ফারুকীর আরও শাস্তি হোক!

শনিবার বিকেল চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য

১০ থেকে ১২ বছর আগে আমি নিয়মিত ফুটবল খেলতাম। খেলতাম ফুলার রোডের মাঠে, অন্য শিক্ষকদের উঠতি বয়সের ছেলেদের সঙ্গে। তারা ছিল শক্তিশালী ও লড়াকু ধরনের, ফুটবল ছিল তাদের ধ্যানজ্ঞান। খেলতে খেলতে প্রায় রাত নেমে এলে ক্ষান্ত হতো একপর্যায়ে।

এমন ফুটবল–পাগলদের সঙ্গে খেলছি একদিন, হঠাৎ শুনি ‘ফারুকী আসছে, ফারুকী আসছে’ বলে রব উঠল মাঠে। মাঠের পাশের রাস্তা সোজা চলে গেছে বাইরের ফটকের দিকে। দেখি ক্যাপ পরা শীর্ণ দেহের একটা মানুষ দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে সেদিকে আর তার পেছনে পেছনে ছুটে যাচ্ছে আমাদের ফুটবলাররা।

সে অবশেষে পেছন ঘুরে কথা বলল তাদের সঙ্গে, তারা একসময় ফিরে এল, কিন্তু খেলায় আর মন বসল না তাদের। একজন আমাকে বিহ্বলভাবে বলল, ‘আঙ্কেল, ফারুকী এসেছিল, মোস্তফা সারোয়ার (সরয়ার) ফারুকী, চিনেন না?’ প্রবলবেগে মাথা নেড়ে বললাম, চিনি, চিনি। তারপর অবাক হয়ে ভাবতে থাকলাম, শুধু টেলিভিশনের নাটক বানিয়ে এত জনপ্রিয় হয় মানুষ!

সেই ফারুকী তারপর আরও কত বিস্ময়ের জন্ম দিল। সে সিনেমা বানানো শুরু করল, তার সিনেমা পৃথিবীর নামকরা সব ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রশংসিত হলো, জুরি হিসেবে তাকে ডাকা হলো বড় বড় আসরে, তাকে নিয়ে লেখালেখি শুরু হলো নামীদামি গণমাধ্যমে। সে এবং তার হাতে তৈরি হওয়া একঝাঁক নতুন নির্মাতা আমাদের ফিরিয়ে আনল টেলিভিশনের পর্দায় বা টেনে নিল ওটিটি প্ল্যাটফর্মে।

এমন একজন মানুষের সৃজনশীলতাকে সর্বতোভাবে প্রমোট করার কথা দেশের কর্তাব্যক্তিদের। আর সেই ফারুকী এখন নিথর হয়ে বসে আছে একটা সিনেমা বানিয়ে। হোলি আর্টিজানের মর্মান্তিক ঘটনা অবলম্বনে চার বছর আগে তার নির্মিত শনিবার বিকেল নামের সিনেমাটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ও গণমাধ্যমে প্রশংসিত হয়েছে। দেশে যারা দেখার সুযোগ পেয়েছে, তারাও মুগ্ধ এটা নিয়ে। কিন্তু সরকারের সেন্সর বোর্ড তা প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনের ছাড়পত্র আটকে রেখেছে বছরের পর বছর ধরে। সে–ও এমনি খেলো যুক্তিতে, এমনি অদ্ভুতভাবে যে এর সঙ্গে একমত হওয়া অসম্ভব মুক্তমনের মানুষের পক্ষে।

এর মধ্যে এ দেশে কবিতা লিখে চাকরি গেছে। উপন্যাসের লেখা বদলাতে নির্দেশ এসেছে, ভিন্নমতের কারণে বাংলা একাডেমিতে প্রকাশক নিষিদ্ধ হয়েছে, গণমাধ্যম বন্ধ হয়েছে, সাংবাদিকের চলাচল সীমাবদ্ধ করা হয়েছে, শিশু-কিশোরকে জেলে পোরা হয়েছে, নানাভাবে মানুষকে নিগৃহীত করা হয়েছে। ফারুকীর জন্য বিবৃতিদাতাদের কেউ কেউ তাতে একটুও বিচলিত ভাব প্রকাশ করেননি, বরং নানাভাবে এসব পদক্ষেপ গ্রহণের উপযোগী সরকারব্যবস্থার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তবু ভালো, ফারুকীর শাস্তিতে বিচলিত হয়ে হলেও অবশেষে তাঁরা স্বাধীনতার মূল চেতনা হিসেবে মুক্তচিন্তা ও মুক্ত মননশীলতার কথা বলেছেন।

২. 

