বাশার আল–আসাদের উৎখাত এবং তাঁর মস্কো পলায়নের মধ্য দিয়ে সিরিয়ার প্রায় ৬০ বছরের বাথ–দলীয় শাসনব্যবস্থার অবসান হয়েছে।
সাদ্দাম হোসেনের আগ্রাসনের কালে সিরিয়া ইরানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। এর প্রতিদানে ২০১১–১৭ সাল পর্যন্ত সিরিয়া ও ইরাকে ইসলামিক স্টেট ও আল–কায়েদার আক্রমণ মোকাবিলায় বাশার আল–আসাদের সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছিল ইরান।
রাশিয়া, ইরান এবং প্রতিরোধের অক্ষ বলে পরিচিত ইরানপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীর সম্মিলিত জোট ইসলামপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে পরাজিত করেছিল এবং আরব দেশ দুটির সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছিল।
যা–ই হোক, আসাদ সরকারের সঙ্গে গণতন্ত্রের নামগন্ধও ছিল না। পশ্চিমা ও আরব নেতারা সিরিয়ায় ইরান ও রাশিয়ার ব্যাপক উপস্থিতিতে ভীত ও ক্ষুব্ধ ছিলেন। যেকোনো বিচারেই সিরিয়ার রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে বড় পরিবর্তন নিয়ে এসেছে।
স্বল্পমেয়াদি মূল্যায়নে ইরান, রাশিয়া, ইরাক এবং ইরানি প্রতিরোধের অক্ষ আসাদের পতনে প্রধান ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ। আসাদের পতন মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের ভূরাজনৈতিক প্রভাব দুর্বল করে দিয়েছে।
সড়কপথে হিজবুল্লাহর কাছে ইরানের অস্ত্র ও রসদ সরবরাহের একমাত্র রুট হচ্ছে সিরিয়া। ফলে এই সরবরাহপথ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় কেবল হিজবুল্লাহর জন্য কৌশলগত চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে না, ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইরান যে সুবিধা পায়, সেটাও দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।
সেই শত্রু যখন উৎখাত হয়েছে, এখন তাদের মধ্যকার পার্থক্যগুলো সামনে আসবে। ফলে নিজেদের পার্থক্যগুলো কীভাবে মিটিয়ে ফেলা হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকে যাচ্ছে।
সিরিয়ার আসাদ সরকারের পতন ইরাকের নিরাপত্তার ওপরও বড় হুমকি তৈরি করেছে। ইরাকের কুর্দি–অধ্যুষিত অঞ্চল এবং সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল—দুই অঞ্চলের ক্ষেত্রেই সেটা সত্য।
স্বল্প মেয়াদে ইসরায়েল হিজবুল্লাহ ও গোটা অঞ্চলের ইরানি অক্ষশক্তিকে আরও দুর্বল করার সুযোগ পেয়ে গেছে।
যা–ই হোক, প্রতিবেশী দেশে নতুন ইসলামি সশস্ত্র গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড, ফিলিস্তিনি ইস্যুতে সিরিয়ার ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য অবস্থান এবং গোলান মালভূমি নিয়ে বিরোধ—সব মিলিয়ে ইসরায়েলের ওপর দীর্ঘ মেয়াদে নিরাপত্তা–হুমকি তৈরি করবে।
আবার স্বল্প মেয়াদে আসাদের পতনে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা বিজয়ী হবে। কেননা, অঞ্চলটি থেকে রাশিয়া ও ইরানের প্রভাব ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিয়েছে।
সিরিয়ায় একটা সেক্যুলার সরকারের পতন এবং ইসলামপন্থীদের উত্থান দীর্ঘ মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে কী প্রভাব ফেলবে, সেটা এখনো অনিশ্চিত। কুর্দি ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং সিরিয়ার বিদ্রোহীরা ভবিষ্যতে কী করবেন, তা নিয়ে অস্পষ্টতা এবং গোটা অঞ্চলে আরও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির সম্ভাবনা—এসব কারণে সেটা বলা সম্ভব হচ্ছে না।
তুরস্ক এ ঘটনার মূল বিজয়ী। তুরস্ক এখন তাদের দেশের ওপর সিরীয় শরণার্থীদের নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে, সেটা সমাধানের আশা করতে পারে, কুর্দি অঞ্চলে আরও কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে, ফিলিস্তিনি ইস্যুতে আরও জোরালো ভূমিকা পালন করতে পারে এবং মধ্যপ্রাচ্যে সমমনাদের সঙ্গে আরও শক্তিশালী জোট গড়ে তুলতে পারে।
আরব দেশগুলো সিরিয়ায় ইরানের প্রভাব খর্ব হওয়ায় সন্তুষ্ট হলেও হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) ও অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর অভিযান সংগঠিত করেছে তুরস্ক। এসব গোষ্ঠী মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
মিসর, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডানসহ বেশ কিছু আরব দেশ মুসলিম ব্রাদারহুড ও দলটির মতাদর্শের বিরোধী। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্কের প্রভাব বিস্তার করতে চলেছে এবং সিরিয়ায় ব্রাদারহুড আধিপত্য বিস্তার করবে—এটা ধরে নিয়ে কয়েকটি আরব দেশ সিরিয়া নতুন হুমকি বলে মনে করতে পারে।
সিরিয়ার রাজনৈতিক ভব্যিষ্যৎ কেমন হবে, তা নিয়ে সম্ভাব্য দুটি চিত্র কল্পনা করা যেতে পারে। প্রথমটি হলো, নতুন একটি ব্যবস্থায় শান্তিপূর্ণ রূপান্তর। দ্বিতীয়টা হলো, লিবিয়া বা সুদান ঘরানার ফলাফল।
শান্তিপূর্ণ রূপান্তর কেবল তখনই সম্ভব, যদি আসাদকে উৎখাত করা সিরিয়ার বিদ্রোহীরা কথা ও কাজে মধ্যপন্থা নেয়। যা–ই হোক, তারা ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠী থেকে এসেছে। একটি সাধারণ শত্রুকে নির্মূল করতেই তারা একত্র হয়েছে।
সেই শত্রু যখন উৎখাত হয়েছে, এখন তাদের মধ্যকার পার্থক্যগুলো সামনে আসবে। ফলে নিজেদের পার্থক্যগুলো কীভাবে মিটিয়ে ফেলা হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকে যাচ্ছে।
বিরোধী পক্ষগুলো তাদের মধ্যকার বিরোধ যদি শূন্যে নামিয়ে আনতেও পারে, তারপরও কুর্দিদের সঙ্গে তাদের সংঘাত এবং তুরস্কের অবস্থান একটি ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এটা লিবিয়া ও সুদানের মতো সিরিয়াকে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সংকটে ফেলে দিতে পারে।
সৈয়দ হোসেন মুসাভিয়ান প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য নিরাপত্তা ও পারমাণবিক নীতি বিশেষজ্ঞ
মিডলইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত