নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের পথ কী

‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপকল্প ২০২১: প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি’ একটি জাতীয় দলিল। এটিকে আশ্রয় করেই নতুন শিক্ষাক্রম প্রণীত এবং কিছু কিছু শ্রেণিতে এর বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। একাডেমিক বিবেচনায় শিক্ষাক্রমটি একটি সময়োপযোগী, আধুনিক ও ভালো মানের, এ বিষয়ে সন্দেহ করার কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা, শিক্ষার অবকাঠামো, যোগ্য লোকবল—এসব বিবেচনায় কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। সামগ্রিকভাবে নতুন এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে আমরা কি প্রস্তুত?

ইতিমধ্যে কিছু কিছু দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও দুর্বলতা সামনে আসার আশঙ্কা রয়েছে। এখন থেকেই সেগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি নিরাময় করার উদ্যোগ না নিলে, নতুন শিক্ষাক্রমটি একটি ভালো ও মানসম্পন্ন শিক্ষাক্রম হওয়া সত্ত্বেও ব্যর্থতার দায় নিয়ে সময়ের স্রোতে হারিয়ে যেতে পারে। এ আশঙ্কা কিন্তু অমূলক নয়!  

প্রথমত, একটি শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সঙ্গে যত অংশীজন থাকেন, তাঁদের প্রত্যেকের মতামত ও সহযোগিতা ছাড়া কি সেটির পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব? সবচেয়ে স্থায়ী ও নির্ভরশীল অংশীজন হচ্ছেন শিক্ষক। বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থায় সেই শিক্ষকসমাজ কি প্রস্তুত নতুন এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে? অন্যভাবেও বিষয়টি দেখা যেতে পারে, তা হলো তাঁদের কি নতুন এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের যথেষ্ট দক্ষতা আছে?

আবার যদি ধরে নেই, যেসব শিক্ষকের নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠ পরিচালনা ও মূল্যায়ন করার দক্ষতা আছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব শিক্ষক কি শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত এটি বাস্তবায়নের সব দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে? বিদ্যমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় শিক্ষকসমাজ মোটেই প্রস্তুত নন। কেননা, সরকারি, বেসরকারি ও এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধার মধ্যে রয়েছে বিস্তর বৈষম্য।

শিক্ষকগণের এই আর্থিক বৈষম্য দূরীকরণে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ শুরু করতে হবে; যাতে শিক্ষকরা মন দিয়ে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন। শিক্ষকতা পেশায় আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে মেধাবী তরুণেরা এ পেশায় আসতে আগ্রহী হবেন।

অন্যদিকে দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। যথাযথ প্রশিক্ষণের আওতায় প্রাক্‌–প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনায় যুক্ত সব শিক্ষককে প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা জরুরি। বর্তমানে সরকারি ও এমপিওভুক্ত সব শিক্ষকের নতুন শিক্ষাক্রম বিষয়ের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ চলছে।

এটা খুবই ভালো উদ্যোগ কিন্তু এর বাইরেও অনেক শিক্ষক রয়েছেন, যাঁরা প্রাইভেট স্কুল বা কেজি স্কুলের শিক্ষক, তাঁদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা ছাড়া কীভাবে এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হবে? দেশে প্রাইভেট স্কুল বা কেজি স্কুলের সংখ্যাও কম নয়। এসব স্কুলের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের বাইরে রেখে নতুন শিক্ষাক্রম কীভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব, সেটা পরিষ্কার নয়। নতুন শিক্ষাক্রমে প্রতিটি শ্রেণিকক্ষকে হতে হবে একটি করে গবেষণাগার বা ল্যাবরেটরি।

এখানে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক প্রতিদিন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নানা ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। পরীক্ষা–নিরীক্ষা করবেন। নিজের জানাকে একে অপরের সঙ্গে শেয়ার করবেন ও নিজেকে সমৃদ্ধ করবেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশের স্কুলগুলোয় কি বর্তমানে যথেষ্ট পরিমাণ শ্রেণিকক্ষ বা জায়গা, পরিবেশ ও উপকরণ আছে? এক দিনে বিদ্যালয়গুলোর এসব চাহিদা পূরণ করা যাবে না সত্যি, কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে এসব বিষয় নিয়ে এখন থেকেই পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের বিকল্প আছে কি?

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে অভিভাবকগণ হলেন আরেকটি অংশীজন। এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে যতটুকু কাজ হয়েছে এবং হচ্ছে, তাতে অভিভাবক নামক বিরাট অংশের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি। স্বাধীনতা–উত্তর দেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে এত বড় পরিবর্তন এর আগে হয়নি। কিন্তু অভিভাবকেরা এই পরিবর্তনের বিষয়ে বলতে গেলে কিছুই জানেন না। তাঁদের অন্ধকারে রেখে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব। বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় এ কথা বলা যায় যে নতুন শিক্ষাক্রম বিষয়ে অভিভাবকেরা এখনো অন্ধকারে।

ফলে দিন দিন তাঁদের উদ্বেগ বাড়ছে সন্তানদের শিক্ষা নিয়ে। আর এই উদ্বেগ থাকাটাই স্বাভাবিক নয় কি? নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে অভিভাবকদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তাঁদের সহায়তা ছাড়া শিক্ষকদের পক্ষে পূর্ণাঙ্গরূপে শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মূল্যায়ন সম্ভব নয়। সে দিক বিবেচনায়ও অভিভাবকদের এই শিক্ষাক্রম বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন। জাতীয় পর্যায়ে সভা–সেমিনারের পাশাপাশি টেলিভিশন ও রেডিওতে নতুন শিক্ষাক্রম বিষয়ে প্রচার–প্রচারণা করা যেতে পারে।

আর স্থানীয় পর্যায়ে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি এবং সরাসরি অভিভাবক সভার মাধ্যমে নতুন শিক্ষাক্রমের বিভিন্ন দিক নিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে মত বিনিময় ও আলোচনা করে; তাদের এটি বাস্তবায়নের অংশ করার উদ্যোগ গ্রহণ ছাড়া এটির বাস্তবায়ন কতটুকু সম্ভব হবে, সে বিষয়ে সন্দেহ থেকে যাচ্ছে।

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন একটি বৃহৎ কর্মযজ্ঞ। এটির বাস্তবায়নে সব কটি পক্ষকে একত্রে কাজ করতে হবে। যেভাবে শুধু কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে এই কার্যক্রম বাস্তবায়নের উদ্যোগ চলছে, তাতে এর ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। কেননা, শিশুরা শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই শেখে না; তারা শেখে সমাজ থেকে, পরিবার থেকে, প্রকৃতি থেকে, সর্বোপরি মানুষ থেকে। সুতরাং নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে যত মানুষকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যাবে, ততই এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন অর্থপূর্ণ হবে।

  • মো. সাইফুজ্জামান, শিক্ষা উন্নয়নকর্মী