নীরবে অপেক্ষা করতে থাকি, পরের ‘হত্যাকাণ্ডটি’ কবে হবে

আরও একটা অগ্নিকাণ্ড! এবার হলো ঢাকার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা স্থান, বেইলি রোডে।ছবি : প্রথম আলো

বৃহস্পতিবার প্রায় মধ্যরাতে, আমার বেলজিয়ামের বাসায় যখন ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি, ঢাকায় তখন শেষরাত। ঘুমাতে যাওয়ার আগে একবার ফেসবুকে ঢুঁ মারার অভ্যাস। এরপর প্রথম আলোর অনলাইনে একবার চোখ বুলিয়ে নিই। রাতের শেষভাগ বলে ফেসবুকের পাতা সুনসান। কিন্তু প্রথম আলোর নিউজ আপডেটে চোখ আটকে গেল—‘বেইলি রোডে ভবনে আগুন, অন্তত ৪২ জন নিহত’। (এ অগ্নিকাণ্ডে এ পর্যন্ত ৪৬ জন মারা গেছে)

শিরোনাম দেখেই বুঝতে পারলাম, আবারও সর্বনাশ হয়ে গেছে। আরও একটা ভয়ানক দুর্যোগে ঝলসে গেছে কিছু তরতাজা মানুষ। আগুনের লেলিহান শিখা ছুটে আসছে, ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে চারপাশ, ক্রমে দম বন্ধ হয়ে আসছে আটকে পড়া মানুষগুলোর।

কর্মব্যস্ত সপ্তাহ শেষ করে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাইরে খেতে বেরোনো একটা মধ্যবিত্ত পরিবারে এর চেয়ে দুঃসহ পরিস্থিতি আর কী হতে পারে? দেড় দশক ধরে নিয়মিত বিরতিতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি! আরও একটা অগ্নিকাণ্ড! এবার হলো ঢাকার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা স্থান, বেইলি রোডে। পার্থক্য শুধু এইটুকুই।

২০১৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল শুক্রবার, ছুটির দিন।

সকালে ঘুম থেকে উঠে দেশের জনগণ জানতে পারল, পুরান ঢাকার চকবাজারের মানুষ এক ভয়াবহ রাত পার করেছে। অন্তত ৭০ জন মানুষ আগুনে পুড়ে তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। ভবনের নিচে থাকা রাসায়নিক গুদামের কারণে তৎক্ষণাৎ আগুন ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের ভিডিওর কথাও আমাদের মনে থাকার কথা। সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে কীভাবে মানুষ ছিটকে দূরে গিয়ে পড়েছে, তার আগে তার গোটা শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে।

চকবাজারে আগুনের এক মাসের মাথায়, সে বছরের মার্চ মাসে বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সেখানেও অন্তত ২৭ জন মানুষ প্রাণ হারায়। তখন এফআর টাওয়ারের পাশেই ছিল আমাদের অফিস। প্রাণ বাঁচাতে ভবনের ওপরের দিকের তলাগুলো থেকে মানুষ ছিটকে পড়ছে। দেখেছিলাম, জীবন বাঁচাতে কীভাবে মানুষ সামান্য ডিশ অ্যানটেনার তারকে সম্বল ভেবে ঝুলে পড়তে পারে।

তারও আগে গাজীপুরের তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন, ২০২১ সালে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে গোটা মগবাজার কেঁপে ওঠা। ২০১৩ সালের সাভারের রানা প্লাজা ধসের ইতিহাস তো সবারই জানা। পৃথিবীর ইতিহাসের ভয়ংকরতম সেই ভবনধসে অন্তত ১ হাজার ১৩৪ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। এখন দুনিয়াব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ফ্যাক্টরি সেফটি বা ভ্যালু চেইন পড়াতে গেলে রানা প্লাজাকে উদাহরণ হিসেবে টেনে আনা হয়। এ সবকিছুর আগে, ২০১০ সালে নিমতলীর অগ্নিকাণ্ড, যেখানে অন্তত ২৬৭ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল বলে মনে করা হয়।

এরপর এসব অভাব পূরণের জন্য সারা বছর আর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। কেউ কোনো কথা বলেন না। সবাই যেন নীরবে অপেক্ষা করতে থাকি, পরের হত্যাকাণ্ডটি কবে হবে? সেটা কি এবারের চেয়েও ভয়াবহ হবে? আগুনের লেলিহান শিখার মাঝখানে আটকে পড়া মানুষের তালিকায় এরপর কার নাম উঠবে?

