তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সংখ্যা আসলে কত

হিজড়া জনগোষ্ঠীর সদস্যদের বিষয়ে পৃথিবীর অধিকাংশ সমাজই ভয়ানক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন
ছবি: প্রথম আলো

একটি অভূতপূর্ব প্রযুক্তি বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েও মানুষের কাছে আজও তাঁর নিজ প্রজাতির লিঙ্গপরিচয় অস্পষ্ট। বিচিত্র লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষের চিহ্নিত করতে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কিছু আমব্রেলা টার্ম বা ‘ছাতা শব্দ’ ব্যবহৃত হয়।
দক্ষিণ এশিয়ার ‘হিজড়া’ আর পশ্চিমা দেশগুলোর ‘ট্রান্সজেন্ডার’ প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের একেকটি ‘ছাতা শব্দ’। হিজড়া জনগোষ্ঠীর সদস্যদের বিষয়ে পৃথিবীর অধিকাংশ সমাজই ভয়ানক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। এর মূলে রয়েছে মানুষের লিঙ্গজ্ঞানের ঘাটতি।

এখনো বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ‘সেক্স’, ‘জেন্ডার’ এবং ‘জেন্ডার আইডেনটিটি’ শব্দগুলো পরস্পর বিনিময়যোগ্য শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইউরোপীয় আঞ্চলিক কার্যালয় সেক্স বা যৌনতাকে জৈবিকভাবে সংজ্ঞায়িত বৈশিষ্ট্য হিসেবে বর্ণনা করেছে। সাধারণত কারও শরীরস্থান, হরমোন এবং ক্রোমোজোমের গঠনসহ শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে জন্মের সময় তাঁর সেক্স নির্ধারিত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘সেক্স’ হলো একটি লেভেল, যার দ্বারা পুরুষ, মহিলা বা আন্তলিঙ্গের লোকেদের মধ্যে শারীরিক পার্থক্য নির্দেশ করা হয়। অপর দিকে লিঙ্গ ধারণা বেশ জটিল, যা ধারণা দেয় একজন ব্যক্তি নিজেকে কীভাবে শনাক্ত করে।

আরও পড়ুন

একজন মানুষ জন্মের সময় নির্ধারিত লিঙ্গ থেকে আলাদা বা কোনোটিই নয়—এমন লিঙ্গগুলোর মধ্যে নিজেকে শনাক্ত করতে পারেন। লিঙ্গ একই সঙ্গে ব্যক্তির সামাজিক ও আইনি অবস্থা বর্ণনা করে এবং ব্যক্তির আচরণ, বৈশিষ্ট্য ও মনোভাব সম্পর্কে সামাজিক প্রত্যাশাগুলোকেও নির্দেশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের মনোরোগবিদ্যার অধ্যাপক রবার্ট জে স্টলার মনে করেন, ‘লিঙ্গপরিচয়’ হলো কোনো ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ নিজস্ব অনুভূতি এবং লিঙ্গ সম্পর্কে তাঁর স্বতন্ত্র অভিজ্ঞতা, যা তাঁর জন্মের সময় নির্ধারিত লিঙ্গের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ হতে পারে বা না-ও হতে পারে।

এমনকি একজন মানুষের লিঙ্গপরিচয় অন্যদের কাছে সব সময় বাহ্যিকভাবে দৃশ্যমান না–ও হতে পারে। তাই কার চেহারা কেমন, তার ওপর ভিত্তি করে তাঁর লিঙ্গ সম্পর্কে অনুমান না করাই শ্রেয়। বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় ‘লিঙ্গপরিচয়’ শব্দটির মর্মার্থ অনুধাবন অত্যন্ত জরুরি। কারণ, আমদের সাধারণ জনতা মহানগরের ফুটপাতে সমাজ–দরদি পান্ডা কর্তৃক ‘হিজড়া’ লিঙ্গের মানুষকে বেধড়ক পিটিয়ে, পোশাক খুলে প্রতারক প্রমাণের দৃশ্য দেখতে অভ্যস্ত। আবার স্মার্ট করপোরেট লিডারও ঘর্মাক্ত হয়ে পড়েন মাত্র ১০০ জন খাঁটি ‘হিজড়া’ লিঙ্গের মানুষকে নিয়োগ দিয়ে সরকার ঘোষিত ৫ শতাংশ কর রেয়াতের সুবিধা নিতে।

আরও পড়ুন

২০১৯ সালে ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলি ইন্টারন্যাশনাল ক্ল্যাসিফিকেশন অব ডিজিজেস (আইসিডি-১১)–এর একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে, মানসিক ও আচরণগত ব্যাধিগুলোর অধ্যায় থেকে ট্রান্সজেন্ডার–সম্পর্কিত বিভাগগুলো বাতিল করে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ প্যানেলও এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে, ‘হিজড়ারা’ মানসিকভাবে যেমন সুস্থ, তাঁদের শারীরিক বৈশিষ্ট্যও প্রাকৃতিকভাবে স্বাভাবিক। কিন্তু অজ্ঞতাজনিত সামাজিক কুসংস্কার এই অসহায় জনগোষ্ঠীর স্বাভাবিক বিকাশের পথ রুদ্ধ করে আছে।

ভ্রান্ত ধারণার বলি হয়ে তাঁরা কখনো স্বেচ্ছায়, কখনোবা বলপ্রয়োগের কারণে নিজ পরিবার থেকেও নির্বাসিত হন। মানুষের সাংস্কৃতিক বিকাশের আঁতুড়ঘর পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অদৃশ্য অথচ দুর্ভেদ্য দেয়ালের আড়ালে বেড়ে ওঠার ফলে তাঁদের কাছে সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধের পরিচয় অধরাই থেকে যায়। তাই অনেক ক্ষেত্রেই সক্ষমতা থাকার পরও কেউ তাঁদের কাজে নিয়োগ দিতে চান না। কিন্তু মূল্যবোধের ঘাটতি তো আর ক্ষুধার কমতি ঘটানো। তাই পেটের তাগিদে তাঁরা পথেঘাটে, বাজারে, যানবাহনে হাত পাতে, চাঁদা তোলে।

রাষ্ট্র ও সমাজ যেহেতু তাঁদের বোধের বিকাশে ভূমিকা রাখেনি, তাই যৌক্তিক কারণেই তাঁদের আচরণগত অসংলগ্নতার দায় সভ্য সমাজের ওপরই বর্তায়। অথচ সমাজের কারও কারও আচরণদৃষ্টে মনে হয়, এই লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় মানব সন্তানেরা ইতর প্রাণীর চেয়েও নিকৃষ্ট। সরকার ২০১৪ সালের ২২ জানুয়ারি লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় এই জনগোষ্ঠীকে ‘হিজড়া’ লিঙ্গের মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

এখন তাঁরা সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি নথিপত্রে ‘হিজড়া’ লিঙ্গের মানুষ হিসেবে পরিচিত হচ্ছেন। জীবনমান উন্নয়নকল্পে সরকার সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ৫০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী অসচ্ছল ‘হিজড়া’ লিঙ্গের মানুষদের জন্য মাসিক বিশেষ ভাতা এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে ‘হিজড়া’ শিশুদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে উপবৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করেছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাঁদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতি সাধন’সংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের মাধ্যমে হিজড়া জনগোষ্ঠীর মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে উল্লিখিত পদক্ষেপগুলো আমার বিবেচনায় মোটেও যথেষ্ট নয়। কারণ, সরকারিভাবে স্বীকৃত ‘হিজড়া’ শব্দটি আবহমানকাল ধরে আমাদের সমাজে নেতিবাচক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এ ক্ষেত্রে ‘হিজড়া’ শব্দটির পরিবর্তে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ শব্দটি ব্যবহার করা যেতে পারে। তা ছাড়া দণ্ডবিধি, সাক্ষ্য আইন ও উত্তরাধিকার আইনের মতো জেন্ডার সেনসিটিভ আইনে ‘হিজড়া’ লিঙ্গের অবস্থান স্পষ্ট হওয়া দরকার।

এযাবৎকালের সবচেয়ে নিখুঁত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বৈশ্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনা হিসেবে বিবেচিত হয় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি), যার ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে লিঙ্গ সমতাসংক্রান্ত লক্ষ্য এসডিজি-৫–এর মূল বক্তব্য হচ্ছে, ‘লিঙ্গ সমতা অর্জন করা এবং সকল নারী ও কন্যাদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা’। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এসডিজি-৫–এর ৯টি টার্গেট এবং ১৪টি ইন্ডিকেটরের কোথাও ‘হিজড়া’ লিঙ্গের মানুষদের বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। অথচ এসডিজির মূল স্লোগান হচ্ছে ‘কেউ বাদ যাবে না’। এসডিজি-৫ নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করার সুযোগ রয়েছে।

একটি হিজড়া লিঙ্গের শিশুও যেন অশুভ বা মা–বাবার পাপের ফসল ইত্যাদি কুসংস্কারের গোলকধাঁধায় আটকে না যায়। এ লক্ষ্যে ‘হিজড়া’ জনগোষ্ঠীর প্রতিটি সদস্যকে শনাক্ত করে সমন্বিত কর্মসূচির আওতায় আনা অত্যাবশ্যক

এ ছাড়া ‘হিজড়া’ জনগোষ্ঠীকে পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে তাঁদের প্রকৃত সংখ্যা এবং অবস্থান নিরূপণ অত্যাবশ্যক। গবেষণা বলছে, প্রতি এক হাজার নবজাতকের মধ্যে কমপক্ষে এক থেকে তিনজন ‘হিজড়া’ লিঙ্গের শিশু জন্মগ্রহণ করে। অথচ এই নিবন্ধ লেখার সময় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত তথ্য বলছে, বাংলাদেশের মাত্র ১১ হাজার জন ‘হিজড়া’ লিঙ্গের মানুষ রয়েছেন।

এই পরিসংখ্যান আমাদের বাস্তব জীবনের চিত্র এবং গবেষণা ফলাফলের সঙ্গে মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। পরিসংখ্যানগত বিভ্রান্তি ‘হিজড়া’ জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন প্রক্রিয়াকে অকার্যকর করার জন্য যথেষ্ট। কারণ, কেবল সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করে বা সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ করে বা নিবন্ধ লিখে ‘হিজড়া’ জনগোষ্ঠীর স্বাভাবিকতার বিষয়টি সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না। এমনকি তাঁদের একাংশকে প্রশিক্ষিত কেজো মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যাবে না। উদ্যোগ নিতে হবে তাঁদের সামগ্রিক সাংস্কৃতিক ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের।

তাঁদের আচরণকে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রত্যাশার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। প্রত্যেকের অন্তর্নিহিত দক্ষতা চিহ্নিত করে, সে মোতাবেক প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ, হিজড়া জনগোষ্ঠীকে এমন একটি সমন্বিত প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে নিয়ে যেতে হবে, যাতে তাঁরা নিজেদের আচরণ, শালীনতা বোধ, মানবিক মূল্যবোধ এবং কর্মদক্ষতার মাধ্যমে সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য মানুষ হিসেবে উপস্থাপিত হতে পারেন। যাতে আর কোনো মা–বাবা ‘হিজড়া’ লিঙ্গের শিশুকে নিয়ে বিব্রত বোধ না করেন।

একটি হিজড়া লিঙ্গের শিশুও যেন অশুভ বা মা–বাবার পাপের ফসল ইত্যাদি কুসংস্কারের গোলকধাঁধায় আটকে না যায়। এ লক্ষ্যে ‘হিজড়া’ জনগোষ্ঠীর প্রতিটি সদস্যকে শনাক্ত করে সমন্বিত কর্মসূচির আওতায় আনা অত্যাবশ্যক। একই সঙ্গে আমাদের নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে, সরকারি–বেসরকারি অ্যাকটিভিস্ট এবং সাধারণ মানুষের কাছে সেক্স, জেন্ডার ও জেন্ডার আইডেনটিটি শব্দগুলোর মর্মার্থ পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করাও জরুরি।

এ জন্য হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কর্মরত সংস্থাগুলোকে নিয়ে সমন্বিতভাবে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। যাতে ‘হিজড়া’ লিঙ্গের মানুষেরা তাদের নিজ নিজ পরিবার, সমাজ ও সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠার সুযোগ পান। অবসান ঘটে আশরাফুল মাখলুকাত আদম সন্তানদের অবমাননার নির্মম উপাখ্যানের।

  • ড. মোহাম্মদ ফজলুর রহমান খান সহকারী অধ্যাপক (হিসাববিজ্ঞান), ময়মনসিংহ সরকারি কলেজ, ময়মনসিংহ।
    e-mail: [email protected]