ভূরাজনৈতিক সংকটের বেড়াজালে যুক্তরাষ্ট্র, এখন কী করবেন বাইডেন

জো বাইডেন

যুক্তরাষ্ট্র এই মুহূর্তে বিশ্বের তিনটি প্রধান ভূরাজনৈতিক সংকটে জড়িয়েছে। দূরবর্তী তিন দেশে কমপক্ষে তিনটি শক্তির বিরুদ্ধে লড়ছে তারা। এমন সব দেশের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র দাঁড়িয়েছে, যাদের সামরিক সুরক্ষা দিতে তারা চুক্তিবদ্ধ নয়।

সাময়িক যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি বিনিময় চুক্তির পরও মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতির একটা উদ্দেশ্য আছে। তারা চায় ইরান ও হিজবুল্লাহ যেন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো অভিযানে না যায়। কিন্তু এই উপস্থিতি মার্কিন বাহিনীকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িয়ে পড়ার।

ইরাক, সিরিয়া ও ইয়েমেনে ইরান–সমর্থিত বাহিনী উপর্যুপরি ড্রোন ছুড়েছে মার্কিন সেনাদের ওপর। মার্কিনিরাও তাদের প্রতিহত করেছে। পূর্ব ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়েছে প্রক্সি যুদ্ধে। পূর্ব এশিয়ায় তাইওয়ানের রাজনৈতিক অবস্থানকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র এখন চীনের মুখোমুখি।

গত মাসে ওভাল অফিসে দেওয়া বক্তৃতায় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থানের পক্ষে যুক্তি দেখান। তিনি ও তাঁর প্রশাসন বলতে চাইছে, এই যুদ্ধগুলো গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রে মধ্যে চলা বৈশ্বিক যুদ্ধ ।

বাইডেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাডেলিন অলব্রাইটকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, আমেরিকা একটি ‘অপরিহার্য জাতি’ এবং আমেরিকার নেতৃত্ব হলো তা–ই, যা পৃথিবীকে একত্র করে। বাইডেন আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ইসরায়েল ও ইউক্রেনের জয় অপরিহার্য। সপ্তাহান্তে ওয়াশিংটন পোস্ট ওপ–এডে যুক্তরাষ্ট্র অত্যাবশ্যক জাতি এই বক্তব্যের তিনি পুনরাবৃত্তি করেন।

এসব যুক্তি ধোপে টেকে না। সংকটে জড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সক্ষমতার যে ক্ষয় হচ্ছে, তাতে তারা অহেতুক ঝুঁকিতে পড়ছে, নিজ দেশের নাগরিকদের মধ্যে শত্রুতা বাড়াচ্ছে। সাধারণ মানুষ অনেক সম্পদের ব্যবহার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

মার্কিনিরা এখন বাইরের দেশের কোনো যুদ্ধে অনির্দিষ্টকালের জন্য জড়িয়ে পড়ার বিরুদ্ধে। ইসরায়েল ও ইউক্রেনকে সহায়তার প্রস্তাবে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের কোনো পক্ষই রাজি হয়নি।

মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শত্রুতা বা মিত্রতায় জড়ানোর যে নীতি যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে অনুসরণ করে আসছে, তাতে হিতে বিপরীত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর অত্যধিক চাপ প্রয়োগের নীতি নিয়েছে। ইরানের ওপর তারা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং ইরানের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা কাসেম সোলাইমানির মতো ব্যক্তিকে হত্যা করেছে।

পাশাপাশি ইরাকে সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত করে তেহরানের আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারে সহযোগিতা করেছে, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে আসাদবিরোধী বাহিনীকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছে। এতে করে আইসিস ও যুক্তরাষ্ট্র–সমর্থিত সুন্নি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ইরান–সমর্থিত মিলিশিয়ারা উল্টো ক্ষমতায়িত হয়েছে।

ওয়াশিংটনের শর্তহীন সমর্থন পেয়ে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের যে মিত্ররা আছে, তারাও ক্রমেই বেয়াড়া হয়ে উঠেছে। মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে তারা কোনো ভূমিকা রাখছে না।

ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন ও গাজায় দীর্ঘমেয়াদি অবরোধ জারি রাখার পরও যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে অব্যাহত সমর্থন দিয়ে গেছে। অথচ এই বসতি স্থাপন ও অবরোধ ঘিরে পুরো অঞ্চলে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে।

গণতন্ত্র বনাম স্বৈরতন্ত্র—এই বক্তৃতা দিলেও যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবকে ইয়েমেনে হুতিদের বিরুদ্ধে ভয়ংকর যুদ্ধে সমর্থন দিয়ে গেছে। এই যুদ্ধকে জাতিসংঘ বলেছে বিশ্বের নিকৃষ্টতম মানবিক সংকট। এ যুদ্ধে ৩ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ নিহত হন। দেশটির প্রায় ৮০ ভাগ মানুষের জীবন মানবিক সহায়তানির্ভর হয়ে ওঠে। ওই সময় থেকে বাইডেন প্রশাসন সৌদি আরবের সঙ্গে নিরাপত্তার সম্পর্ক আরও জোরদার করে।

আরও পড়ুন

মধ্যপ্রাচ্য বা ইউক্রেনে সংঘাত না এড়িয়ে, প্রেসিডেন্ট বাইডেন ওভাল অফিসে দেওয়া বক্তৃতায় এই সংকটকে বৈশ্বিক সংকট বলে উল্লেখ করেন।

বাইডেন দাবি করেন, যদি যুক্তরাষ্ট্র দূরের শত্রুদের প্রতিহত করতে না পারে, তাহলে তারা আরও শক্তিশালী ও আগ্রাসী হয়ে উঠবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও শীতল যুদ্ধের সময় আলোচিত ‘মিউনিখ অ্যানালজি’ ও ‘ডমিনো থিওরি’র উদাহরণ টানেন তিনি। এই উদাহরণ দুটি আবার প্রমাণনির্ভর নয়।

বাইডেন দাবি করেন, যদি রাশিয়াকে ইউক্রেনে থামানো না যায়, তা হলে পুতিন পোল্যান্ড অথবা বাল্টিকের দিকে এগোবেন। এটা একটা অবাস্তব চিন্তা। রাশিয়া চাইলেও পূর্ব ইউরোপ দখলের মতো বস্তুগত সক্ষমতা তাদের নেই। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা ছাড়া, ইউরোপের ন্যাটো সদস্যরা ২০২২ সালে সামরিক খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করে।

রাশিয়ার চেয়ে তাদের সক্রিয় সেনার সংখ্যা বেশি, সম্মিলিতভাবে তাদের মোট দেশজ উৎপাদন প্রায় ৯ গুণ বেশি, জনসংখ্যাও সাড়ে ৩ গুণ পর্যন্ত বেশি, তাদের পারমাণবিক হামলা প্রতিরোধের নিজস্ব ব্যবস্থা আছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার যে হাল, তাতে বোঝা যায় যে রাশিয়াকে নিয়ে এই ভয়ের কোনো ভিত্তি নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের দূর–দূরান্তে যে সামরিক উপস্থিতি, তা হ্রাস করলে আঞ্চলিক দেশগুলো স্থানীয় হুমকির বিপরীতে নিজ দেশের শক্তি বৃদ্ধি করবে। আঞ্চলিক মিত্ররা নিজ নিজ দায়িত্ব নিলে যুক্তরাষ্ট্রকে আর বড় বড় যুদ্ধে জড়াতে হবে না। দূরবর্তী অঞ্চলে সেনা উপস্থিতি বজায় রাখতে যে খরচ, তা–ও কমে আসবে।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন আরও বলেন, যদি ইউক্রেনে রাশিয়ার চূড়ান্ত পতন না হয়, তাহলে তাইওয়ান দখলে চীন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড্যারিল প্রেস ও জোনাথন মার্সার যেমনটি বলেন, শত্রুরাষ্ট্রের সক্ষমতা বিচার করতে হয় দেশটির বর্তমান সক্ষমতা ও স্বার্থ বিবেচনায়, তাদের অতীত দেখে নয়।

যদি চীন তাইওয়ান দখল করে, তাহলে ধরে নিতে হবে যে তাইওয়ানে বেইজিংয়ের স্বার্থ ওয়াশিংটনের চেয়ে বেশি। উপকূলের ১০০ মাইলের ভেতর তাদের সেনা উপস্থিতি আছে এবং তারা বিশ্বাস করে যে শান্তিপূর্ণভাবে তাদের একত্র হওয়ার আশা নেই।

তা ছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশের সঙ্গে সামরিক চুক্তি করেছে, তারা জানে যে তাদের নিরাপত্তায় যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি মোতাবেক কাজ করবে। সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও জাপান ও জার্মানি সামরিক খাতে ব্যয় বাড়ায়নি। কারণ, তারা জানে, বিপদে পড়লে আঙ্কেল স্যাম আছে। সে–ই রক্ষা করবে।

যুক্তরাষ্ট্র যদি এসব দেশের প্রতি একটু কম মনোযোগী হতো, তাহলে তারা নিজেরাই নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে সচেষ্ট হতো। বিনা প্রতিরোধে সার্বভৌমত্ব চীন বা রাশিয়ার হাতে তুলে দিত না।

যুক্তরাষ্ট্রের আরও নিয়ন্ত্রণমূলক কৌশল নেওয়া দরকার। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নিরূপণ করা দরকার অত্যন্ত কঠোরভাবে, যেন নতুন কোনো সংকটে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি কমে। দূরবর্তী প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রকে উসকানি দেওয়ার কোনো মানে হয় না। এসব ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত দেশের ভেতরের সম্পদ ও চাহিদা পূরণ করা।

আরও পড়ুন

প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের দেশগুলোর সঙ্গে কোনো স্থায়ী শত্রুতা বা মিত্রতার সম্পর্কে যাওয়া উচিত নয়। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন একদা বলেছিলেন, ‘আমাদের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে আমরা প্রতিশ্রুতিতে যাব।’

সামরিক জোটভুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্য প্রয়োজনে অন্যের পক্ষে যুদ্ধে যাওয়া। যুক্তরাষ্ট্র সুনির্দিষ্ট ঝুঁকির প্রেক্ষাপটে জোট করবে, যখন ঝুঁকি থাকবে না তখন জোটও বদলাবে। জোট রক্ষায় অর্থ ব্যয় ও ঝুঁকি আছে। তাই সত্যিকার অর্থে নিরাপত্তার স্বার্থ দেখতে হয়। বৈশ্বিক নেতৃত্বের ভান নিয়ে বসে থাকলে চলে যায়।

দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে তার শত্রুরা যেন একজোট না হয়, তা নিশ্চিত করা। আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে গণতন্ত্র বনাম একনায়কতন্ত্রের লড়াই হিসেবে উপস্থাপন করে, দেশটি আরও বহু দেশকে শত্রুতে পরিণত করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের হুমকির মুখে চীন, রাশিয়া ও ইরান মূলত একজোট হয়েছে। কোনো বিশেষ ধরনের সরকারব্যবস্থা রপ্তানি তাদের উদ্দেশ্য নয়। অন্য দেশে মার্কিন মূল্যবোধ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা সবচেয়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। স্বার্থ না থাকলে বা সন্দেহ না থাকলে শত্রুরাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করা উচিত।

আরও পড়ুন

তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে আঞ্চলিক হুমকি সামলানোর দায়িত্বভার তার আঞ্চলিক মিত্রদের হাতে ছেড়ে দেওয়া। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে। ইউক্রেন ও গাজায় অস্ত্রশস্ত্রের ঘাটতি প্রমাণ করে যে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদেরও সীমা আছে।

যুক্তরাষ্ট্রের দূর–দূরান্তে যে সামরিক উপস্থিতি, তা হ্রাস করলে আঞ্চলিক দেশগুলো স্থানীয় হুমকির বিপরীতে নিজ দেশের শক্তি বৃদ্ধি করবে। আঞ্চলিক মিত্ররা নিজ নিজ দায়িত্ব নিলে যুক্তরাষ্ট্রকে আর বড় বড় যুদ্ধে জড়াতে হবে না। দূরবর্তী অঞ্চলে সেনা উপস্থিতি বজায় রাখতে যে খরচ, তা–ও কমে আসবে।

সর্বোপরি যুক্তরাষ্ট্র যদি বিশ্বব্যাপী তার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রসার চায়, তাহলে নিজ দেশে মডেল গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটাক। এই মডেল তখন অন্য দেশে অনুসৃত হবে।

বাইডেন বলেন, ‘আমেরিকা সারা বিশ্বের বাতিঘর’। কিন্তু আমেরিকা যখন তার সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটাচ্ছে, তখন তার নিজের দেশই বেদনাহত। দেশটাকে বাঁচাতে হবে, সাম্রাজ্য নয়।

  • ক্রিস্টোফার ম্যাকক্যালিয়ন ফেলো: ডিফেন্স প্রায়োরিটিজ। অ্যাডজাঙ্কট লেকচারার হান্টার কলেজ। নিবন্ধটি সিএনএনে প্রকাশিত, ইংরেজি থেকে অনূদিত।