতার যথাক্রমে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও চূড়ান্ত স্তর বলে নির্দেশ করা যায়।

প্রথম অবস্থায় শিক্ষক পর্যবেক্ষণ করে শিক্ষার্থীকে ‘ক’ স্তরের উপযুক্ত মনে করতে পারেন। বছরের কোনো এক সময়ে একই শিক্ষার্থী ক্রমান্বয়ে ‘খ’ বা ‘গ’ স্তরের উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারে। অগ্রগতির এই স্তর এক্সেলশিটে বা অ্যাপসে তথ্য আকারে সংরক্ষিত থাকবে। এভাবে বছরব্যাপী শিখনকালীন মূল্যায়নের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীর যথাযথ অবস্থা বোঝা সহজ হবে।

শিখনকালীন মূল্যায়ন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যার জন্য আলাদা করে পরীক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন হবে না। শ্রেণিকাজের মধ্য দিয়েই শিক্ষক এই মূল্যায়নের কাজটি সারতে পারবেন। এভাবে মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর শিখন-দুর্বলতা দূর করার জন্যও ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। প্রচলিত পদ্ধতিতে বছর শেষে যে পরীক্ষা নেওয়া হয়, তার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর শিখন-দুর্বলতার জায়গাগুলো চিহ্নিত করা যায় না। এমনকি এসব দুর্বলতা পূরণ করার জন্য তখন পর্যাপ্ত সময়ও হাতে থাকে না।

এসব বিবেচনায় পিইসি, জেএসসিসহ কিছু পাবলিক পরীক্ষা উঠিয়ে দেওয়ার কথা বলে থাকেন বিজ্ঞজনেরা। আর তা বুঝে না-বুঝে অনেকে ‘গেল গেল’ রব তুলে পরীক্ষা নামের বিষফোড়া টিকিয়ে রাখতে ঢাল নিয়ে নামেন।

লক্ষ করে থাকবেন, বর্তমানে স্কুলে যেসব পরীক্ষা হয়, তার ফলাফলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর শ্রেণি রোলও নির্ধারিত হয়। অথচ রোল বা ক্রম নির্ধারণ করা শিখনকালীন মূল্যায়ন কিংবা সামষ্টিক মূল্যায়নের উদ্দেশ্য হতে পারে না। এটি হওয়ার কারণে সবাই নম্বরের পেছনেই ছুটছে। শিখন-দুর্বলতা পূরণ করার ব্যাপারটি আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।

  • তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক