আরও যেসব আইনে বাক্‌স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার সুযোগ আছে

প্রাচীন গ্রিসে বাক্‌স্বাধীনতা বোঝাতে ‘ইসেগোরিয়া’ ও ‘পারহেসিয়া’ শব্দদ্বয় ব্যবহার করা হতো। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকেই ‘ইসেগোরিয়া’র ব্যবহার পাওয়া যায়, যার অর্থ ‘জনতার মধ্যে কথা বলার সমান অধিকার’। আর ‘পারহেসিয়া’ হলো ‘অন্যকে আঘাত করে হলেও কথা বলার অধিকার’।

এর মধ্যে ইসেগোরিয়াই বাক্‌স্বাধীনতার সঙ্গে সবচেয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রাচীনতম ধারণা, যা এথেন্সবাসী তাদের গণপরিষদে সবার কথা বলার সমান অধিকারের জন্য স্বীকৃতি দিয়েছিল। আর ‘পারহেসিয়া’ নাটক ও শিল্পের অন্যান্য ধারায় বহুল ব্যবহৃত ছিল।

গ্রিক সভ্যতার হাজার বছর পর, ফরাসি বিপ্লবোত্তর আধুনিক রেনেসাঁর কালে ব্রিটেনে ১৬৮৯ সালে ‘ইংলিশ বিল অব রাইটস’ প্রণীত হয়। এই বিল সংসদ সদস্যদের ‘আইন পরিষদে কথা বলা ও বিতর্কের স্বাধীনতা’ প্রদান করে।

ফরাসি বিপ্লবের দুই বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে বাক্‌স্বাধীনতা যুক্ত হয়। ফরাসি বিপ্লবের সময়  দ্য ডিক্লারেশন অব ম্যান অ্যান্ড অব দ্য সিটিজেনের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়, প্রত্যেক নাগরিকই কথা বলা, লেখা ও প্রকাশনার স্বাধীনতা রাখেন।

আরও পড়ুন

বর্তমানে ‘জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা’ বা আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদের ১৯ অনুচ্ছেদে বাক্‌স্বাধীনতার কথা উল্লেখ আছে।

বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদেও চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা ও বাক্‌স্বাধীনতা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে।

বলা হয়েছে, ‘আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বিধিনিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে’।

সাধারণভাবে বাক্‌স্বাধীনতা বলতে এমন নীতিকে বোঝায়, যা কোনো ব্যক্তির বা একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ভাবনা, চিন্তা ও মতামত কোনো প্রতিশোধ, সেন্সরশিপ বা আইনি ব্যবস্থার ভয় ছাড়াই প্রকাশের ক্ষমতাকে বোঝায়। কিন্তু সংবিধানের এই অধিকার কিছু ‘ব্যতিক্রম’ ক্ষেত্রে রহিত বা সীমিত।

এই বিধিনিষেধগুলো রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে, আদালত অবমাননা, মানহানি ও অপরাধের প্ররোচনার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ের ক্ষেত্রে কার্যকর হয়। কিছু সংবিধিবদ্ধ আইন দিয়ে এই বিধিনিষেধগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়।

বাকস্বাধীনতার ওপর কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে কি না তা নির্ধারণের ভার দেওয়া আছে আদালতের ওপর। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে আদালত সিদ্ধান্ত নেবেন তার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই। কেবল ৩৯ অনুচ্ছেদে বিশ্লেষণ করলে যৌক্তিকতা নির্ধারণের কিছু সাধারণ ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বাক্‌স্বাধীনতার অধিকারের রহিত করার সুযোগ আছে এমন আইনগুলোর বড় অংশই হয়েছে ঔপনিবেশিক শাসনামলে।

এর অর্থ হলো চাইলেই বাংলাদেশে বাক্‌স্বাধীনতার সাংবিধানিক অধিকার আইনিভাবেই রহিত করা সম্ভব। যেমন দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ১২৩ক, ১২৪এ, ১৫৩ক/খ, ১০৫ক, ২৯৮ ও ২৯৫ক ধারা; পোস্ট অফিস আইন ১৮৬৯-এর ২০, ২১, ২৬ ও ২৭ ক/খ ধারা এবং টেলিগ্রাফ আইন ১৮৮৫-এর ৫, ২৪-২৬ ও ২৯ ধারা বলে ‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নষ্ট’র অজুহাতে বাক্‌স্বাধীনতা শাস্তিযোগ্য ‘অপরাধ’ হতে পারে।