ছোট-বড় আরও নানা উদাহরণ টানা যাবে। লেখার কলেবর বৃদ্ধি ছাড়া আর কী লাভ হবে? বরং সব কটি ঘটনার দিকে তাকালে মিল দেখতে পাওয়া যায়। দেখা যায়, আজ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া কোনো দুর্ঘটনারই বিচার হয়নি। বিচার তো দূরের কথা, একটা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদেরও চিহ্নিত করা হয়নি।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ২০১৯ সালের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের এক দিন পর, নিহত ব্যক্তির ছেলে আদালতে মামলা করেছিলেন। দীর্ঘ তিন বছর পর, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তদন্ত সম্পন্ন করে পুলিশ প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল। সেখানে ওয়াহিদ ম্যানশনের দুই মালিকসহ আটজনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।

এর মধ্যে রাসায়নিক গুদামের ছয় মালিকও ছিল। পরের বছর জানুয়ারিতে আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করলেও সবাই জামিন পেয়ে যায়। সেই মামলায় ১৬৭ জন সাক্ষী দেখানো হলেও আজ পর্যন্ত কাউকে জেরা করা হয়নি।

রানা প্লাজায় ১ হাজার ১৩৪ জন মানুষকে ইট-সুরকি-রডের নিচে ফেলে নিষ্পেষণ করে দেওয়ার জন্য ১১ বছরেও কোনো অপরাধী খুঁজে পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে ধীরে ধীরে গোটা শহরকে এক বিধ্বংসী বোমায় পরিণত করা হয়েছে, যেটি সামান্য একটা টোকার অপেক্ষায় রয়েছে।

সরকারেরই এক প্রতিবেদন বলছে, শুধু পুরান ঢাকায় অন্তত ২৫ হাজার রাসায়নিক গুদাম আছে। যার অন্তত ১৫ হাজার আবাসিক ভবনের নিচে। ফায়ার সার্ভিসের সূত্র বলছে, এই ২৫ হাজারের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ কারখানার প্রাতিষ্ঠানিক অনুমোদন আছে। বাকিগুলো অবৈধ।

চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডের পর সেসব গুদাম সরাতে খুব শোরগোল শোনা গেলেও আজ পর্যন্ত একটা গুদামও সরানো হয়নি। সেই বীভৎস অগ্নিকাণ্ড মানুষের স্মৃতি থেকে বিলোপ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে প্রসঙ্গও হারিয়ে গেছে; বরং কয়েক বছর ধরে নিবন্ধন দেওয়া বন্ধ রাখার কারণে এখন অনিবন্ধিত কারখানার সংখ্যা বাড়ছে। একটি ভবনের নিচে রাসায়নিক গুদাম নিয়ে সেই ভবনে বাস করা কি মৃত্যুকে জড়িয়ে ধরে বসবাস করার তুল্য নয়?

সম্প্রতি এর সঙ্গে ‍যুক্ত হয়েছে রেস্টুরেন্ট–বাণিজ্য। বাণিজ্যিক ভবন তো বটেই, আবাসিক এলাকার পাড়ায়-গলিতে বিরিয়ানি–বাণিজ্য। যেখানে প্রায় অধিকাংশ ভবনে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান চালানোর কোনো অনুমতি নেই। আগেকার ধানমন্ডি, উত্তরা আবাসিক এলাকা এবং গুলশান–বনানীর মতো জায়গায় খানিকটা স্বস্তি পেলেও সেটা এখন আর নেই।

দূর থেকে ভালো করে খেয়াল করলে বোঝা যায়, কোনো কোনো ভবনের প্রায় প্রতিটি তলায় খাবারের দোকান, যেখানে আকর্ষণীয় সাজসজ্জার জন্য ভবনের নকশার পরিবর্তন করা হয়, জরুরি বহির্গমনের সিঁড়ি ব্যবহার করা হয় সিলিন্ডারের গুদাম হিসেবে এবং যেকোনো দুর্ঘটনার পর জানা যায়, হয়তো ভবনটি নির্মাণের অনুমতি নেওয়া হয়নি; অথবা সেখানে খাবারের দোকান বসানোর অনুমতি নেই।

তাই কয়েক দিন  ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছে—ভবনের যে অনুমতি নেই, সেটা শুধু দুর্ঘটনার পরে কেন জানা যায়? এসব দেখভালের দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা কেন দায়িত্ব পালন করেন না? এত এত বীভৎস ঘটনার পরও কেন দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনা হয় না?

এ রকম ভয়াবহ মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে মানুষ তাহলে কী করবে? তারা কি বাইরে বের হওয়া বন্ধ করে দেবে? সে যে ঘরে বাস করছে, সেটা যে নিরাপদ, এ নিশ্চয়তা তাকে কে দেবে? এত আলোচনা–সমালোচনার পর যে অভিযান চলছে তার ধরণ নিয়েও প্রশ্ন কম নয়।

গত আড়াই দশকে বাংলাদেশ বেড়ে উঠছে ঢাকাকে কেন্দ্র করে। শুধু দেশেই নয়, এটি এখন পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত ও বড় নগরী। ২০৩০ সালের মধ্যে জনসংখ্যার দিক থেকে ঢাকা হবে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম শহর।

ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি এবং অপরিকল্পিত সম্প্রসারণ, সুশাসনের অভাব ঢাকাকে বসবাসের অযোগ্য নগরীতেও পরিণত করে তুলছে। বায়ুদূষণ থেকে শব্দদূষণ—নাগরিক সমস্যার প্রায় প্রতিটি সূচকে ঢাকা এখন প্রতিদিনই বিশ্বের তলানির শহরগুলোর মধ্যে থাকে। ভবিষ্যতে এই সমস্যা যে আরও বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য।

মনে আছে, চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডের পর সরকার তখন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, এই শহরের প্রতিটি কারখানা ও রাসায়নিক গুদাম কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেওয়া হবে। খবর নিয়ে যতটুকু জানলাম, এটিও কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।

অথচ নিমতলীর ঘটনার পর সরকারের গটিত তদন্ত কমিটি ১৭টি সুপারিশ দিয়েছিল। তার মধ্যে ছিল রাসায়নিক গুদাম আবাসিক এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া, ভবন নির্মাণের বিধি মানার জন্য উদ্যোগ নেওয়া, শহরের নানা জায়গায় হাইড্রেন্ট পয়েন্ট স্থাপন করা, কারখানা ও বাণিজ্যিক অনুমোদনের জন্য বহু প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে আলাদা কর্তৃপক্ষ তৈরি এবং স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়ে এ রকম দুর্যোগ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে পাঠ্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা। আজ পর্যন্ত এর একটিও আলোর মুখ দেখেনি।

এখানেই শেষ নয়; প্রতিটি ঘটনার পর জানা যায়, আগুন নেভানোর জন্য বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান—ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের লোকবল নেই, আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই, বিশেষ হেলিকপ্টার নেই, উঁচু মই নেই! যেটুকু আছে, যানজটে স্থবির শহরে সেটুকু যাওয়ার মতো রাস্তা তো নেইই।

এরপর এসব অভাব পূরণের জন্য সারা বছর আর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। কেউ কোনো কথা বলেন না। সবাই যেন নীরবে অপেক্ষা করতে থাকি, পরের হত্যাকাণ্ডটি কবে হবে? সেটা কি এবারের চেয়েও ভয়াবহ হবে? আগুনের লেলিহান শিখার মাঝখানে আটকে পড়া মানুষের তালিকায় এরপর কার নাম উঠবে?

প্রায় দুই কোটি মানুষ নিয়ে ধুঁকতে থাকা একটা শহর এভাবে চলতে পারে না।

রাজু নূরুল উন্নয়নকর্মী, দীর্ঘদিন নগর উন্নয়নবিষয়ক কর্মসূচি নিয়ে কাজ করেছেন। বর্তমানে বেলজিয়ামে উন্নয়ননীতি ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে পড়াশোনা করছেন। ই–মেইল: [email protected]