বৈশ্বিক উষ্ণায়ন যতটা ভাবা হচ্ছিল, তার চেয়েও দ্রুত হচ্ছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রাক্-শিল্পায়ন গড়ের তুলনায় বেড়েছে ১ দশমিক ৪৫ (শূন্য দশমিক ১২) ডিগ্রি সেলসিয়াস। মহাসাগরের উষ্ণায়নও এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। বায়ুমণ্ডলে মানুষের কর্মকাণ্ডের দরুন কার্বন, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের বৃদ্ধিও উদ্বেগজনক। সব মিলিয়ে ২০২৩ ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের উষ্ণতম বছর। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিশ্বব্যাপী কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে, কিন্তু অন্যান্য খাতের গতিধীর। দিন দিন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের হার বাড়ছে।
বাসযোগ্য পৃথিবী অর্জনে এখন পর্যন্ত ২৮টি জলবায়ু সম্মেলন হয়েছে। কিন্তু উষ্ণায়ন এখনো থামানো যায়নি। বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি। এই পরিস্থিতিতে পরবর্তী জলবায়ু সম্মেলন শুরু হবে আগামী নভেম্বরে, আজারবাইজানে।
ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর পক্ষে ভানুয়াতু ১৯৯১ সালে প্রথম জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ (ক্ষতি ও লোকসান) ধারণাটি দেয়। কিন্তু ২৭তম সম্মেলনে লস ও ড্যামেজ তহবিল গঠনের ব্যাপারে ঐকমত্য হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলো কীভাবে ক্ষতিপূরণ চাইবে? কোন কোন বিষয় এর অন্তর্ভুক্ত হবে?
লস ও ড্যামেজ সম্পর্কে সর্বজনীন সংজ্ঞা নেই। তবে অ্যাডাপটেশন গ্যাপ রিপোর্ট ২০২৩ অনুযায়ী, দুটি ক্ষেত্রে লস ও ড্যামেজ প্রতিবেদন তৈরি করা যেতে পারে। প্রথমত, প্রশমনের মাধ্যমে অভিযোজন সম্ভব না হলে। আর দ্বিতীয়ত, জলবায়ুর প্রভাব এড়ানো বা হ্রাসের চেষ্টা পুঙ্খানুপুঙ্খ নিরীক্ষণের মাধ্যমে।
প্রতিবেদনটিতে নির্গমন প্রশমনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি কমানোকে হার্ড বা সরাসরি, আর খাপ খাওয়ানোর মাধ্যমে ক্ষতি পোষানো সম্ভব হলে তাকে সফট বা পরোক্ষ অভিযোজন সীমা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
লস ও ড্যামেজ দুই প্রকার। যেসব ক্ষতি টাকায় রূপান্তর সম্ভব, সেগুলো অর্থনৈতিক। আর যেসব ক্ষতির মূল্য নিরূপণ সম্ভব না, সেগুলো অ-অর্থনৈতিক। জলবায়ু-সম্পর্কিত দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে বেলজিয়ামভিত্তিক দ্য ইন্টারন্যাশনাল ডিজাস্টার ডেটাবেজ এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ও সেনদাই কাঠামো তদারকব্যবস্থার জন্য দুর্যোগ ক্ষতি তথ্যভান্ডার ব্যবহার করে আগ্রহী দেশগুলোকে চলতি বছরের শেষ নাগাদ দ্বিবার্ষিক স্বচ্ছ রিপোর্ট দাখিল করতে বলা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত দেশ চাইলে দুর্যোগ-পরবর্তী মূল্যায়ন বা পুনর্বাসনের/পুনরুদ্ধারের খরচও জমা দিতে পারবে।
ওপরে বলা এই তাত্ত্বিক ধারণার সঙ্গে কিন্তু বাস্তবের অসংগতি রয়েছে। আর তা হওয়ারই কথা। ধনী দেশগুলো শুরু থেকেই জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর সঙ্গে লুকোচুরি খেলে আসছে। যেমন ২০০৯ থেকে বছরপ্রতি ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তহবিলের কথা ছিল। এখন পর্যন্ত পুরো অর্থ ছাড় হয়নি। ২০২০ সাল নাগাদ ৮৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের ছাড় হলেও মাত্র ৮ শতাংশ স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে দেওয়া হয়েছে। আবার অভিযোজনের তুলনায় প্রশমনের ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলো অর্থ বেশি খরচ করে। ঝুঁকিপূর্ণ দেশের জন্য যা হাস্যকর।
অনেকে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির যে বর্তমান অর্থপদ্ধতি, তা পুনর্বিন্যাসের কথা বলছেন। এতে অর্থ ছাড়ে রয়েছে গোঁজামিল। অনুদানের পরিবর্তে দেওয়া হচ্ছে ঋণ। ফলে ঋণে জর্জরিত উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবস্থা হয়েছে আরও খারাপ। উন্নত বিশ্বের টালবাহানায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর অভিযোজন প্রক্রিয়াকে মারাত্মক বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে দিন দিন ব্যয় বাড়ছে। বছরপ্রতি অভিযোজনের প্রাক্কলন হচ্ছে ২১৫ বিলিয়ন থেকে ৩৮৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
২০৩৫ সাল নাগাদ ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর অভিযোজনে ৩ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রয়োজন হবে। অথচ ধনী দেশগুলো উন্নয়নশীল বিশ্বের সঙ্গে গ্রামের মহাজনের মতো আচরণ করছে। আমাদের মতো দুর্যোগপ্রবণ জনবহুল দেশের জন্য এমন আচরণ এক অশনিসংকেত। কেননা, ২০০২-২০২১ অবধি জলবায়ু-সম্পর্কিত উন্নয়নে (লস ও ড্যামেজ ব্যতীত) ছাড়কৃত ১ দশমিক ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে বাংলাদেশ পায় মাত্র ১২ শতাংশ।
আমাদের ক্ষতি বেশি কিন্তু বরাদ্দ কম। বিগত সরকারের আমলে জলবায়ুসহিষ্ণু দেশ গঠনে নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি হয় জলবায়ু ট্রাস্ট তহবিল। ২০২১ সাল পর্যন্ত এই তহবিল থেকে বিভিন্ন প্রকল্প বাবদ প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হয় কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা তৈরিতে। এমন বিনিয়োগের লাভালাভ কেমন, সেটা বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে এসেছে। পৃথিবীতে সম্পদ অপচয়ের পুরস্কার থাকলে নিঃসন্দেহে আমরা প্রথম হতাম!
গুণগত তথ্য বা নির্ভরযোগ্য গবেষণা না থাকলেও পরিবর্তিত জলবায়ুর ক্ষতিপূরণ আদায়ে বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে খুবই সোচ্চার। উন্নত দেশগুলোর ক্ষতির দায় আমরা কেন নেব? অথচ এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুযায়ী পরিপূর্ণ ক্ষতি ও লোকসান সমীক্ষা কোনো খাতে হয়নি। হয়ে থাকলেও তা ডিজিটালি অনুপস্থিত। ভার্চ্যুয়ালি দেখা যায়, একটি ‘স্কোপিং’ সমীক্ষা হয়েছিল ২০২১ এর আগে। সেখানে ছয়টি নীতিমালার সুপারিশ রয়েছে। সেখানে নির্ভুল জলবায়ুবিষয়ক তথ্যভান্ডার প্রতিষ্ঠার সুপারিশ সর্বাগ্রে থাকলেও অদ্যাবধি দৃশ্যমান কিছু নেই।
আমাদের বিশেষজ্ঞরা দেশে–বিদেশের সভা-সেমিনারে জলবায়ু ঝুঁকিকে তুলে ধরেন দুর্বল তথ্যের ভিত্তিতে। সেখানে তথ্যের চেয়ে আবেগ থাকে বেশি। কিন্তু বৈশ্বিক ক্ষতি ও লোকসান তহবিল থেকে ক্ষতিপূরণ পেতে গুণগত তথ্য ও সুচারু নিরীক্ষার বিকল্প নেই।
এ ছাড়া রয়েছে একটি ওয়ার্কিং পেপার। দেশি ও বিদেশি গবেষকেরা দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ততার লস ও ড্যামেজ সম্পর্কে দুটি কাজ করছেন স্বল্প পরিসরে সামাজিক গবেষণাপদ্ধতিতে। বিজ্ঞানভিত্তিক কাজ আরও হলে আমরা ধনী দেশগুলোর সঙ্গে ক্ষতিপূরণের জন্য জোরালো দেনদরবার করতে পারতাম।
উজানে বাঁধের মাধ্যমে শুকনা মৌসুমে পানি প্রত্যাহারও আমাদের জলবায়ুজনিত সমস্যার জন্য কম দায়ী নয়। এমন জটিল বিষয়ে সুচারু নিরীক্ষা প্রয়োজন। আমাদের বিশেষজ্ঞরা দেশে–বিদেশের সভা-সেমিনারে জলবায়ু ঝুঁকিকে তুলে ধরেন দুর্বল তথ্যের ভিত্তিতে। সেখানে তথ্যের চেয়ে আবেগ থাকে বেশি। কিন্তু বৈশ্বিক ক্ষতি ও লোকসান তহবিল থেকে ক্ষতিপূরণ পেতে গুণগত তথ্য ও সুচারু নিরীক্ষার বিকল্প নেই।
এখন বাংলাদেশ সরকারের উচিত, সময় নষ্ট না করে স্বীকৃত গবেষকদের সমন্বয়ে জলবায়ু পরিবর্তনে খাতওয়ারি ক্ষতি ও লোকসান বিশ্লেষণ করা। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে অভিযোজন খাতে ২০৫০ সাল নাগাদ আমাদের প্রয়োজন হবে ৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জলবায়ুর কারণে মরুকরণ, বন্যা, খরা বাড়তে থাকলে সম্পদ যেমন কমবে, তেমনই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জীবন হবে দুর্বিষহ।
অভিযোজনপ্রক্রিয়াকে ফলপ্রসূ করতে নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী ক্ষতিপূরণের আলোচনা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। তবে সবার আগে প্রয়োজন নির্ভুল ও সঠিক তথ্য। না হলে জলবায়ুর সামান্য ক্ষতি করেও আমরাই থেকে যাব সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। অথচ বৈশ্বিক তহবিল থেকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতিপূরণ পাওয়া থেকে যাবে অধরা।
ড. আশরাফ দেওয়ান অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব আর্থ অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্সেসের গবেষণা পরিচালক