সতী এখন ৩ ফুটের নদী

লালমনিরহাট শহরে বাসস্ট্যান্ড থেকে কয়েকশ গজ উজানে সতী নদী তিন ফুটে পরিণত হয়েছেছবি : লেখক

লালমনিরহাটের অন্যতম একটি নদীর নাম সতী। নদীটির গড় প্রস্থ ছিল প্রায় ৫০০ ফুট। দখলের কারণে লালমনিরহাট শহরে বাসস্ট্যান্ডের সামান্য উজানে নদীটি ৩ ফুটে পরিণত হয়েছে। নদীটির অবস্থা যে খারাপ, সে সম্পর্কে কিছু কিছু ধারণা আগে থেকেই ছিল। সেই খারাপ যে কতটা ভয়াবহ, সরেজিমনে তা দেখেছি। গত বছরে কয়েক দিন সতী নদী ঘুরেছি। গত দুই মাসেও কয়েকবার গিয়েছিলাম এ নদী দেখতে। নদীটি লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার পারুলিয়া এলাকায় তিস্তা নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে একই জেলার আদিতমারী হয়ে সদর উপজেলায় পুনরায় তিস্তা নদীতে মিলিত হয়েছে।

সতী নদী আদিতমারী উপজেলার ভাদাই ইউনিয়নে এসে ভেটেশ্বর নদে মিলিত হয়েছে। মিলিত প্রবাহ মিলনবাজারের পাশে দুভাগে প্রবাহিত হয়েছে। একটি প্রবাহ ভেটেশ্বর নামে, অপর প্রবাহ মরা সতী নামে প্রবাহিত। ভেটেশ্বর নদ আরও ভাটিতে সতী নাম নিয়েছে। এই সতী ও মরা সতীর প্রবাহ দুটি লামনিরহাট সদর উপজেলায় রাজপুর ইউনিয়নে মিলিত হয়েছে। মিলিত হওয়ার পর এর কিছু দূরে নাম হয়েছে দিকসতী। এই দিকসতী নদী চুঙ্গাদারা নামের একটি নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে তিস্তা (ছোট প্রবাহ) নামে গোকুণ্ডা ইউনিয়নে প্রধান তিস্তা নদীর সঙ্গে রেলেসেতুর এক কিলোমিটার উজানে মিলিত হয়েছে।

লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা, আদিতমারী এবং শহর এলাকার কয়েকটি স্থানে নদীটি দেখেছি। প্রতিটি স্থানে নদীটির করুণ চিত্র চোখে পড়েছে। লালমনিরহাটের সাপটিবাড়ির গিলাবাড়ি এলাকায় সেলিম নামের এক রিকশাওয়ালার সঙ্গে দেখা হয়েছিল গত বছর। তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মরা সতী নদী কোথায়? সেলিম আমাদের সামনের ধান চাষ হচ্ছে—এমন জমি ও পুকুর দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘এইটাই তো নদী!’ আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় নদী? তিনি আবারও একইভাবে বললেন, ‘এইটাই তো নদী!’ তিনি যে স্থানকে নদী নির্দেশ করলেন, তা বেশ প্রশস্ত। ওই স্থানে একটি পুকুরের পাড় ধরে কিছুটা হেঁটে সামনে দুজন বয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হয়। তাঁরা দুজনই জানান, ছোটবেলা তাঁরা দেখেছেন, এ নদীতে সারা বছর পানি থাকত। প্রচুর মাছ ছিল। দাদাদের কাছে গল্প শুনেছেন, চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্যের ডিঙা যেত এই পথে।

অবৈধভাবে দখল হওয়া নদীর জমি উদ্ধার করতে হবে। যেহেতু নদীর জমির মালিকানা ব্যক্তির হওয়ার সুযোগ কোনোকালেই ছিল না, তাই যে সূত্রে ব্যক্তিমালিকানা লাভ করুক না কেন, তা অবৈধ, বেআইনি। ফলে প্রথমেই বাতিল করতে হবে ব্যক্তির মালিকানা। খাজনা-খারিজ সব বন্ধ করতে হবে

নদীটি সম্পর্কে আরও খানিকটা জানতে পার্শ্ববর্তী কয়েকটি বাড়িতে গিয়েছিলাম। সাইদ আলী নামের এক প্রবীণের সঙ্গে কথা হয়েছিল। তাঁর কাছে জেনেছি, আট থেকে দশ বছরের মধ্যে নদীটির ভেতরে অসংখ্য পুকুর হয়েছে। এই পুকুরের জন্য পানি নেমে যেতে পারে না। মরা সতী নদীতে যে কয়টি সেতু দেখেছি, সেগুলো নদীর প্রকৃত প্রস্থের চেয়ে অনেক ছোট। কোথাও কোথাও দেখলাম নদীর প্রস্থের চেয়ে অন্তত ৩৫ গুণ ছোট কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। লালমনিরহাটের লোকাল বাসস্ট্যান্ডের পাশে দেখলাম, নদীটিতে অবৈধ স্থাপনাও হয়েছে। নদীটির বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ দূষণও আছে।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার গোকুণ্ডা ইউনিয়নের কাছে সতী নদী
ছবি : লেখক

মরা সতী নদীটি রেকর্ডপত্রে কোন অবস্থায় আছে, তারও অনুসন্ধান শুরু করি। দেখতে পাই, মরা সতী নদী যেসব এলাকায় ভালোভাবে প্রবাহিত হচ্ছে, সেখানেও রেকর্ডে নদী হিসেবে উল্লেখ নেই। বাস্তবে নদী আছে এবং মানুষের মুখে মুখে তার ঐতিহ্যগাথা থাকলেও অনেক স্থানে রেকর্ডপত্রে নদী নেই। যে এলাকায় বাস্তবে নদী আছে, কাগজে নেই, সেই অংশ দিয়ারা জরিপের মাধ্যমে নদী ঘোষণা করতে হবে। জেলা প্রশাসন চাইলে সহজে এটি করতে পারে। রেকর্ডপত্রে আরও দেখা যায় লালমনিরহাটে পুরোনো সতী নদীর প্রবাহ কোথাও কোথাও আগের স্থান থেকে সরে গেছে। পুরোনো প্রবাহের স্থানে গৃহহীনদের জন্য সরকারিভাবে গুচ্ছগ্রাম তৈরি করা হয়েছে। মরা সতী নদীটি বর্ষায় এখনো প্রবাহিত হয়। নদীটিতে দুটি স্থানে সেতু ছাড়া আড়াআড়ি রেললাইন স্থাপন করা হয়েছে। মরা সতী নদীটির উৎসস্থলও বন্ধ করে দেওয়া আছে।

নদীটি উদ্ধারে বেশ কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। যে স্থানে নদীটির প্রবাহে বাধা আছে, সেগুলো তুলে দিতে হবে। যেখানে সেতুর প্রয়োজন হবে, সেখানে নদীর প্রকৃত প্রস্থ অনুযায়ী সেতু নির্মাণ করতে হবে। তিস্তার সঙ্গে সংযাগ স্বাভাবিক করতে হবে। ছোট সেতুগুলোর স্থলে নদীর মাপ ধরে সেতু পুনর্নির্মাণ করতে হবে। দুটি রেলসেতু স্থাপন করতে হবে। প্রয়োজনীয় স্থানে দিয়ারা জরিপের মাধ্যমে নদী ঘোষণাপূর্বক রেকর্ডভুক্ত করতে হবে।

অবৈধভাবে দখল হওয়া নদীর জমি উদ্ধার করতে হবে। যেহেতু নদীর জমির মালিকানা ব্যক্তির হওয়ার সুযোগ কোনোকালেই ছিল না, তাই যে সূত্রে ব্যক্তিমালিকানা লাভ করুক না কেন, তা অবৈধ, বেআইনি। ফলে প্রথমেই বাতিল করতে হবে ব্যক্তির মালিকানা। খাজনা-খারিজ সব বন্ধ করতে হবে। জমির রেকর্ড যদি ব্যক্তির নামে হয়, তবু প্রথমে মালিকানা বাতিল করে তারপর রেকর্ড সংশোধনের ব্যবস্থা নিতে হবে।

সতী নদীটিকে তার পুরোনো রূপ দেওয়া সহজে সম্ভব। এর জন্য চাই দায়িত্বশীলদের আন্তরিক পদক্ষেপ।

  • তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক