ভারতে চাকরিতে উচ্চবর্ণের নারী কেন কম

ভারতে কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণের কম অনুপাত একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয়

চীনে মেয়েদের পায়ের পাতার আকার ছোট করার জন্য লোহার জুতা পরিয়ে রাখার মতো যন্ত্রণাদায়ক সংস্কৃতি চালু হয়েছিল সেই দশম শতকে। প্রায় এক সহস্রাব্দ এই সংস্কৃতি চালু থাকার পর ১৯১১ সালে সেটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।

অবশ্য এটি কাগজে-কলমে নিষিদ্ধ হলেও বাস্তবে বন্ধ ছিল না। ১৯৪৯ সালে চীনে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত এই ভয়ানক কষ্টদায়ক সামাজিক সংস্কার বেশ ব্যাপকভাবেই চালু ছিল। প্রজাতন্ত্র চালু হওয়ার পর ১৯৯০ সাল নাগাদ দেশটির নারীদের ৭৩ শতাংশ শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে সেই যন্ত্রণাদায়ক সংস্কৃতি দূর হয়।

পঞ্চদশ শতকের ইউরোপে মেয়েরা তাদের কোমর সরু করে দেহের ওপরের অংশকে ইংরেজি ‘ভি’ আকৃতি দেওয়ার জন্য কাঠ, হাড় এমনকি লোহা দিয়ে বানানো এক ধরনের কর্সেট বা কাঁচুলি পরত। সহজে চলাফেরা করা যায়, এমন আরামদায়ক পোশাক ইউরোপে এসেছে এই সবে বিংশ শতকে।

মেয়েদের পা ছোট রাখার জন্য লোহার জুতা পরিয়ে রাখা এবং কোমর সরু করার ওই সংস্কৃতি শুরু হয়েছিল সমাজের অভিজাত শ্রেণির মধ্যে। সেখান থেকে তা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল।

সেই ঐতিহাসিক বাস্তবতা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে শারীরিক সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য যে নারীরা বা মেয়েরা তখন এসব কঠিন পদ্ধতি অনুসরণ করতেন, তাঁদের পক্ষে কোনো অর্থনৈতিক বা উৎপাদনমূলক কাজ করা সম্ভব হতো না।

ভৌগোলিক কারণে চীন ও ইউরোপ যদিও সাংস্কৃতিকভাবে পৃথক মেরুতে ছিল; কিন্তু উভয় অঞ্চল ঠিক একই কায়দায় নারীদের অধীন ভূমিকায় ঠেলে দিয়েছিল। আবার একইভাবে উভয় সমাজই বিধিনিষেধমূলক সামাজিক নিয়মকানুন ঝেড়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল।

শেষ পর্যন্ত চীন ও ইউরোপ উভয়ই লিঙ্গসমতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে।

এটি কেমন করে সম্ভব হলো, সেটি বোঝা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তার কারণ, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এবং গবেষকেরা লিঙ্গসমতা প্রতিষ্ঠার উপায় হিসেবে সামাজিক রাতিনীতি বদলানোর ওপর ক্রমবর্ধমানভাবে জোর দিচ্ছেন। তাঁরা সাধারণ মানুষের মনোভাব বদলানোর চেষ্টা করছেন। তাঁরা অনুসরণযোগ্য নতুন সামাজিক রীতিনীতির নকশা করছেন এবং সেই নকশা অনুযায়ী সাধারণ মানুষ যাতে নতুন রীতিনীতি অনুশীলনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন, সেই চেষ্টা করছেন।

কিন্তু এই গবেষকেরা ইতিহাস থেকে যে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ নিতে ভুলে যাচ্ছেন, সেটি হলো: সামাজিক রীতিনীতি আচমকা উদয় হয় না, এগুলো আমাদের চারপাশের বস্তুগত বাস্তবতার ফল। শুধু সেই বাস্তবতা বদলানো গেলে তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে সামাজিক রীতিনীতিতে বদল আসে। মানুষের আকস্মিক মন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তা আসে না।

এই সামাজিক রীতিনীতির জটিল বিবর্তন বোঝার জন্য ইতিহাসের সুদীর্ঘ বৃত্তকে যাচাই–বাছাই ও পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে দেখা দরকার।