শনিবার বিকেল নির্মাণের আগে এর চিত্রনাট্য তথ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছিল চার বছর আগে (২০১৯ –এর জানুয়ারি)। সেন্সর বোর্ড ছবিটি দেখে অনুমোদনও করেছিল। আপত্তিকর কিছু দূরের কথা, বোর্ডের সদস্যরা নিজেরা পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে ছবিটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন বরং। এর মাত্র সাত দিনের মাথায় দ্বিতীয়বারের মতো ছবিটি দেখে তা মুক্তির সার্টিফিকেট দিতে অস্বীকৃতি জানায় বোর্ড। এক জিনিসের দুবার বিচার হয় না, এটি ছিল ন্যায়বিচারের মৌলিক নিয়মের পরিপন্থী।

শনিবার বিকেল নিয়ে আশ্চর্য ঘটনার এখানেই শেষ নয়। এরপর ফারুকীর আপত্তির কারণে আপিল কমিটি পরের মাসে সভা করলেও এ নিয়ে নিশ্চুপ থাকে বছরের পর বছর। এখন জানা যাচ্ছে, সাড়ে তিন বছর আগে যে সভা হয়ে গেছে আপিল কমিটির, সেটাও আবার হবে ২১ জানুয়ারিতে!

শনিবার বিকেল নিয়ে সেন্সর বোর্ড ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের এসব কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতার অভাবও প্রকট। কেন ফারুকীর ছবি আটকে দেওয়া হলো, তার কোনো সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না তাই। সেন্সর বোর্ডের আপিল কমিটির সদস্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফের একটি লেখা পড়ে জানা যায়, এটির অনুমোদন আসলে আটকে দিয়েছিলেন তৎকালীন ক্যাবিনেট সেক্রেটারি, অর্থাৎ সরকারের একজন উচ্চপদস্থ আমলা।

২০২২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোতে তিনি লিখেছেন যে এই ছবিতে ফারুকী ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মানবিক ও অন্যদিকে জঙ্গিদের নৃশংস চরিত্র তুলে ধরেছেন এবং তিনি নিশ্চিত, এই ছবি দেখে দর্শকেরা জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ করার কথা ভাববে। নাসির উদ্দীন ইউসুফের কথা শুনে তৎকালীন ক্যাবিনেট সেক্রেটারি তঁাকে বলেছিলেন, ‘আপনার বক্তব্যে যুক্তি রয়েছে, কিন্তু আমাদের পক্ষে এ ছবির ছাড়পত্র দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, এ ছবি রাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।’ অর্থাৎ এই আমলা ভেবেছেন যে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করবে, এমন ছবি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারে। কী হাস্যকর! 

নাসির উদ্দীন ইউসুফ আরও লেখেন যে কিছু বোদ্ধা এই যুক্তিও দিয়েছেন যে এই ছবি দেখে হোলি আর্টিজানের ঘটনা সবার নতুন করে মনে পড়বে এবং জঙ্গিরা আবারও তৎপর হয়ে উঠবে। এই যুক্তি সমানভাবে হাস্যকর। কারণ, এটি মেনে নিতে হলে দেশের সাহিত্য, নাটক, সংগীত—এমনকি সব গণমাধ্যম বন্ধ করে দিতে হবে। যেমন সংবাদপত্র নিয়মিতভাবে জঙ্গি তৎপরতা, ব্যাংক লুট, ভুয়া নির্বাচন, গুম, হত্যা, বিদেশে টাকা পাচার, ভূমিদস্যুদের দৌরাত্ম্যের সংবাদ ছাপায়। এসব অপরাধের সংবাদ প্রতিদিন দেখে দেখে মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবৃত্তি জাগ্রত হতে পারে, এই যুক্তিতে তো তাহলে সব গণমাধ্যমই বন্ধ করে দেওয়া উচিত! ভারতে হোলি আর্টিজানের ঘটনা নিয়েই নির্মিত ফারাজ সিনেমাটি মুক্তি পাচ্ছে আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি। ফারাজসহ যেকোনো দেশি-বিদেশি চলচ্চিত্রের প্রদর্শনও তাহলে নিষিদ্ধ করা উচিত সরকারের। 