বৈদেশিক সম্পর্ক আইন ১৯৩২ (বিশেষত, ধারা ২)-এর অধীন ‘বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক’ এবং বিশেষ নিরাপত্তা আইন ১৯৭৪ (বিশেষত ধারা ৩এ/বি, ২৫ডি), সংবিধানের জরুরি বিধান (অনুচ্ছেদ ১৪১ বি/সি)-এর আওতায় ‘জনশৃঙ্খলা’ বিঘ্নের অপরাধে; দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৫০৯ ধারা এবং অশালীন বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধকরণ আইন ১৯৬৩-এর ৩, ৬ ধারাবলে ‘শালীনতা ও নৈতিকতা’ ক্ষুণ্নের অজুহাতে এবং দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ১০৭, ১০৯, ১১০, ১১২-১১৪, ১১৭, ১১৯ ধারাবলে ‘অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা’র অভিযোগে বাক্‌স্বাধীনতার চর্চা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হওয়ার সুযোগ আছে।

এ ছাড়া দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ১৭২-১৯০, ২২৮ ধারা, বাংলাদেশ সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদ, ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এর ১৯৫, ৪৭৬, ৪৮০-৪৮৭ ধারা, দেওয়ানি কার্যবিধি ১৯০৮-এর ১৩৫ ও ১৫১ ধারা, আদালত অবমাননা আইন ২০১৩ ২(৬), ৪(১), ৫(এ/বি), ৬ ধারার আওতায় ‘আদালত অবমাননা’র অভিযোগে এবং দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৪৯৯, ৫০১, ৫০২ ধারাবলে ‘মানহানি’র অপরাধে বাক্‌স্বাধীনতা রহিত করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা যায়।

এর বাইরে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট এবং অধুনা সাইবার সিকিউরিটি আইন ও উপাত্ত সুরক্ষা আইনের বিভিন্ন ধারাবলেও বাক্‌স্বাধীনতার সংবিধানবদ্ধ অধিকার অপরাধ হিসেবে গৃহীত হওয়ার নজির আছে।

আরও পড়ুন

তবে, বাকস্বাধীনতার ওপর কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে কি না তা নির্ধারণের ভার দেওয়া আছে আদালতের ওপর। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে আদালত সিদ্ধান্ত নেবেন তার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই। কেবল ৩৯ অনুচ্ছেদে বিশ্লেষণ করলে যৌক্তিকতা নির্ধারণের কিছু সাধারণ ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

বাক্‌স্বাধীনতার অধিকারের রহিত করার সুযোগ আছে এমন আইনগুলোর বড় অংশই হয়েছে ঔপনিবেশিক শাসনামলে। যেমন, দণ্ডবিধি ১৮৬০, পোস্ট অফিস আইন ১৮৬৯, টেলিগ্রাফ আইন ১৮৮৫, বৈদেশিক সম্পর্ক আইন ১৯৩২, অশালীন বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধকরণ আইন ১৯৬৩, ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এবং দেওয়ানি কার্যবিধি ১৯০৮।

এই সময়ের যে শাসনব্যবস্থা তার মূলমন্ত্রই ছিল মানুষের সব মৌলিক অধিকার ও সার্বিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে শাসন ও শোষণ টিকিয়ে রাখা। উপনিবেশ বিদায় নিয়েছে, ঔপনিবেশিক মানচিত্র ভাগ হয়ে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছে; কিন্তু ঔপনিবেশিক আইনের উত্তরাধিকার আমরা এখনো বহন করে চলেছি।

একবিংশ শতাব্দীতে এসেও মানহানি, রাষ্ট্রদ্রোহ, ধর্মীয় অবমাননা, রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা ভঙ্গ কিংবা জাতীয় বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতীকের অবমাননার অভিযোগকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

শত বছরের প্রাচীন নিপীড়নমূলক বিভিন্ন আইনের চর্চা ও প্রয়োগ এখনও অব্যাহত আছে। রাজা-রানি ও চার্চের সুরক্ষা এবং ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ টিকিয়ে রাখতে ইংল্যান্ড এই নিবর্তনমূলক আইনগুলো প্রণয়ন করেছিল।

সেখানেও মানহানির মতো অপরাধকে আর ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় না।

এক থেকে দেড় শতাব্দী প্রাচীন এসব আইনের ব্যবহার আমাদের সংবিধান ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বাক্‌স্বাধীনতাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে। একে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে, মতপ্রকাশের অধিকারকে সংকুচিত করে, তথ্য ও সংবাদ প্রকাশ কঠিন করে তোলে।

তাই দণ্ডবিধি ১৮৬০সহ সংশ্লিষ্ট সব আইন ও বিধি ঢেলে সাজানো এবং আধুনিক বিশ্বের প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে পুনঃপ্রণয়ন ও প্রণয়ন জরুরি।

অন্যথায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা সাইবার নিরাপত্তা আইনের মতো নিবর্তনমূলক আইন বাতিল বা সংশোধন করা হলেও প্রাচীন নানা আইন ও বিধিবলে বাক্ ও স্বাধীন মতপ্রকাশ অপরাধ হিসেবে গণ্য হওয়ার সুযোগ থেকেই যাবে।

  • জাফর সাদিক উন্নয়নকর্মী। ই–মেইল: [email protected]