ঘটনাটি একজন চিকিৎসকের কাছ থেকে শোনা। তাঁর নাম রায়হান ই জান্নাত। এ মাসে তাঁদের পারিবারিক এক সম্পত্তির দলিল নিবন্ধনের সময় ভাইবোনদের সই করার প্রয়োজন হয়েছিল। তাঁর বোনেরা চাকরিজীবী। তবে নিবন্ধনের সময় ঢাকার সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মী চার বোনের পেশার জায়গায় ‘গৃহিণী’ লিখে দিয়েছেন।
ঘটনাটি বলতে গিয়ে রায়হান ই জান্নাত জানান, তিনি চিকিৎসক হয়েছেন আশির দশকে। দুই বছর আগে অবসর নিয়েছেন। দীর্ঘদিন সরকারি হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দায়িত্ব পালন করেন। সবশেষ রাজধানীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে উচ্চ পদে ছিলেন। তাঁর দ্বিতীয় বোন স্বায়ত্তশাসিত একটি হাসপাতালের পরিচালক, তৃতীয় বোন কানাডায় মানবাধিকার-বিষয়ক একটি বেসরকারি সংস্থার আইনজীবী এবং চতুর্থ বোন উপসচিব।
মে মাসের প্রথম সপ্তাহে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের নিবন্ধনের কাগজে সই করতে রায়হান ই জান্নাত দেখেন তাঁর নামের আগে সংক্ষেপে ‘ডা.’ লেখা থাকলেও পেশার জায়গায় লেখা ‘গৃহিণী’। অন্য বোনদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। চরম বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের সেই কর্মীকে বললেন ‘পেশার জায়গাটি ঠিক করুন, না হলে আমি সই করব না।’ শেষ পর্যন্ত সার্টিফায়েড (সত্যায়িত) কপিতে পেশার জায়গা ঠিক করে দেবেন বলে সম্মত হয়েছেন সেই কর্মী।
সেই চিকিৎসককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনি সেই কর্মীর কাছে ‘গৃহিণী’ লেখার কারণ জানতে চেয়েছিলেন কি না? তিনি ‘হ্যাঁ’ সূচক জবাব দিয়ে জানান, প্রশ্নের জবাব যা পেয়েছেন, তা খুবই ‘হাস্যকর’ আর ‘অযৌক্তিক’। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মীর জবাব ছিল, সম্পত্তির দলিলে সই করা নারীদের ৯৯ শতাংশের ক্ষেত্রে তিনি দেখেছেন সেসব নারীর পেশা গৃহিণী। তাই তিনি ভেবেছেন সেই চার বোনও গৃহিণী। পরে চিকিৎসক নারী সেই কর্মীকে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘নামের আগে ডা. লিখেছেন, অথচ পেশা বোঝেননি, এটা কেমন কথা?’
ঘটনাটি শুনে আমার শুধু মনে হচ্ছিল, সেই ব্যক্তি ‘পেশা বোঝেননি’ তা নয়, উপলব্ধি করেননি। মনোজগতে পুরুষতান্ত্রিক ভাবনা এমনভাবে গেড়ে বসেছে যে পঞ্চাশোর্ধ্ব বা ষাটোর্ধ্ব নারীদের মধ্যেও কর্মজীবী নারী থাকতে পারেন, এই ভাবনা তার মাথায় ঢোকে না। তাঁর কথামতো ‘সম্পত্তির দলিলে সই করা ৯৯ শতাংশ নারী গৃহিণী’ হলে তো বলতে হয়, রাজধানীতে বাড়ি-জমি আছে—এমন ১ শতাংশ পরিবারের নারীরা কর্মজীবী। হাতে তথ্য-উপাত্ত না থাকলেও এই হিসাব যে ঠিক না, তা বোঝাই যায়। তবে সেই কথা থেকে আমার নিজের একটা ধারণা হচ্ছিল, হয়তো সেই চার বোনের মতো অনেক কর্মজীবী নারীকেই সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মীরা ‘গৃহিণী’ লিখে দেন। সেসব নারীর কেউ হয়তো সংশোধনের কথা বলেন না। কাজেই দলিলে তাঁদের পেশার জায়গা ‘গৃহিণী’ থেকে যায়। অথবা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার মুখে সেই কর্মী এ নিয়ে অসত্য তথ্য দিয়েছেন।
সত্যিই! নারীবাদ কীভাবে নেতিবাচক হয়? এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় ফেমিনিজম বা নারীবাদ নিয়ে কী বলা হয়েছে, তা এখানে তুলে ধরলাম—‘সব লিঙ্গের মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমতার বিশ্বাসই নারীবাদ। নারীবাদের উৎস পশ্চিমে হলেও এখন তা বিশ্বজুড়ে দেখা যায় এবং নারীর অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায় কাজ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নারীবাদের প্রতিনিধিত্ব করে।’
চিকিৎসক রায়হান ই জান্নাত জানালেন, এ ধরনের জেন্ডার অসংবেদনশীল আচরণের মুখোমুখি তিনি অতীতে অনেকবারই হয়েছিলেন। আশির দশকে উপজেলা পর্যায়ে তিনি ও তাঁর স্বামী যখন চাকরি করতেন, তাঁর (চিকিৎসক নারী) অধীন কাজ করা এক ব্যক্তি তাঁকে হাসপাতালে ‘ভাবি’ বলে সম্বোধন করতেন। তিনি আপত্তি করার পর সেই ‘সম্বোধন’ বন্ধ হয়েছিল, তবে পাশ থেকে এক কর্মকর্তা টিপ্পনী কেটে বলেছিলেন, ‘আপনার কাছে স্বামীর চেয়ে নিজের পরিচয়ই বড় হলো?’ আরেকবার কয়েক মাসের সন্তানকে রেখে গ্রামে বিনা মূল্যের চিকিৎসা ক্যাম্পে গিয়েছিলেন। সেখানে একজন তাঁকে বলেছিলেন, ‘কি নির্দয় মা! দুধের বাচ্চা রেখে চলে এসেছে।’ তাঁর মতে, এখন তো সময় পাল্টেছে, বিভিন্ন পেশায় নারীর সংখ্যা বেড়েছে। পোশাক কারখানায় নারীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফলে নারীদের পেশা নিয়ে গতানুগতিক পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব থাকাটা মেনে নেওয়ার মতো নয়।