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ক্লডিয়া গোল্ডিনের গবেষণাকাজে এই ধরনের পদ্ধতির উদাহরণ মেলে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মসংস্থান ক্ষেত্রের ওপর দীর্ঘ গবেষণা করে তিনি দেখেছেন, কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ার পেছনে সামাজিক রীতিনীতি ও মানুষের সামাজিক মনোভঙ্গি বদলে যাওয়ার বিষয়টি যতটা না ভূমিকা রেখেছে, তার চেয়ে চাকরিতে কর্মঘণ্টা কমে যাওয়া এবং ‘হোয়াইট কলার’ চাকরি (মূলত চেয়ার–টেবিলে বসে যে ব্যবস্থাপনাধর্মী কাজ করা হয়) বেড়ে যাওয়ার মতো কর্মপরিসর সৃষ্টি হওয়া অনেক বেশি ভূমিকা রেখেছে।

এই বিষয় ভারতে ভিন্নভাবে দেখা যাচ্ছে। সেখানে দুই দশক ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার দেখা যাচ্ছে এবং দ্রুতগতিতে দারিদ্র্য হ্রাস পাচ্ছে। তা সত্ত্বেও সেখানে ভালো বেতনের কাজে নারীদের অংশগ্রহণের অনুপাত খুব কম দেখা যাচ্ছে।

শ্রমবাজারে ঐতিহাসিকভাবেই নিম্নবর্ণের নারীদের অংশগ্রহণের হার বেশি। উচ্চবর্ণের মেয়েরা সামাজিক সংস্কৃতির কারণে বিশেষত, কায়িক শ্রমে আসেন না। ভারতে কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণের কম অনুপাত একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয়। এটিকে মাথায় রেখে নীতিনির্ধারকদের উচিত সামাজিক রীতিনীতি বদলানোর বদলে নারীশ্রমের চাহিদা তৈরির দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া।

অথচ ক্লডিয়া গোল্ডিনের ভাষ্য অনুযায়ী, চাকরি–বাকরিতে নারীর অংশগ্রহণের অনুপাত অনেক বাড়ার কথা। কিন্তু তা না হওয়ায় এই বৈপরীত্য বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কেউ মনে করছেন, সামাজিক রীতিনীতি ও বিধিনিষেধই এখানকার শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করছে। আবার সামাজিক বিধিনিষেধই এ ক্ষেত্রে নারীর একমাত্র বাধা কি না, তা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন।

আমাদের একটি নতুন গবেষণা এমন কিছু সামাজিক রীতি–রেওয়াজকে শনাক্ত করেছে, যেগুলো কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণের পথে বাধা হয়ে থাকে। প্রথমত, রান্না করা, রান্নার কাঠ–কয়লা জোগাড় করা, পানি আনা, গৃহস্থালির দেখাশোনা করা, বাচ্চাকাচ্চার যত্ন নেওয়া এবং বড়দের খাওয়াদাওয়াসহ গৃহস্থালির কাজ করার মতো অসামঞ্জস্যপূর্ণ দায়িত্ব অনেকটা রেওয়াজ মনে করে ভারতীয় নারীরা নিজের কাঁধে নিয়ে থাকেন।

ভারতীয় নারীরা সেখানকার পুরুষদের তুলনায় এই ধরনের ঘরকন্নার কাজে প্রায় দশ গুণ বেশি সময় ব্যয় করেন। এ ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য অংশের মেয়েদের তুলনায় ভারতের মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে হয় এবং তুলনামূলক আগে মাতৃত্বে প্রবেশ করেন। এটিই এখানকার রেওয়াজ।

এসব রেওয়াজ কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণে সীমিত প্রভাব ফেলছে। পাশাপাশি আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাকরিতে চাহিদা অনুযায়ী নারী কর্মী মিলছে না। অনেক নারী কর্মী পুরুষদের মতো দীর্ঘ সময় কাজ করতে চান না। জাত-পাত-বর্ণও এ ক্ষেত্রে কাজ করে।

শ্রমবাজারে ঐতিহাসিকভাবেই নিম্নবর্ণের নারীদের অংশগ্রহণের হার বেশি। উচ্চবর্ণের মেয়েরা সামাজিক সংস্কৃতির কারণে বিশেষত, কায়িক শ্রমে আসেন না।

ভারতে কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণের কম অনুপাত একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয়। এটিকে মাথায় রেখে নীতিনির্ধারকদের উচিত সামাজিক রীতিনীতি বদলানোর বদলে নারীশ্রমের চাহিদা তৈরির দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া।

অর্থাৎ, যে কাজে মেয়েদের নিয়মিত অংশগ্রহণ সহজ, সেই ধরনের কাজের ক্ষেত্র বাড়ানো দরকার।

অশ্বিনী দেশপান্ডে অর্থনীতির অধ্যাপক এবং ভারতের অশোকা ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ইকোনমিক ডেটা অ্যান্ড অ্যানালাইসিসের (সেডা) প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক।

ইংরেজি থেকে সংক্ষেপে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট