২০২৫ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলো। এবার পরীক্ষার আয়োজন থেকে ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত একধরনের রাজনীতিমুক্ত পেশাদারত্বের ছাপ পাওয়া গেল। শিক্ষা প্রশাসন সে জন্য ধন্যবাদ পেতে পারে।
এবার পরীক্ষার্থী ছিল ১৯ লাখের মতো। পাস করেছে ১৩ লাখ এবং ফেল করেছে ৬ লাখ। জিপিএ–৫ এর সংখ্যাও কমেছে। নিঃসন্দেহে এটা ‘খারাপ ফল’।
এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ফেল করেছে দেখে বিভিন্ন দিকে হাহাকার দেখা যাচ্ছে। অনেক বোর্ড ছয়-সাত বছরের মধ্যে ‘খারাপ ফল’ করেছে বলে অনলাইনে হেডিং দেখছি। সর্বোচ্চ জিপিএ পাওয়াদের সংখ্যাও এবার অনেক কমেছে। একজন শিক্ষার্থী-পরীক্ষার্থীর পেছনে পরিবারের অনেক বিপুল বিনিয়োগ থাকে। ফলে লাখ লাখ পরিবারে আজকে একটা দুঃখের দিন।
এটা কেন হলো সেটা সবাইকে অনুসন্ধান করতে হবে স্কুল পর্যায়ে। এর সঙ্গে রাজনীতিকে জড়ানো ঠিক হবে না। অতীতে এ ধরনের পরীক্ষা নিয়ে সেই কাজটি হতো।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, রাজনৈতিক প্রয়োজনে পাসের হার বাড়ানোর কাজে এবার শিক্ষা প্রশাসন কিছু করেনি। ফলে আমাদের বিদ্যমান শিক্ষা ও পড়াশোনার মান অনুযায়ী শিক্ষার্থী-পরীক্ষার্থীরা ফল পেয়েছে। বহু বছর পর এবারই বাস্তবসম্মত ফলাফল পেলাম আমরা। অবশ্যই এই বাস্তবতা আনন্দদায়ক নয়। কিন্তু আমাদের এটা পেশাদারত্বের সঙ্গেই মানতে হবে।
স্কুল পর্যায়ে যারা এসএসসির খাতা দেখায় যুক্ত থাকেন, তাঁরা জানেন অতীতে নমনীয়ভাবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের জন্য স্পষ্ট নির্দেশনা থাকত। কোনো শিক্ষার্থী ন্যায্যত খারাপ ফল করলেও খাতা দেখার দায়িত্বে থাকারা তিরস্কৃত হতেন। গুটিকয়েক ব্যক্তিকে দিয়ে বেশি বেশিসংখ্যক খাতা দেখানোর বোর্ডভিত্তিক দুষ্টচক্রও এবার ভাঙা হয়েছে বলে জেনেছি।
স্কুল পর্যায়ে যারা এসএসসির খাতা দেখায় যুক্ত থাকেন, তাঁরা জানেন অতীতে নমনীয়ভাবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের জন্য স্পষ্ট নির্দেশনা থাকত। কোনো শিক্ষার্থী ন্যায্যত খারাপ ফল করলেও খাতা দেখার দায়িত্বে থাকারা তিরস্কৃত হতেন। গুটিকয়েক ব্যক্তিকে দিয়ে বেশি বেশিসংখ্যক খাতা দেখানোর বোর্ডভিত্তিক দুষ্টচক্রও এবার ভাঙা হয়েছে বলে জেনেছি।
এটাও জানা গেল পাসের হার কমবেশি করার জন্য ওপর মহল থেকে এবার কোনো নির্দেশনা ছিল না। এমনকি ফলাফল বিপর্যয়ের আলামত দেখেও সরকার নির্লিপ্ত ছিল। কোনোভাবে নম্বর বাড়িয়ে পাসের হার বাড়ানোর জন্য উদ্যোগ নেয়নি। এসব প্রশংসার দাবি রাখে। এবার জিপিএ ফাইভের সংখ্যা আগের তুলনায় ৪০ হাজার কম।
আগে সাফল্য দেখানোর জন্য অহেতুক জিপিএ ফাইভের সঙ্গে বাড়িয়ে দেওয়া হতো। যেটির কারণে একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা আমরা বিগত বছরগুলোতে লক্ষ করেছি। জিপিএ ফাইভ না পাওয়ার কারণে বহু আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। পরীক্ষার শুরু থেকে ফলপ্রকাশ পর্যন্ত কোনো ধরনের সরকারি হস্তক্ষেপ না করার মধ্য দিয়ে এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার অবসান হোক।
আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষার মান অনুযায়ী ফল পাওয়ার পর এখন ফল বিপর্যয়ের প্রকৃত বাস্তব কারণ খোঁজা অনেক সহজ হবে। শিক্ষার সব স্তরে বিগত বছরগুলোয় যেভাবে কৃত্রিমভাবে একটা জয়জয়কার ভঙ্গি গড়ে তোলা হয়েছিল, সেখান থেকে আমাদের ভূমিতে নেমে আসা দরকার ছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শুরুতে এক দফা অটো পাসের সুযোগ দিয়ে যে মহা ভুল করা হয়েছিল এসএসসি ২০২৫ তার বিপরীতে একটা ভালো সংশোধনের উদ্যোগ।
আশা করা যায়, এইচএসসিতেও শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই রকম পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে। কোনোভাবে পরীক্ষাপ্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হবে না এবং খাতা দেখার প্রক্রিয়ায় পূর্ণ পেশাদারত্বের নীতি অনুসরণ করা হবে।
এসএসসির আয়োজন থেকেই এবার একটা বিষয় লক্ষ করা গেছে, উপদেষ্টা থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রশাসন পরীক্ষাকে পরীক্ষার মতো এগোতে দিয়েছেন। টিভি ক্যামেরা নিয়ে আগে যেভাবে হলে হলে উপদ্রব চালানো হতো, সেসবও এবার তেমন একটা দেখা যায়নি। আসলে, মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের পরীক্ষার হলে যাওয়া যত কমানো যায়, ততই পরীক্ষার্থীদের জন্য মঙ্গল।
এবার ফলাফল ঘোষণাও অপ্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা বর্জন করা হয়েছে দেখে ভালো লাগল। অতীতে এ রকম ফল ঘোষণার কাজে অহেতুক প্রধানমন্ত্রীকে পর্যন্ত জড়িয়ে ফেলা হতো। শিক্ষামন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে ফলাফল আগাম পেশ করতেন। কেন এ রকম করা হতো, বোঝা মুশকিল ছিল।
ফল ঘোষণাসংশ্লিষ্ট কাজে কোনো ঊর্ধ্বতন সরকারি ব্যক্তির অপ্রয়োজনীয়ভাবে উপস্থিতি ছিল না। ফল তৈরিতেও অতীতে অনেক বেশি সময় নেওয়া হতো। এবার মাত্র দুই মাসে কাজটি শেষ হলো।
সব মিলিয়ে এসএসসির ব্যবস্থাপনায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মন্ত্রণালয় ও তাদের সংশ্লিষ্ট দপ্তর ভালো নজির তৈরি করল। আশা করি এ ধারা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। এর ফলে অভিভাবকদের কাছে একটি বার্তা যাবে এবং ঘরে ঘরে পড়ার রেওয়াজ বাড়বে। এবারের মতো নজির এখন বিশেষভাবে অনুসরণ হওয়া দরকার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলায়।
আলতাফ পারভেজ লেখক, গবেষক এবং সাবেক শিক্ষক।
