নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা: নিন্দা জানিয়ে দায়িত্ব শেষ মানবাধিকার কমিশনের

বেদেপল্লিতে হামলা ও লুটপাটের পাঁচ দিন পরেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আসবাবপত্র। শুক্রবার দুপুরে কালকিনি পৌরসভার চরঠেঙ্গামারা বেদেপল্লিতেছবি: প্রথম আলো

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর হপ্তা ঘুরে গেছে, সহিংসতার খবরে ইতি পড়ার কোনো লক্ষণ নেই। বরং যতই দিন যাচ্ছে, সহিংসতা খবরাখবর ততই ডালপালা মেলছে। থানা অভিযোগ নিতে গড়িমসি করছে—এ অভিযোগ করছেন ক্ষতিগ্রস্ত বিচারপ্রার্থীরা।

বিবিসি বাংলা জানাচ্ছে, গত এক সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছোট–বড় মিলিয়ে শতাধিক সহিংস ঘটনায় এ পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যু এবং দুই শতাধিক মানুষ আহত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুর, বাড়িতে হামলা, লুটপাট, হুমকি দেওয়া, এমনকি ফসলের ক্ষতি করার মতো সহিংসতা হয়।

মাদারীপুর, কুষ্টিয়া, পিরোজপুর, নেত্রকোনা, সাতক্ষীরা, গাজীপুর, গাইবান্ধা, খুলনা, নাটোর, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকার ধামরাই, মুন্সিগঞ্জ, পটুয়াখালী এবং রাজশাহীর বিভিন্ন জায়গার হামলা–সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।

চলমান সহিংসতার সব ঘটনার মধ্যে মাদারীপুরের কালকিনিতে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বেদেপল্লির বসতঘরে হামলা ও লুটপাটের ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। অন্তত পত্রপত্রিকায় তেমনটিই জানিয়েছে।

১৩ জানুয়ারি (সাপ্তাহিক ছুটির দিন) কমিশনের উপপরিচালক স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়। দুষ্ট লোকেরা প্রশ্ন করতেই পারে, কেন শুধু কালকিনি? কোনো চাপ ছিল কি?

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, মাদারীপুরের কালকিনিতে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বেদেপল্লির অন্তত ২০টি বসতঘরে হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এ সময় নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন। ওই ঘটনায় রাজনৈতিক পক্ষগুলো একে অপরকে দোষারোপ করছে এবং পরস্পরকে দায়ী করে বক্তব্য দিচ্ছে।

ঘটনার নিন্দা জানিয়ে কমিশন বলে, ভোটাধিকার প্রত্যেকের অধিকার। এটি প্রয়োগের কারণে যদি বেদেপল্লির বাসিন্দারা হামলার শিকার হয়ে থাকেন, তবে তা অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে।

গত জুলাইয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধিরা মানবাধিকার কমিশনের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার আশঙ্কা আছে কি না?

আমরা জানি মানবাধিকার কমিশনে লোকবলের অভাবের কথা। কমিশনের সব চেয়ারম্যান এ বিষয়ে তাঁদের ‘আপত্তি’ জানিয়ে এসেছেন। ভবিষ্যতেও এই পরম্পরা জারি থাকবে। এরপরও কমিশনের উচিত হবে বিশেষ কতগুলো জায়গায় সরেজমিন পরিদর্শন এবং পাবলিক হিয়ারিং বা গণশুনানির ব্যবস্থা করা।

উত্তরে কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয়, এখন পর্যন্ত এই ইলেকশনগুলোয় ইমপ্রুভমেন্ট আছে। আর এ ছাড়া হরহামেশা আমাদের তো স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলো প্রায়ই হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন স্থানে; এমন কোনো বড় রক্তক্ষয় ছাড়াই ইলেকশনগুলো হচ্ছে। সে হিসাবে আমরা আশা করি, ইলেকশনের পরিবেশ এখনকার অবস্থায় ভালোই। কিন্তু তীব্র বাদানুবাদ অবশ্যই হয়, হবে; তাতে ভয় পাওয়ার মতো কোনো কারণ নেই।’

স্পষ্টত, কমিশন স্থানীয় নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের পার্থক্য ও গুরুত্বকে গুলিয়ে ফেলেছিল।

কমিশন গঠন–পুনর্গঠনের সময় কথা ছিল দেশের মানবাধিকার সংরক্ষণে ‘ওয়াচডগ’ হিসেবে কমিশন কাজ করবে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বর্তমান চেয়ারম্যান দায়িত্ব গ্রহণের পর দৈনিক সমকাল–এ দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিষয়টি আরও খোলাসা করেন।

তিনি বলেছিলেন, ‘(কমিশন) দেশে মানবাধিকার সংস্কৃতি গড়ে তুলবে। মানুষের অধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য কমিশনকে অনেক কাজ করতে হবে। সারা দেশে ওয়াচ করতে হবে, কোথায় মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। সেই কাজ করতে মানবাধিকার কমিশন গঠন করা হয়েছে। মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য সোচ্চার থাকতে হবে। মানবাধিকার কমিশন হচ্ছে জনগণের আশ্রয়স্থল। এখানে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বড় কথা নয়। কমিশনের প্রধান দায়িত্ব মানুষের পাশে থাকা। যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, সেখানে গিয়ে কমিশনকে বলতে হবে—এটা মানবাধিকারের লঙ্ঘন। তাদের প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে হবে। এটাই হচ্ছে কমিশনের মূল দায়িত্ব।’

আরও পড়ুন

একই সাক্ষাৎকারে বর্তমান চেয়ারম্যান নির্বাচনকে ঘিরে মানবাধিকার কমিশনের কর্মপরিধি স্পষ্ট করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘এমনকি যদি কোথাও সুষ্ঠু ভোট না হয়; ভোটের অধিকার হরণ হয়ে থাকে বা মানুষ যদি সঠিকভাবে ভোট দিতে না পারে; সেটাও কমিশন দেখে।’ বলেছিলেন, অন্য দুই কমিশনের (নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন) চেয়ে মানবাধিকার কমিশনের ব্যাপ্তি অনেক বেশি। মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার, তার কর্মের অধিকার এবং তার দৈনন্দিন জীবনযাপনের অধিকারে কেউ সমস্যা সৃষ্টি করছে কি না, তার অধিকার হরণ হচ্ছে কি না—এসব বিষয় মানবাধিকার কমিশনকে দেখার কথা।

বলা বাহুল্য, নির্বাচন–পরবর্তী সহিংসতা মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার হরণের পাশাপাশি তাদের কর্মের অধিকার এবং দৈনন্দিন জীবনযাপনের অধিকারে ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত করেছে।

আমরা জানি মানবাধিকার কমিশনে লোকবলের অভাবের কথা। কমিশনের সব চেয়ারম্যান এ বিষয়ে তাঁদের ‘আপত্তি’ জানিয়ে এসেছেন। ভবিষ্যতেও এই পরম্পরা জারি থাকবে। এরপরও কমিশনের উচিত হবে বিশেষ কতগুলো জায়গায় সরেজমিন পরিদর্শন এবং পাবলিক হিয়ারিং বা গণশুনানির ব্যবস্থা করা। বিশেষ করে যেখানে যেখানে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর (বেদেপল্লি, ধর্মীয় সংখ্যালঘু) ওপর হামলা হয়েছে, হচ্ছে; সেখানে সেখানে (মাদারীপুর, মুন্সিগঞ্জ, কুষ্টিয়া, নেত্রকোনা) সশরীর যাওয়া। একটু খুঁজে দেখা আসল কারণগুলো কী। দায়ী কারা। সহিংসতা বন্ধের উপায় কী। এসব নিয়ে একটা শ্বেতপত্র প্রকাশ কি খুবই কঠিন কাজ হবে?

● গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক

[email protected]