তবে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব এখনো কোন পর্যায়ে আছে, সেটি ইউনেসকোর গত বছরের প্রতিবেদন থেকে ভালোই বোঝা যায়। গত বছর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর ‘গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট ২০২২ (বৈশ্বিক শিক্ষা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন)’ প্রতিবেদনে ৮৪টি দেশের ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা বলা হয়, বিশ্বের ৪৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ মনে করেন, মা চাকরি বা ঘরের বাইরে কাজ করলে সন্তানের দুর্ভোগ হয়। বাংলাদেশে এ হার ৮৭। বিশ্বে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি মানুষ মনে করেন, মা চাকরি করলে সন্তানের দুর্ভোগ হয়।
ভয়ের কথা হচ্ছে, পুরুষতান্ত্রিক এই মনোভাব নারীর পেশার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এই মনোভাব নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ ঘটাতে সংক্রামক ভাইরাসের মতো কাজ করে। নারীর ক্ষমতায়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে নারীর বলা ‘না’-এর প্রতিক্রিয়া আসে তীব্রভাবে। আর এ কারণেই প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার কারণে ২০২৩ সালের ২ মে নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা উপজেলার প্রেমনগর গ্রামের মুক্তি রানী বর্মণকে (১৫) স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে কাওছারের দায়ের কোপে নিহত হতে হয়েছে। একই কারণে ৮ মে গাজীপুরের কলেজছাত্রী রাবেয়া আক্তারকে (২১) ঘরে ঢুকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করেন গৃহশিক্ষক সাইদুল ইসলাম।
পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব নিয়ে উদাহরণ টানতে গেলে লেখা শুধু দীর্ঘই হবে। কিছুদিন আগে স্বামী-সন্তানদের নিয়ে রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিলাম। খাবারের মেনু ঠিক করলাম আমি। খাবার শেষে ওয়েটার বিলের কপি এনে স্বামীর সামনে রাখল। সেদিনের বিল আমার দেওয়ার কথা ছিল। তাই স্বামী মুচকি হেসে ওয়েটারকে বললেন,‘বিল, ম্যাডামকে দিন।’
পেশাগত কাজে কিছুদিন আগে সরকারের এক উচ্চপদস্থ ব্যক্তির সঙ্গে কথা হচ্ছিল। আমার সঙ্গে দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক রাবেয়া বেবীও উপস্থিত ছিলেন। সেই কর্মকর্তা নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলতে গিয়ে বেশ ইতিবাচক কথা বলছিলেন। তাঁর বাড়িতে কীভাবে মেয়েদের মূল্যায়ন করা হয়, সেটিও বলছিলেন। প্রসঙ্গে প্রসঙ্গে তিনি নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের কথা টেনে এনে বলেন, ‘রোকেয়া নারী-পুরুষের সমান অধিকারের জন্য লড়াই করেছেন। কিন্তু তিনি নারীবাদী ছিলেন না।’ আমি বললাম, ‘রোকেয়া তো নারীবাদীই ছিলেন। তাঁকে প্রথম বাঙালি মুসলিম নারীবাদীও বলা হয়।’ সেই কর্মকর্তা আমার ‘অজ্ঞতায়’ কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, ‘রোকেয়া অনেক ইতিবাচক মানুষ ছিলেন, সম্মানের জায়গায় ছিলেন। নারীবাদ হচ্ছে নেতিবাচক বিষয়।’
সত্যিই! নারীবাদ কীভাবে নেতিবাচক হয়? এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় ফেমিনিজম বা নারীবাদ নিয়ে কী বলা হয়েছে, তা এখানে তুলে ধরলাম—‘সব লিঙ্গের মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমতার বিশ্বাসই নারীবাদ। নারীবাদের উৎস পশ্চিমে হলেও এখন তা বিশ্বজুড়ে দেখা যায় এবং নারীর অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায় কাজ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নারীবাদের প্রতিনিধিত্ব করে।’
সমস্যার ভেতরেই সমাধান লুকিয়ে থাকে। তাই পুরুষতন্ত্রের জাল ছিঁড়ে পুরুষ ও নারীর সমতার সমাজ প্রতিষ্ঠাও অসম্ভব কিছু নয়। শুধু প্রয়োজন নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের প্রথম পাঠ শুরু হতে হবে পরিবারে। নারী ও পুরুষকে সমানভাবে দেখার পরিবেশ পরিবারে তৈরি করতে হবে। সেই ভাবনার প্রসার ঘটাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে পালন করতে হবে গুরুদায়িত্ব। সমতার লালন-পালন চলবে সমাজে। আর সমতার কাঠামোকে শক্তভাবে পরিচালিত হতে হবে রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে।
নাজনীন আখতার প্রথম আলোর জেষ্ঠ্য প্রতিবেদক