শিল্প-সংস্কৃতির মাধ্যমের অন্যতম উপজীব্য হচ্ছে মানুষের অপরাধপ্রবণতা। এই প্রবণতা ছাড়া মানব সত্তা, এমনকি মানবসভ্যতা অকল্পনীয়। কোনো মাধ্যমে যদি এই অপরাধপ্রবণতাকে উৎসাহিত করা হয়, শুধু তখনি তা সেন্সরের কথা আসতে পারে। শনিবার বিকেল কি তা করেছে? নিউইয়র্ক টাইমস, বিভিন্ন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, নাসির উদ্দীন ইউসুফসহ বিভিন্ন দর্শক—কারও কাছে এটি মনে হয়নি। এই ছবি কি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে? এটিও কারও কাছে মনে হয়নি। ক্যাবিনেট সেক্রেটারি বা এই ছবির ছাড়পত্র আটকে দেওয়া ব্যক্তিরা জঙ্গিবাদবিরোধী এ ছবির মধ্যে তাহলে এসব কীভাবে আবিষ্কার করলেন? 

‘ভাবমূর্তির’ সংজ্ঞাই–বা তাঁরা কোথায় খুঁজে পেলেন? 

আরও পড়ুন

৩. 

শনিবার বিকেল-এর করুণ পরিণতিতে ক্ষুব্ধ হয়ে দেশের খ্যাতনামা ১২৯ জন সাংস্কৃতিক কর্মী একসঙ্গে বিবৃতি দিয়েছেন। তাঁদের অনেকে ছবিটি দেখেছেন এবং বুঝতেই পারছেন না, কেন এটি আটকে রাখা হয়েছে। তাঁরা বলেছেন, ‘কোনো কিছু আটকে দেওয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের মৌল চেতনার পরিপন্থী এবং সিনেমাটির (শনিবার বিকেল) সঙ্গে নিজ দেশে এই অন্যায্য আচরণে মনে হয়, সম্ভবত আমরা এই দেশে তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বাস করছি।’ অন্যদিকে ছোট পর্দার নির্মাতাদের সংগঠন ‘ডিরেক্টর গিল্ড’ একে মুক্তচিন্তার জন্য বড় বাধা হিসেবে উল্লেখ করে বলেছে, সিনেমাটি কেন ছাড়পত্র পাচ্ছে না, তা তাঁদের কাছেও পরিষ্কার নয়। 

বিবৃতিদাতারা চলচ্চিত্রকার হিসেবে ফারুকীর মর্মবেদনার কথা বলেছেন। দূর থেকে এই মর্মবেদনা একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমিও বুঝতে পারি। তবু আমার মনে হয়, ফারুকীর এই শাস্তিতে একটা লাভ অন্তত হয়েছে। তার চলচ্চিত্রের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন নাটক-চলচ্চিত্র- সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বহু মানুষ। তাঁদের অনেকে চিন্তার স্বাধীনতা, বাক্‌স্বাধীনতা, সৃষ্টির স্বাধীনতার বিরুদ্ধে সরকারের অন্যায় পদক্ষেপের প্রতিবাদ আগে কখনো করেননি।

আরও পড়ুন

এর মধ্যে এ দেশে কবিতা লিখে চাকরি গেছে। উপন্যাসের লেখা বদলাতে নির্দেশ এসেছে, ভিন্নমতের কারণে বাংলা একাডেমিতে প্রকাশক নিষিদ্ধ হয়েছে, গণমাধ্যম বন্ধ হয়েছে, সাংবাদিকের চলাচল সীমাবদ্ধ করা হয়েছে, শিশু-কিশোরকে জেলে পোরা হয়েছে, নানাভাবে মানুষকে নিগৃহীত করা হয়েছে। ফারুকীর জন্য বিবৃতিদাতাদের কেউ কেউ তাতে একটুও বিচলিত ভাব প্রকাশ করেননি, বরং নানাভাবে এসব পদক্ষেপ গ্রহণের উপযোগী সরকারব্যবস্থার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তবু ভালো, ফারুকীর শাস্তিতে বিচলিত হয়ে হলেও অবশেষে তাঁরা স্বাধীনতার মূল চেতনা হিসেবে মুক্তচিন্তা ও মুক্ত মননশীলতার কথা বলেছেন।

আমি ভাবছি, সেন্সর বোর্ড আর আপিল কমিটি তাহলে ভালোই করেছে। ফারুকীর ছবিকে শাস্তি দিয়ে তারা সরকারের কর্তৃত্ববাদকে প্রকট করে দিচ্ছে, সরকারের অন্ধ ভক্তের মনেও প্রতিবাদস্পৃহা জাগিয়ে তুলছে। এটাই যদি তাদের লক্ষ্য হয়ে থাকে, ফারুকীর তাহলে আরেকটু শাস্তি হোক! 

আপিল কমিটি, ভালো হয় না তাতে?

আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক