এমন মানুষ আছেন, যাঁরা মনে করেন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ভ্লাদিমির পুতিনের যুদ্ধের পেছনে ভয় বা সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা নয়, বরং অন্যান্য দেশের প্রতি অবজ্ঞাই প্রধান প্রেরণা। একসময় রাশিয়া ছিল বিশ্বের দুই পরাশক্তির একটি; কিন্তু সেই মর্যাদা সে হারিয়েছে। রাশিয়া জানে, অন্যান্য দেশের সম্মান সে আর পায় না (বারাক ওবামা একসময় রাশিয়াকে কেবল একটি ‘আঞ্চলিক শক্তি’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন)। ইউক্রেন যুদ্ধ সেই হারানো সম্মান পুনরুদ্ধারেরই একটি প্রচেষ্টা।
যা কিছুটা বিস্ময়কর, তা হলো ইউরোপের বিরুদ্ধে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থানও একই ধরনের প্রেরণায় চালিত। পুতিন জানেন, তাঁর আগ্রাসী প্রতিশোধপরায়ণতা এমন দেশগুলোর ভালোবাসা জিতবে না, যাদের সম্মান তিনি চান। কিন্তু ভালোবাসা না পেলে অন্তত তিনি ভয় জাগাতে চান। যে সামাজিক ব্যবস্থায় আপনাকে তুচ্ছ বলে গণ্য করা হয়, সেখানে ‘স্পয়লার’ হয়ে উঠতে আপনার যথেষ্ট প্রণোদনা থাকে।
একইভাবে ট্রাম্পও এমন এক সামাজিক ব্যবস্থা ভেঙে দিতে চান, যা তাঁকে ও তাঁর বিশ্বদৃষ্টিকে অবজ্ঞার চোখে দেখে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও তাঁর কর্মকর্তারা স্বৈরশাসক ও রাজাদের কাছ থেকে সম্মান পান (পুতিন ও সি চিন পিং); কিন্তু তাঁরা জানেন, বহু গণতান্ত্রিক দেশের নেতাই তাঁদের তাচ্ছিল্যের চোখে দেখেন।
বিদ্যমান সম্মানের শ্রেণিবিন্যাস ভেঙে এখন যুক্তরাষ্ট্র এমন এক বিশ্ব গড়তে চায়, যেখানে ট্রাম্প নিঃশর্ত আনুগত্য পাবেন। আইনের শাসন ও বহুপক্ষীয়তার ওপর জোর দেওয়া ইউরোপই হলো সেই অবশিষ্ট অংশের সবচেয়ে শক্তিশালী উদাহরণ—একটি সম্পূর্ণ মর্যাদা ও মূল্যবোধের ব্যবস্থা, যা ট্রাম্প প্রশাসন ধ্বংস করতে চায়।
ব্যঙ্গাত্মক বিষয় হলো, ট্রাম্প যে বিশ্ব ভাঙতে বেরিয়েছেন, সেটি গড়েছিল যুক্তরাষ্ট্রই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ওয়াশিংটন এক নতুন বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা গ্রহণ করে। রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট—উভয়েই বিশ্বাস করতেন, আমেরিকান মূল্যবোধের ওপর দাঁড়ানো একটি বিশ্ব আমেরিকার জন্যই ভালো হবে। তারা ঘোষণা করেছিল, গণতন্ত্র ও আইনের শাসনই হবে দেশগুলোকে মূল্যায়নের মানদণ্ড।
স্পষ্ট ভন্ডামি সত্ত্বেও (যুক্তরাষ্ট্র নিজেই প্রায়ই উদারতাবিরোধী ও অগণতান্ত্রিক আচরণ করেছে), এটিই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ‘সফট পাওয়ার’-এর ভিত্তি; সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে বিশ্বকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা। অন্য দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণযোগ্য আদর্শ হিসেবে দেখত।
পুরোনো ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সৃষ্টি ছিল আধুনিক ইউরোপ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতি পুনর্গঠনে সহায়তা করে, উদারপন্থী দলগুলোর সাফল্যকে উৎসাহ দেয় এবং প্রয়োজনে নীরবে সেই শক্তিগুলোকে দুর্বল করে, যাদের তারা খুব বেশি বাম বা ডান বলে মনে করত।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঐতিহাসিক শিকড় রয়েছে মার্শাল পরিকল্পনার মাধ্যমে বিতরণ করা মার্কিন সহায়তা সমন্বয়ের জন্য গড়ে তোলা এক ব্যবস্থায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি বেড়ে উঠে জাতিরাষ্ট্রগুলোর সহযোগিতা, আইনের গুরুত্ব ও উদার গণতন্ত্রের ভিত্তিতে ইউরোপের জন্য এক নতুন শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলে। পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত আধিপত্য ভেঙে পড়ার পর, গণতান্ত্রিক নীতিমালা আত্মস্থ করার শর্তে ইইউ দক্ষিণ ও পূর্বের দেশগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে সম্প্রসারিত হয়। বহু দিক থেকে, যুক্তরাষ্ট্র–সৃষ্ট উদার আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার মূল্যবোধকে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি করে ধারণ করেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
এখন ট্রাম্প প্রশাসন পুরোনো আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়ে ক্ষমতা ও জাতীয় স্বার্থের ওপর দাঁড়ানো এক নতুন ব্যবস্থায় তা প্রতিস্থাপন করতে চায়। তাদের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে বলা হয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের ‘অতুলনীয় সফট পাওয়ার’ বজায় রাখতে চায়; তবে তা অর্জনের পথ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে ‘আমেরিকার স্বকীয় মাহাত্ম্য ও শালীনতা’কে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা। কৌশলপত্রের ভূমিকায় ট্রাম্প গর্ব করে লিখেছেন, অবশেষে ‘যুক্তরাষ্ট্র আবার শক্তিশালী ও সম্মানিত হয়েছে’।
সমস্যা হলো, বাস্তবে এটি স্পষ্টতই সত্য নয়। যে দেশগুলো এখনো উদার মূল্যবোধ আঁকড়ে ধরে আছে, তারা ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রকে মোটেও সম্মান করে না। যুক্তরাষ্ট্রের সফট পাওয়ার এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের ওপর তার পরোক্ষ প্রভাব ক্রমেই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে।
এ কারণেই ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে ইউরোপের বিরুদ্ধে এত শক্তি ও বিষোদ্গার ব্যয় করা হয়েছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র জাঁকজমক করে বিশ্ব বদলানোর আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগের কথা বলছে। অন্যদিকে আবার ইউরোপে হস্তক্ষেপ করে তাকে রূপান্তরিত করতে চাওয়ার কথাও জানাচ্ছে।
‘মাগা’ আমেরিকা ইউরোপের যেসব রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে, তাদের সহায়তা করতে চায়—তারা কট্টর ডানপন্থী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র যেমন ইউরোপীয় সহযোগিতাকে উৎসাহ দিয়েছিল, তার বিপরীতে ট্রাম্প প্রশাসন এখন ইইউর নতুন সদস্যদেশগুলোর অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে একধরনের ফাটল সৃষ্টি করতে চায়; ইউরোপকে রূপ দিতে চায় সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর এক জোটে; যেগুলো হবে তীব্রভাবে জাতীয়তাবাদী ও সাংস্কৃতিকভাবে ‘শ্বেতাঙ্গ’ পরিচয়ে আবদ্ধ।
ট্রাম্প প্রশাসন বিক্ষিপ্ত ও খাপছাড়া হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে শাস্তি দিতে পারে এবং একই সঙ্গে কট্টর ডানপন্থী দলগুলোকে ক্ষমতায় আনতে সাহায্য করার চেষ্টা করতে পারে।
এই পৃথিবীতে ইউরোপ আর ‘মাগা’ মতাদর্শের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—এই রূপান্তর ঘটানোর মতো সক্ষমতা বা বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাদের নেই।
রাশিয়ার মতোই এই প্রশাসন সম্মান চায়, কিন্তু ‘স্পয়লার’ হিসেবে আচরণ করা ছাড়া তাদের হাতে তেমন কোনো ক্ষমতা নেই। তারা ইউরোপকে প্রভাবিত করতে চায়, আবার একই সঙ্গে ইউরোপের সঙ্গে সম্পৃক্ততা কমাতে চায়; ন্যাটোর নিরাপত্তা নিশ্চয়তাদাতা হিসেবে নিজেদের ভূমিকা থেকেও সরে আসতে চাইছে।
ট্রাম্পের কৌশলপত্র সেই ‘বৃহৎ সামরিক, কূটনৈতিক, গোয়েন্দা ও বৈদেশিক সহায়তা কাঠামো’কে তীব্রভাবে আক্রমণ করেছে, যেটি এত দিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার ভিত্তি ছিল এবং সেই কাঠামোকে ফাঁপা করে দেওয়ার জন্য যা কিছু করা সম্ভব, তাই করছে। কিন্তু সেই কাঠামো ছাড়া ইউরোপকে নিজেদের আদলে পুনর্গঠন করার ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের থাকবে না।
নিশ্চয়ই ট্রাম্প প্রশাসন বিক্ষিপ্ত ও খাপছাড়া হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে শাস্তি দিতে পারে এবং একই সঙ্গে কট্টর ডানপন্থী দলগুলোকে ক্ষমতায় আনতে সাহায্য করার চেষ্টা করতে পারে। তারা ইতিমধ্যে ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে সেসব ব্যক্তিকে, যাঁরা ফ্যাক্টচেকার বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মডারেটর হিসেবে কাজ করেছেন; যাঁদের বিরুদ্ধে ডানপন্থী মত দমন করার অভিযোগ আনা হয়েছে; একই সঙ্গে এক্সের মতো সেবা নিয়ন্ত্রণ করার ‘ধৃষ্টতা’ দেখানোর জন্য ইইউকে হুমকিও দিচ্ছে। কিন্তু ব্রাজিলের উদাহরণ হলো, কর্মকর্তাদের শাস্তি দেওয়া ও জাইর বলসোনারোকে সহায়তা করার চেষ্টা উল্টো মারাত্মকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এটা দেখায়, এসব পদক্ষেপ তাদের আদর্শিক মিত্রদের উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি করতে পারে।
ট্রাম্প প্রশাসন সম্মান ও বৈশ্বিক সফট পাওয়ারের সুবিধা পেতে চায়—এ কারণেই তারা ইউরোপের পেছনে ছুটছে। কিন্তু একই সঙ্গে তারা নিজেদের গুটিয়ে নিতে চায়, বৈশ্বিক সক্ষমতা কমিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে রাশিয়ার মতো একটি আঞ্চলিক শক্তিতে রূপ দিতে চায়; যে শক্তি নিজের প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর ‘দাদাগিরি’ করে নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করে। এই দুই লক্ষ্য একসঙ্গে অর্জন করা সম্ভব নয়।
হেনরি ফ্যারেল জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাভরোস নিয়ারকোস ফাউন্ডেশন অধ্যাপক (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক)।
সের্গেই রাদচেঙ্কো জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটি স্কুল অব অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের হেনরি এ কিসিঞ্জার সেন্টারের উইলসন ই শ্মিট অধ্যাপক।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনূদিত। ঈষৎ সংক্ষেপিত।